ইজতেমায় লাখো কণ্ঠের ফরিয়াদ, আমিন... আল্লাহুম্মা আমিন

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইজতেমা মঞ্চে মাওলানা ইবরাহিম দেওলা ও মাওলানা যোবায়ের

ইজতেমা মঞ্চে মাওলানা ইবরাহিম দেওলা ও মাওলানা যোবায়ের

বিশ্ব ইজতেমা ময়দান (টঙ্গী, গাজীপুর) থেকে: আলমি শুরার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ইজতেমার ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো বাংলাদেশি শীর্ষ আলেম মোনাজাত পরিচালনা করলেন। এর আগে গত বছরের ইজতেমায় মাওলানা যোবায়ের প্রথমবারের মতো মোনাজাত করেন। ইজতেমার শুরু থেকেই দিল্লি নিজামুদ্দিনের মুরব্বিরা আখেরি মোনাজাত পরিচলানা করে আসছিলেন।

শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১০টা ৪৩ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল মসজিদের খতিব, কাকরাইলের মুরব্বি ও বিশ্ব তাবলিগের শুরা সদস্য হাফেজ মাওলানা যোবায়ের।

বিজ্ঞাপন

আরবি-বাংলায় মোনাজাত

মোনাজাতের আগে বিভিন্ন মেয়াদে তাবলিগের জন্য বের হওয়া সাথীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ দিক-নির্দেশনা তথা হেদায়েতি বয়ান করেন ভারতের রায়বেন্ড মারকাজের মুরব্বি মাওলানা খুরশেদ আলম। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন মাওলানা আবদুল মতিন। এরপর ভারতের শীর্ষ তাবলিগি মুরব্বি ও বিশ্ব তাবলিগের শুরা সদস্য মাওলানা ইবরাহিম দেওলা দোয়া ও মোনাজাতের তাৎপর্য নিয়ে সংক্ষেপে বয়ান করেন। এর পর শুরু হয় আখেরি মোনাজাত।

বিজ্ঞাপন

বেলা ১০টা ৪৩ মিনিটে শুরু হওয়া মোনাজাত ১১টা ৬ মিনিটে শেষ হয়। ২৩ মিনিট স্থায়ী আখেরি মোনাজাতের প্রথম ১০ মিনিট আরবিতে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, নবী করিম (সা.)-এর ওপর দরুদ শরিফ, কোরআনে কারিমে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া সম্বলিত আয়াত এবং হাদিসে উল্লেখিত দোয়া ফজিলতপূর্ণ দোয়াগুলো পাঠ করেন মাওলানা যোবায়ের। তিনি আরবি ও বাংলা ভাষায় মোনাজাত পরিচালনা করেন।

 চারদিকে শুধু কান্নার আওয়াজ

আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গোনাহমাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজতের জন্য দু’হাত তুলে আল্লাহতায়ালার দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে পুরো টঙ্গী এলাকা। নানা বয়সি মানুষের কান্নার ধ্বনিতে তুরাগ তীরের আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলে। বিশাল জনসমুদ্রে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা, শুধু শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। কান্নায় বুক ভাসান তারা। মুঠোফোন ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের আরও লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। দোয়া কবুলের ফরিয়াদের জন্য লাখ লাখ মানুষ সমস্বরে বুকফাঁটা কান্নার আর্তনাদ করে আল্লাহুম্মা আমিন, আমিন ইয়া রাব্বাল আলামীন বলে কাঁদতে থাকেন। হালকা বৃষ্টির ফোঁটা কান্নার আবেগকে আরও বাড়িয়ে দেয়, পুরো এলাকায় তৈরি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।

মোনাজাতে দেশ-বিদেশের ৩০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত মাইকে স্বস্তি

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদফতর ও গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। এর মধ্যে গণযোগাযোগ অধিদফতর ইজতেমা ময়দান থেকে আবদুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেলস্টেশন, স্টেশন রোড থেকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগ দেওয়া হয়। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান ও অফিসসহ সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে এসব এলাকার কর্মজীবিদের মোনাজাতে অংশ নিতে কোনো সমস্যা হয়নি। তাবলিগি কর্তৃপক্ষের নিষেধ সত্ত্বে প্রচুর নারী মোনাজাতে অংশ নেন।

মোনাজাতে যা বলা হয়

আখেরি মোনাজাতে হাফেজ মাওলানা যোবায়ের বলেন, হে আল্লাহ! আমাদের ঈমানকে আরও মজবুত করে দিন। আমাদেরকে আপনার প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আমাদের জীবনের সব পাপ মাফ করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, আপনার কাছেই তো আমরা ক্ষমা চাইব। আমাদের ক্ষমা করুন। দ্বীনের ওপর চলা সহজ করে দিন। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করুন।

হে আল্লাহ! আমরা পাপীষ্ঠ, আমরা অপরাধী, আমরা ভুলে যাই, আমরা ভুল করি; অনুগ্রহ করে আমাদের সব গোনাহ আপনি ক্ষমা করে দিন। আমাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে কবরবাসী প্রত্যেক মুসলমানের গোনাহ মাফ করে দিন।

ও দয়াময় মাওলা! যে কাজের জন্য আপনি আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, যে দায়িত্ব দিয়েছেন-  আমরা সে সব থেকে অলস, গাফেল। মেহেরবানি করে আমাদের গাফলতির পর্দা উঠিয়ে দিন। আমাদের উদাসীনতা দূর করুন। আমাদের কাজের শক্তি দিন, অলসতা দূর করে দিন।

হে আল্লাহ! উম্মত আজ দাওয়াতের কাজ থেকে দূরে সরে গেছে, জাগতিক মোহ, নফসের পূজা আর প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আপনি সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। জাগতিক মোহ, নফসের পূজা আর প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে দূরে রেখে আমাদের মূল জিম্মাদারির সঙ্গে জুড়ে থাকার তওফিক দিন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঈমানে পরিপূর্ণতা দান করুন। আপনার সমুদয় নির্দেশ আপনার হাবিবের সুন্নতমতে পালন করার তওফিক দিন। রাত-দিন, সকাল-বিকাল, দেশে-বিদেশে, জলে-স্থলে যখন যেখানে আপনার যে হুকুম, তা সঠিকভাবে পালন করার তওফিক দিন।

হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান বাড়িয়ে দিন। ঈমানের দাওয়াতের কাজে ঘর থেকে বের হওয়ার তওফিক দিন। ঈমানের জন্য সাহাবায়ে কেরামের মতো যে কোনো ত্যাগ, কষ্ট ও ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য দান করুন।

হে আল্লাহ! আমাদের দূর্বল ঈমানকে আপনি শক্তিশালী করে দিন। দাওয়াতে তাবলিগের ওপর আপনি ঈমানের মজবুতি রেখেছেন- এ কথা সবাইকে বুঝার ও মানার তওফিক দিন। সুন্নতমতে জীবন গড়ার তওফিক দিন। সুন্নতের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার তওফিক দান করুন। বিদয়াত থেকে আমাদেরকে দূরে রাখুন। সুন্নত ও বিদয়াতকে চেনার ও পার্থক্য করার বিবেচনাবোধ দান করুন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে দ্বীনের ওপর অটল, অনড় ও অবিচল থাকার যোগ্যতা দিন। হে আল্লাহ! আমরা মুহতাজ, আপনি বে নায়াজ। আমরা পাপী, আপনি ক্ষমাকারী। আমরা উদাসীন, আপনি আমাদের সতর্ক থাকার তওফিক দিন। নামাজের পাবন্দি করার তওফিক দান করুন। জিন্দা নামাজ আদায় করার তওফিক দান করুন। নামাজে খুশ-খুজু দান করুন। জামাতের সঙ্গে তাকবিরে উলার সঙ্গে নামাজ পড়ার তওফিক দিন। আমাদের সব আমল কবুল করুন। ইখলাস দান করুন। অলসতা, বিলাসিতা ও লৌকিকতা থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন।

হে আল্লাহ! সকল বাঁধা ও সমস্যা দূর করে দিন। সবার ভেতর দ্বীনের ফিকির দান করুন। ঐক্যবদ্ধ থাকার তওফিক দিন। আমাদের বিভেদকে মিটিয়ে দিন। আমাদেরকে মনে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে হেফাজতে রাখুন।

হে আল্লাহ! পৃথিবীর সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আপনি কবুল করুন। সব মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও জামাতকে আপনি কবুল করুন। আলেমদের নেক হায়াত দান করুন। সবাইকে ইখলাসের সঙ্গে দ্বীনের কাজে লেগে থাকার তওফিক দান করুন।

হে আল্লাহ! যে সব জামাত আপনার রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের আপনি জিম্মাদার হয়ে যান। সকল প্রকার বাধা দূর করে আপনি তাদের সাহায্য করুন। আর যারা আপনার রাস্তায় এখনও বের হতে পারেনি তাদেরকে দ্রুত আপনার রাস্তায় বের হওয়ার তওফিক দান করুন।

হে আল্লাহ! যারা অসুস্থ তাদেরকে সুস্থতা দান করুন। যারা বিভিন্ন সমস্যায় তাদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে দিন। যারা ঋণগ্রস্ত তাদের ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিন। যারা নিযার্তিত তাদের সহায়তা করুন। বেকারদের হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দিন। বিবাহযোগ্যদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন। যারা বিভিন্ন বৈধ বাসনা নিয়ে মোনাজাতে শরিক হয়েছে তাদের সেসব বাসনাগুলোকে আপনি কবুল করুন।

ইয়া আল্লাহ! মেহেরবানি করে আমাদের মোনাজাতকে কবুল করুন। যেভাবে আপনার কাছে চাওয়া দরকার- আমরা সেভাবে চাইতে পারিনি। কিন্তু আপনি অন্তযার্মী, আপনি সবার মনের কথা জানেন- সেটাকেই আপনি কবুল করে নেন।

হে আল্লাহ! এই ইজতেমাকে কবুল করুন। যারা ইজতেমার জন্য মেহনত করেছে তাদেরকে কবুল করুন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।

মাওলানা সাদ অনুসারীরা মাঠে আসবেন রোববার থেকে

আখেরি মোনাজাত শেষে শনিবার মধ্যরাতের আগে আলমি শুরার অনুসারী তাবলিগের সাথীরা ইজতেমার ময়দান মাঠ ত্যাগ করবেন, মাঠ বুঝিয়ে দেওয়া হবে প্রশাসনের কাছে। পরে প্রশাসন মাওলানা সাদের অনুসারী অনুসারীদে ইঞ্জিনিয়ার ওয়াসিফুল ইসরামের অনুসারীদের কাছে ইজতেমার ময়দান বুঝিয়ে দেবেন। তারা রোববার (১৭) বাদ ফজর থেকে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করবেন। সোমবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা।