‘দিবস লইয়া থাকলে চুলায় আগুন জ্বলত না’
তীব্র গরমের মধ্যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন রিকশাচালক চাঁন মিয়া (৬০)। প্রতিদিনকার মতো উপার্জনের জন্য সকাল থেকে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলছেন তিনি। কপালের বলিরেখাই বলে দিচ্ছে এই বয়সেও কেমন হাড়-খাটুনি পরিশ্রম করেন তিনি। রোদ-বৃষ্টি যেন তার গা সওয়া। চাঁন মিয়ার জানা নেই মে দিবসের প্রতিপাদ্য কিংবা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস।
ফুলপুর থেকে আসা এ রিকশাচালক বলেন, ‘কাম কইরাই আমার অধিকার আদায় কইতে অইবো। কাম না করলে দিবস দিয়া আহারের ব্যবস্থা অইতো না। দিবস লইয়া থাকলে ঘরের চুলায় আগুন জ্বলত না। সকাল থেইক্কা সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালাইয়া যা টেহা অইবো, ওইটা দিয়া বাজার-সদাই কইরা বাড়িত যামু।’
প্রখর রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নগরীর চরপাড়া মোড়ে আখের শরবত বিক্রি করছেন শাহজাহান সাজু (৪৫)। তাকে মে দিবসের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘এসব দিবস টিবস পালন কইরা আমগর তো কোনো লাভ নাই। মে দিবসে নাকি নিজেগো অধিকার আদায়ের লেইজ্ঞা শ্রমিকরা প্রাণ দিছিলো। কিন্তু তাতে কি শ্রমিকগর ভাগ্য বদলাইছে? আমগর দু:খ-কষ্টে কেউ তো কখনো আহে না।’
বাসা-বাড়িতে কাজ করেন জামেলা খাতুন (৫০)। অন্য দিনের মতো আজও বাসায় সকালের কাজ সেরে ফিরছিলেন জামেলা। তিনি বলেন, ‘মাইনষের বাড়িত কাম করি। একদিন না গেলে তো গালাগালি শুরু অইয়া যাইব। আমরা বাঁচলেও কেউ দেহে না, মরলেও না। আমগর আবার দিবস!’ এটুকু বলেই হাঁটা শুরু করেন বস্তির দিকে।
বুধবার (১ মে) সকাল থেকে ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া, সানকিপাড়া, গাঙ্গিনারপাড় এলাকা ঘুরে কথা হচ্ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রমিকদের সঙ্গে। এ সময় তাদের সামনে দিয়েই মে দিবসের শোভাযাত্রায় অংশ নিতে অনেক শ্রমিক মাথায়-হাতে লাল ফিতা বেঁধে ট্রাক-অটোরিকশায় চেপে ছুটছিলেন। এ দৃশ্য মোটেও নাড়া দেয়নি রিকশাচালক চাঁন মিয়া, শরবত বিক্রেতা শাহজাহান সাজু কিংবা অন্যের বাসায় কাজ করা জামেলা খাতুনকে।
তাপদাহ মাথায় নিয়ে সদর উপজেলার বাদেকল্পা গ্রামে বোরো ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সুমন মিয়া, ফয়জুল, জবান আলীসহ আরও কয়েকজন। বিরতিহীনভাবে নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলছেন তারা।
বোরো ধান ঘরে তোলার সময় এখন, তাই পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ এলাকা থেকে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করতে এখানেই আছেন কদিন যাবত। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিনটি নিয়ে মোটেও অবগত নন তারা।
সুমন মিয়া বলছিলেন, ‘আমরা অইলাম চুক্তি কামলা। কামই আমরার ধর্ম, কামই আমরার জ্ঞান। কাম কইরা খাইতে অইবো, বউ-পোলাপানরে খাওয়াইতে অইব। হে লেইজ্ঞাই তো এত দূরাত আইয়া ধান কাটতাছি। কাম শেষ করলেই টেহা পামু, তাড়াতাড়ি বাড়িত যামু। দিবস লইয়া বইয়া থাকলেই হইব মিয়া?’ কথাগুলো বলেই হি হি করে হেসে উঠেন সুমন।
হাসির রোলের মধ্যে তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছিলেন জবান। বলেন, ‘ভাই, দিবস বুইজ্জা কাম নাই। আমরা বুঝি পেট চলব কিনা বা কি করলে পেট চলব। গরীবের কোনো দিবস নাই। সব দিনই সমান।’ কথা শেষ করেই ফের মন দিলেন কাজে।