ইজতেমার আখেরি মোনাজাত পৌনে ১১টায়, আগামী বছর দুই পর্বে
টঙ্গী থেকে: তাবলিগ জামাতের আলমি শুরার নেতৃবৃন্দ ২০২০ সালের ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। ২০২০ সালে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব ১০ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হবে ১২ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় পর্ব ১৮ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হবে ২০ জানুয়ারি।
টঙ্গীর ইজতেমার ময়দানে রাতে আলমি শুরার নেতৃবৃন্দ বিশেষ মাশওয়ারায় (পরামর্শ) বসে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাশওয়ারায় বিশ্বের বিভিন্ন তাবলিগি মারকাজের মুরব্বিরা অংশ নেন। বৈঠকে ৫ দিনের জোড় ইজতেমার তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছে। চিল্লার সাথীদের নিয়ে ৫ দিনের বিশেষ জোড় ইজতেমা শুরু হবে ২৯ নভেম্বর শেষ হবে ৩ ডিসেম্বর।
অন্যদিকে আলমি শুরার তত্ত্বাবধানে আয়োজিত চলতি বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা পৌনে ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় বারের মতো আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন কাকরাইলের মুরব্বি ও তাবলিগ জামাতের শুরা সদস্য হাফেজ মাওলানা যুবায়ের।
ইজতেমার আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, শনিবার ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত অন্যান্য নফল আমল শেষে শুরু হবে বয়ান। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে মাওলানা খুরশিদ হেদায়াতি বয়ান করবেন। এর পর মাওলানা ইবরাহিম দেওলা বিশেষ নসিহত করবেন। এর পর আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
৫৪তম বিশ্ব ইজতেমায় বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষ, আলেম-উলামা ও তাবলিগি সাথীরা অংশ নিয়েছেন। স্থানীয়দের মতে এবারের মতো মানুষ বিগত কোনো ইজতেমায় অংশ নেয়নি। মানুষের উপস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই ইজতেমার কাজ শুরু করতে হয়েছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লিসহ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ শনিবার টঙ্গীতে আসবেন। এ জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা বেশ জোরদার করা হয়েছে।
শুক্রবার মধ্যরাত থেকে টঙ্গী ব্রিজ, কামারপাড়া ব্রিজ, ভোগড়া বাইপাস, মীরের বাজার এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে ইজতেমা সংলগ্ন এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ইজতেমা শেষে মুসল্লিদের বাড়ি ফেরার সময় এ ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকবে।
তাবলিগের সূচনা
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ভারতের প্রখ্যাত আলেমে হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি চারিত্রিকভাবে বিপর্যস্ত, শিক্ষাহীন, ধর্মকর্মহীন মুসলমানদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দিয়ে ঈমানি বলে জাগিয়ে তুলতে দিল্লির পার্শ্ববর্তী মেওয়াত অঞ্চলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিরমধ্যে প্রথম তবলিগের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ১৩৪৫ হিজরি সনে পবিত্র হজপালন করে দেশে ফিরে এসে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) যে তবলিগি কাজ শুরু করেন। তাবলিগ জামাতের মূল মারকাজ (হেডকোয়ার্টার) দিল্লির নিজামুদ্দিনে হলেও এর বার্ষিক সম্মেলনের (বিশ্ব ইজতেমা) স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করা হয়। চল্লিশের দশকে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা ঢাকার রমনার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে তুরাগ নদীর তীরের বর্তমান স্থানটিতে বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে। পরে সরকারিভাবে তুরাগতীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
বিশ্ব ইজতেমায় দেশের লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। পবিত্র হজের পর তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমাকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সমাবেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ইজতেমার স্থান ও আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। এ উপলক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে মুসলমানদের বাংলাদেশে আগমন ঘটে এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে বিশ্বমুসলিমের পরিচয় ও ভাববিনিময়ের একটি সম্মিলন ও যোগসূত্র ঘটে।
মুসলমান জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশকে ইসলামের বিশ্বাস ও আক্বিদায় সমৃদ্ধ ও বাস্তব অনুশীলনে অভ্যস্থ করা না গেলে মানব সমাজে ইসলাম সম্মত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকে মাওলানা ইলিয়াস তাবলিগ জামাতের সূত্রপাত করেছিলেন। বস্তুত কোরআনে কারিমের নির্দেশনা, রাসূলের শিক্ষা এবং পীর-মাশায়েখদের দেখানো পথে ইসলামের শিক্ষাকে সমাজে ও রাষ্ট্রের সবর্ত্র ছড়িয়ে দেওয়াই তাবলিগের মূল লক্ষ্য।
বয়ান হয় ২৪ ভাষায়
ইজতোমর শেষদিন আখেরি মোনাজাতের আগে দেওয়া বয়ানকে হেদায়েতি বয়ান বলা হয়। ওই বয়ানে তাবলিগের লক্ষ্য তুলে ধরার পাশাপাশি আল্লাহতায়ালাকে রাজি-খুশির জন্য কোরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রত্যেক মুসলমানকে নীতি আদর্শ মেনে চলার কথা বলা হয়। বলা হয়, আলেম-উলামাদের থেকে দ্বীন শিখে সে অনুযায়ী চলার কথা। আমল অনুযায়ী জীবন গড়ার কথা।
বুধবার থেকে ইজতেমায় অংশ নিতে দেশের ৬৪টি জেলার তাবলিগ জামাতের সাথি, আলেম-উলামা ও মাদরাসার ছাত্ররা ময়দানে এসে নিজ নিজ জেলাওয়ারি খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। বিদেশি মেহমানরা অবস্থান করছেন টিন সেডে। এর পূর্ব পাশে স্থাপন করা হয়ে ইজতেমার মূল মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকেই তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিরা আরবি, উর্দু ও বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় বয়ান করেছেন। তবে মূল বয়ান করছেন উর্দু ভাষায় সেটা বাংলাসহ ২৪টি ভাষায়া অনুবাদ করে শুনানো হয়েছে।
হেলিকপ্টারে করে আল্লামা আহমদ শফি ইজতেমায় শরিক হলেন
ইজতেমার দ্বিতীয় দিন হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফি হেলিকপ্টারে করে এসে ইজতেমায় শরিক হয়েছেন। ইজতেমার মাঠে এসে তিনি জুমার নামাজে অংশ নেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছাখালী থেকে বেসরকারি হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় বিমান টঙ্গীর বাটা সু কারখানা এলাকার হেলিপ্যাডে নামেন। পরে সেখান থেকে আল্লামা শফিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম নিজ গাড়িতে করে ইজতেমায় ময়দানে নির্দিষ্ট কামড়ায় পৌঁছে দেন। শনিবার আখেরি মোনজাত শেষে ফের হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে ফিরবেন তিনি।
শুক্রবারের বয়ান
শুক্রবার ইজতেমার মাঠের বয়ানে বলা হয়, ‘পৃথিবীতে ঈমানের মূল্য অনেক বেশি। ঈমানকে মজবুত করতে হলে দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে বেশি। মানুষ যেন আল্লাহতায়ালার হুকুমমতো সারাজীবন চলতে পারে সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দ্বীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। নিজের আমল দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা.) যে কাজে খুশি হন তা আমাদের বেশি বেশি করতে হবে। আমাদের সবার আখেরাতের চিরস্থায়ী জিন্দেগির জন্য আবাদ করতে হবে।’
নিরাপত্ত ব্যবস্থা ও যাতায়াত
মাঠের ১৭টি প্রবেশপথে আর্চওয়ে ও ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। আর ইজতেমায় আগতদের যাতায়াতের জন্য ১৩৮টি বিশেষ ট্রেন, ৪০০টি বিআরটিসি বাস, পর্যাপ্ত লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ইজতেমার ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ৯ হাজার পুলিশ, দুই শতাধিক র্যাব, ৩ শতাধিক আনসার, ৩ শতাধিক ফায়ার সার্ভিসকর্মী নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠে মোতায়েন রয়েছেন। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পুরো ইজতেমার মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদেশি মুসল্লি
পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমায় আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, চাদ, জিবুতি, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের প্রায় তিন হাজারের বেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন।