সেই মাসুদ এখন ব্যস্ত হাজিদের খেদমতে

  • জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল কালাম মো: মাসুদ। ছবি: বার্তা২৪

আবুল কালাম মো: মাসুদ। ছবি: বার্তা২৪

মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: একটা সময় পথে পথে ঘুরে হাজিদের হোটেলে তুলে দিতেন নোয়াখালীর আবুল কালাম মো: মাসুদ (৪৬)। বিনিময়ে পেতেন ১০ থেকে ২০ টাকা। সেই মানুষটি এখন পবিত্র মক্কা নগরীর ২৫ টি হোটেলের অংশীদার।

এসব হোটেলে থাকা দেশ- বিদেশের ১৫ হাজার হাজির যাতায়াত, থাকা খাওয়াসহ সকল সুযোগ সুবিধা পরিচালিত হয় তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠিত দুটি কোম্পানির অধীনে।

বিজ্ঞাপন

চেষ্টা আর পরিশ্রম করলে যে জীবনে কেবল সফলতাই নয়, বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, তার জলন্ত উদাহরণ মাসুদ। এখন তার অধীনেই সৌদিতে কাজ করে ২০০ অধিক বাংলাদেশি।

হোটেল ব্যবসার সুবাদে দেশে-বিদেশে এখন অনেকেই চেনে মাসুদকে। যেমন নেপাল,মালদ্বীপ,মরিশাস থেকে আসা সকল হাজিদের সেবার ভার মাসুদের কোম্পানির। আর দেশ থেকে আসা মন্ত্রী থেকে শুরু করে ভিভিআইপি অনেকেই নাম মাসুদের ঠোঁটের ডগায়।

বিজ্ঞাপন

মাসুদ বলেন, এটা আমার অর্জন। আমি ব্যবসা করি যতটা না তার চেয়ে হাজিদের জন্য খেদমত করি বেশি। যে কারণে সাধারণ মানুষ থেকে ভিভিআইপি হাজিদের অনেকেই আমাকে পছন্দ করেন।

যেমন ধরুন, এ বার রাজশাহী থেকে আসা একজন হাজি সাহেব আমার জন্যে এক মন আম নিয়ে এসেছেন। এটা কিন্তু কেনা যাবে না।এটার মূল্য পরিশোধও করা যাবে না। মানুষ আমাকে ভালোবাসে- এটাই দিন শেষে আমার প্রাপ্তি "- বলেন তিনি।

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার ছয়আনি গ্রামের সন্তান আবুল কালাম মো: মাসুদ। ভাগ্য অন্বেষণে ১৯৯০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাড়ি দেন মধ্য প্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে।

বাবা মো: রফিক উল্লাহ চেয়ারম্যান। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে মাসুদ দ্বিতীয়। এ দেশে এসেছিলেন ফ্রি ভিসায়। ফ্রি ভিসা হচ্ছে স্বাধীনভাবে যে কোন কাজ করার সুযোগ। আড়াই মাসের মতো বিন লাদের কোম্পানিতে কাজ করেছেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে।

শেষের ১৫ দিন কাজ করেছেন পবিত্র কাবাঘর সংলগ্ন মসজিদ আল হারামের সম্প্রসারণ প্রকল্পে।

এই কাজের পাশাপাশি মক্বায় আসা দেশী-বিদেশী হাজীদের হোটেল খুঁজে দিতেন। বিনিময়ে হাজীরাও ১০ /২০ রিয়েল বখশিস দিতেন। পাশাপাশি হোটেল মালিকরাও কমিশন হিসেবে কিছু অর্থ দিতেন।

"কোন কোন দিন এভাবে ১ হাজার রিয়ালও পেতাম। আর ৫‘শ রিয়াল কামাই না হলে ঘরেই ফিরতাম না"- অতীতের সংগ্রামের দিনগুলোতে ফিরে যান মাসুদ।

" মনে হলো এভাবে হাজী টোকানোর ( সংগ্রহ) কাজ না করে নিজেই হোটেল ব্যবসা করলে কেমন হয়! টাকা জমানো শুরু হলো। একজনকে সঙ্গে নিয়ে ৩৫ হাজার রিয়াল চুক্তিতে একটি বাড়ি ভাড়া নিলাম। অগ্রীম দিলাম ২০ হাজার রিয়াল। সেখান থেকে লাভ হলো ৪৫ হাজার রিয়াল।

এখানকার হিসেবে ডলার প্রতি সাড়ে ২২ টাকা হিসেবে ১০ লাখ টাকা। তখন অবশ্য টাকার দাম ছিলো আরো বেশি।

তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এভাবে ব্যবসা বাড়তে থাকায় অংশীদার নিয়ে নিজেই দেশে খুলে ফেলেন খেদমত ট্রাভেল লি: নামের হজ এজেন্সি।

প্রথম বছর লোকশান হলেও সমস্যা হয়নি। কারণ লাভটা হয়েছে পরকালের। হাজীদের যেভাবে সেবা দিয়েছি,তাদের সন্তুষ্টিই ছিলো আসল মুনাফা। পরের দু'বছর এ ব্যবসাটাও দাঁড়িয়ে যায়।

আসলে দেশে এসব ব্যবসার লাভ ক্ষতির অতীতে হিসেব নেয়াও হয় না। কারণ এখানকার ব্যবসা পরিচালনাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। এবারের হজ মওসুমে বাংলাদেশ হজ মিশনকেও তিনটি বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন মাসুদ।

মাসুদের এ সাফল্যের পেছনে একদিকে যেমন রয়েছে টিকে থাকার সংগ্রাম।অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রম।

"যেমন আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার নিয়োগ কর্তা ( কফিল) মুসাত সাদ আল মাসউদী একদিন আমাকে নিয়ে গেলো জেদ্দা এয়ারপোর্টে। জানালো, একজনকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে আমাকে সঙ্গে নিয়েছে সে। তবে হঠাৎ করেই আমার মনে জানান দিলো যে, সে আমাকে দেশে পাঠানোর চূড়ান্ত বন্দোবস্ত করেছেন। বিষয়টি টের পেয়েই আমি টয়লেটে যাবার কথা বলে পালিয়ে আসি।

তারপর মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেও মানুষের ভালোবাসা আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এক পর্যায়ে আমার কাছে সেই নিয়োগকর্তা ক্ষমাও চান।জীবন আর মানুষের জটিলতা তখন থেকেই চেনা- বলেন মাসুদ।

হামজা রশীদ আহমদ আমীর নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন নিয়োগ কর্তার অধীনে পরে এ দেশেই ডারকুম হোটেল ও মাশারাত কিংডম হোটেল নামে পৃথক দুটি কোম্পানি খুলে সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন দুশয়ের বেশি বাংলাদেশীকে।

এ ছাড়াও বিন আমীর কেটারিং ও হোটেল নামে পৃথক আরেকটি কোম্পানি খুলেছেন তিনি।

দেশেও জমি কিনেছেন।লালমাটিয়ায় দুটিসহ রাজধানীতে চারটি বহুতল বাড়ি ছাড়াও দেশে বিভিন্ন সেক্টরে তার রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ।

এ বছর মাসুদের হজ এজেন্সির অধীনে দেশ থেকে ৮০ জন নারীসহ ২২৩ জন হাজি এসেছেন মক্কায়। তাদের পেছনেই দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন মাসুদ।

কে কখন কাবাঘর তাওয়াফ করতে যাবে। কখন গাড়ি আসবে। কার লাগেজ এখনো হাতে পৌঁছেনি,কার কি খাবার পছন্দ, এর বাইরে হাজিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেও  ক্লান্ত বোধ করেন না তিনি।

এত ব্যবসা ছেড়ে এখানে কেন?

আমার প্রতিষ্ঠান থেকে হাজি সাহেবরা এসেছেন। তাদের একটু বাড়তি সুযোগ সুবিধা আর দেখভাল করার দায়িত্ব আমার। এভাবেই মানুষের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই- জানান আবুল কালাম মো: মাসুদ।