ছোট লাল বইয়ের বড় নেতা
সারা বিশ্বে চীনা কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং এর গ্রন্থকে অভিহিত করা হয় 'ছোট লাল বই' নামে, যা ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ছাপানো বই হিসাবে স্বীকৃত।
কমিউনিস্ট গুরু কার্ল মার্কসের গ্রন্থ 'বড় লাল বই' অভিধায় প্রতীকী পরিচিতি পেয়েছে আর মাওয়ের বই পেয়েছে 'ছোট লাল বই' শীর্ষক উপাধি। তবে রাজনৈতিক গ্রন্থের মধ্যে মাওয়ের বই বহুল প্রচারের জন্যও বিশ্ববিখ্যাত এবং ইতিহাস সৃষ্টকারী।
মাও সেতুং-এর উদ্ধৃতি নির্ভর একটি অনুপ্রেরণীয় রাজনৈতিক ও সামরিক দলিল হিসেবে পিএলএ ডেইলি (পিপলস লিবারেশন আর্মি ডেইলি) এর একটি অফিস দ্বারা 'ছোট লাল বই' সংকলিত হয়েছিল। প্রাথমিক প্রকাশনায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের ২৩টি বিষয় যুক্ত করে ২০০ নির্বাচিত উদ্ধৃতি দিয়ে বইটি তৈরি হয়।
বইটি প্রথম ৫ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালে একটি সম্মেলনের প্রতিনিধিদের দেওয়া হয়েছিল এবং তাদেরকে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে ও মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল। প্রতিনিধিদের এবং বইয়ের সংকলকদের মতামতের উপর নির্ভর করে, ২৫টি বিষয়ে ২৬৭টি উদ্ধৃতিতে উন্নীত করা হয়।
শুধু 'ছোট লাল বই' নয়, মাও রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মুদ্রণ ছিল একই সময়ে খুব বেশি পরিমাণে। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মাও সেতুং-এর রচনাবলী, চার খণ্ড, যা ১৪টি ভাষায় ২,৮৭৫ মিলিয়ন কপি ছাপা হয়। মাও সেতুং এর নির্বাচিত প্রবন্ধ, (বিভিন্ন সংস্করণে মোট ২৫২ মিলিয়ন কপি) এবং তার একক নিবন্ধ বই, এবং কবিতার বই ছাপা হয় বহু মিলিয়ন কপি।
১৯৬৬ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারণা বিভাগ চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর উদ্ধৃতি বিদেশে প্রচারের অনুমতি দেয়। বিদেশি প্রয়োজন মেটাতে, চীনা বিদেশি ভাষা প্রেস-এর সম্পাদকগণ অবস্থার প্রয়োজনীয় পুনঃপাঠ গ্রহণ করে। তারা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৬ সালে চীনা নেতা লিন পিয়াও স্বাক্ষরিত একটি দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপায়।
১৯৬৭ সালের মে মাসের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, ইটালি, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, ইরান, আরব এবং আফ্রিকানসহ ১১৭টি দেশের বিভিন্ন এলাকার বইয়ের দোকানগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন মাওয়ের উদ্ধৃতি বা 'ছোট লাল বই' সরবরাহ করা হয়।
চীনা বিপ্লবী, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নেতা মাও সেতুং ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মারা যান ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর।
১৯৪৯ সালে সমাজতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চীন শাসন করেন। তিনি ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ধ্রুপদী মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তার তাত্ত্বিক অবদান, সমর কৌশল এবং তার মতাদর্শিক নীতিসমূহকে একত্রে মাওইজম বা মাওবাদ নামে অভিহিত করা হয়।
মাও চীনের হুনান প্রদেশের শাং তান জেলার শাউ শাং চুং গ্রামের এক অতি সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাও সেতুং এর বাবার নাম ছিল মাও জেন শেং (শুন সেন)। শুন শেং দরিদ্র কৃষক হলেও কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করে জমিজমা ক্রয় করে অবস্থার উন্নতি করেন এবং কাঁচামালের ব্যবসা করে রীতিমত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ হয়ে ওঠেন। মাওয়ের অন্য দুই ভাইয়ের নাম ছিল সে সেন এবং সে তান। মাওয়ের মা ছিলেন শিয়াং শিয়াং জেলার তং শিয়াতো গ্রামের বেন পরিবারের মেয়ে। তিনি ছিলেন দয়ালু। বৌদ্ধ ধর্মে তার খুব ভক্তি ছিল।
মাওয়ের বয়স যখন মাত্র সাত তখন থেকে খেতখামারের কাজে লেগে যান। ১৯০১ সালে আট বছর বয়সে মাও গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। এবং তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ঐ পাঠশালাতে লেখাপড়া করেন। ১৯০৬ সালে মাওয়ের গ্রামের পড়াশোনা শেষ হয়। এরপর তার বাবা তাকে সৈন্যদলে ভর্তি করানোটাকে লাভজনক মনে করেন। তার আগে মাওয়ের সঙ্গে এগারো-বারো বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মাও সেতুং এর চার স্ত্রী আর তাদের মোট সন্তানের সংখ্যা ছিল ১০ জন।
মাও সেতুং ঐতিহাসিক লং মার্চের মাধ্যমে কৃষক-জনতাকে নেতৃত্ব দিয়ে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করেছিলেন। আফিমখোর, ঘুমন্ত চীনাদের জাগ্রত করে তিনি শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, চীনকে বিশ্বের সেরা শক্তিতে পরিণত করেন। পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম সফল কেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনকে এগিয়ে নেন।
এশিয়া ও বিশ্বের নানা দেশে মাওবাদী মতাদর্শে হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, জনতা সশস্ত্র পন্থায় লাল বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন। সাফল্য ও ব্যর্থতার নানামুখী আলোচনা ও সমালোচনার পরেও মাওবাদের একটি তাত্ত্বিক অবস্থান কমিউনিস্ট মতাদর্শের জগতে লক্ষ্য করা যায়।
মাও সেতুং এর মৃত্যুর ৪৩ বছরের মাথায় খোদ চীনেই বইছে নয়া হাওয়া। নানা সংস্কার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মিশ্র অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে সমাজতান্ত্রিক চীন। তথাপি ছোট লাল বইয়ের বড় নেতা মাও সেতুং জ্বলজ্বলে উপস্থিতিতে রয়েছেন চীনে এবং বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সমাজের মানুষের কাছে।