তুমলিং-সান্দাকফু-ফালুট অংশ
মেঘের ভেলায় ভেসে সান্দাকফু-ফালুট: পর্ব ২
ভোরের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশাবাদ দিয়ে নিয়ে বিছানায় গিয়েছিলাম। গাইড সুভাষকে বলে রেখেছিলাম ভোরে জাগিয়ে দিতে। সুভাষ জাগাবার আগেই আমারা জেগে উঠলাম ভোরের প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবো বলে। সময় নষ্ট না করে বিছানা ছেড়ে চটজলদি ভারী শীতের কাপড় গায়ে জড়িয়ে বাহিরে বের হলাম।
ভোর পৌনে ৫টা, আস্তে আস্তে পুব আকাশে আলো ফুটছে আর কনকনে শীতে বাহিরে দাঁড়িয়ে আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি যে একটা উজ্জ্বলতম মেঘমুক্ত সূর্যোদয় দেখবো বলে। আগে থেকেই ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে গিয়েছিলাম, তাতে মেঘ এবং বৃষ্টির আভাস ছিলো আমাদের ট্রেকের সময়। উপরন্তু যাবার সময় সাইক্লোন ফনীর খবর সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপরও ভাগ্য ভালো বলতে হতে মেঘমুক্ত আকাশেই আলো ছড়িয়ে পরতে শুরু করলো, আস্তে আস্তে হিমালয় হাসতে শুরু করলো। এমন সময় সেই ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ জুটিও যোগদান করলো আমাদের সাথে। ভাগ্য বেশিক্ষণ সুপ্রসন্ন থাকলো না, দেখতে লাগলাম দুপাশ হতে দুটো মেঘের ফালি আসতে আসতে স্লিপিং বুদ্ধকে গ্রাস করছে।
হিমালয়ের কয়েকটি পিক মিলে একটি শায়িত মানুষের অবয়বের মতো দেখায় বলে এই অংশটুকুকে স্লিপিং বুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। পুরোপুরি আলো ফোটার আগেই স্লিপিং বুদ্ধ ঢেকে গেল মেঘের চাদরে। হিমালয়ন রেঞ্জের ভাল ভিউ পাওয়া যায় অক্টোবর-নভেম্বরে, মার্চ-এপ্রিলেও পাওয়া তা কালেভদ্রে। হিমালয় আগেও দেখেছি, তাই এটা নিয়ে তেমন মনে কষ্ট রইলো না, তাছাড়া হিমালয়ান শৃঙ্গ খুব ভালোভাবে দেখা যাবেনা এটা ধরে নিয়েই আমরা রওনা দিয়েছিলাম।
সকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ তুমলিং পর্ব শেষ করে ঝকঝকে পাকা সড়ক ধরে আমরা যাত্রা শুরু করলাম সান্দাকফুর পথে। পথে গইরিবাসে নাস্তা করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তুমলিং ছাড়াতেই সামান্য চড়াই, খালি পেটে সকাল সকাল উপড়ে উঠতেই হাফ ধরে গেল! সামান্য যেতেই সিঙ্গালিলা উদ্যানের প্রবেশদ্বার, আমরা সিঙ্গালিলা উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ না করে বা দিকের রাফ রোড ধরলাম। রাস্তাটা নেপালের মধ্য দিয়ে চলে গেছে, আসলে সান্দাকফু পর্যন্ত ট্রেকের অনেকটা অংশ নেপালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
কিছুদুর যাবার পর নেপালের একটা চেকপোস্ট পড়লো সেখানে এন্ট্রি করে এগিয়ে যেতেই নেপালের ছোট্ট গ্রাম যোবাড়ী পড়লো। সেখানে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে আবার পা চালালাম। গ্রাম পেরোতেই রাস্তা নিচের দিকে যেতে থাকলো, বেশ খারাপ রাস্তা হলেও ল্যান্ডস্কেপ কিন্তু অসাধারণ। চোখ জুড়ানো ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে আমরা চললাম গইরিবাসের উদ্দেশ্যে।
তুমলিং থেকে গইরিবাসের এর দুরত্ব ৭ কিমি। গইরিবাসের উচ্চতা ৮৬০০ ফিট এবং এখানেও রাস্তাটাই ভারত-নেপাল সীমান্ত। আমরা সেখানে পৌঁছে রাস্তার বা পাশের ম্যাগ্নোলিয়া লজে বসে নাস্তার অর্ডার করে দিলাম। এতটা পথ হাঁটার কারনে আর সূর্যতাপ এর কারনে গরম অনুভূত হল। তাই গায়ে জড়ানো কমানো শুরু করলাম। গায়ে দুটো জ্যাকেট ছিলো, খুলতেই দেখি ভিতরের টিশার্ট টি ভিজে একাকার। সেকেন্ড জ্যাকেটটাও খানিকটা ভিজে উঠেছে। জ্যাকেটটি রোদে শুকাতে দিয়ে নিজেও দাঁড়িয়ে গেলাম টি শার্ট শুকাতে। সিনথেটিক টিশার্ট হওয়াতে খুব অল্প সময়েই শুকিয়ে গেল। এধরনের ট্রেকে সিনথেটিকের পোশাক নেয়াই ভালো কারন সুতি পোশাক শুকাতে সময় বেশী নেয় এবং ঘামের গন্ধও বেশী হয়। গাইড আমাদের পাসপোর্ট গুলো রাস্তার অপর পার্শ্বের ভারতীয় এসএসবি ক্যাম্পে দেখিয়ে নিয়ে আসলো। সময় বাঁচানোর জন্য আমরা ভেজিটেবল মম আর সিন্ধ ডিম অর্ডার করেছিলাম, নেপালী দিদি ঝটপট অর্ডার সার্ভ করলো। খেতে খেতেই কোলকাতার একটা গ্রুপ এসে পৌঁছল, ওরা ল্যান্ড রোভার গাড়িতে করে এসেছে আর এসেই হল্লা শুরু করলো। আমরাও তাড়াতাড়ি শেষ কালিপোখরীর পথ ধরলাম। গইরিবাসের পরেই রাস্তাটা বেশ খাঁড়াভাবে উঠে গেছে, কিছুদূর উঠার পর দেখলাম ট্রাফিক জ্যাম! এই পাহাড়ে আবার জ্যাম কথা থেকে আসলো ভাবতে ভাবতে পরের বাক ঘুরতেই দেখি একটা ল্যান্ড রোভারের চাকার এক্সেল ভেঙ্গে গেছে এবং সেটার মেরামত চলছে। তাই দুইপারেই বেশ কয়েকটা গাড়ি আটকে গেছে। আসলে যেইরকম রাস্তা এতে এইসব বৃটিশ আমলের গাড়ীগুলো কেমনে চলে সেটাই একটা বিস্ময়। চড়াই শেষ হতেই একটা ভিউ পয়েন্ট আসলো সেখানে পাথরের উপরে দারিয়ে-বসে ত্যারাব্যাকা হয়ে নানা স্টাইলে ফটোসেশন করে আবার পা বারালাম। পথে পরিচিত হলাম এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির সাথে, লাগেজগুলো ঘোড়ায় চাপিয়ে তারা চলেছে পদব্রজে।
আরেকটু উপরে উঠতেই মেঘের কোলে রোদ হারিয়ে যেতে থাকলো, মাঝে মাঝে এত ঘন মেঘের মধ্য দিয়ে আমরা হেটে যেতে থাকলাম যে সামান্য দূরেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। এভাবে কখনও মেঘ কখনও রোদ, কখনও রুক্ষ পথ আবার কখনও রড্ডেন্ড্রন ফুলের শোভা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কালিপোখরী। নেপালী ভাষায় পোখরী অর্থ লেক আর কালী অর্থ কালো, কালিপোখরী নামটা এসেছে ওখানকার কালচে পানির লেকের থেকে।
কালিপোখরীর উচ্চতা ১০৪০০ ফিট, এই সিজনে সেখানে প্রায় সময়ই জোর হাওয়া বয়। লেকটাকে ভাল করে দেখে কয়েকটা ছবি তুলে রওনা হয়ে গেলাম সান্দাকফুর উদ্দেশ্য, পরবর্তী বিরতি চৌরি বাজারে লাঞ্চ করার জন্য। চৌরি নামটা আসলে এসেছে চমড়ি বা ইয়াক থেকে, বাজার বলা হলেও ছোট্ট একটা গ্রাম মাত্র কয়েকটা ঘর। গাইড কে আগেই পাঠিয়ে দিলাম কারণ এই পথে আপনি যেখানেই খাবার অর্ডার করুন না কেন সবাই ফ্রেশ রান্না করে দিবে। আগে কেউ রান্না করে রাখে না। আমরা হেলতে দুলতে ছবি তুলতে তুলতে সেই খাবার রেস্তোরায় গিয়ে পৌঁছলাম। যেতেই সুভাষ জিজ্ঞাসা করলো আমরা ইয়াকের মাংস খাবো কিনা, উত্তেজনায় সবাই হ্যাঁ বলে উঠলাম। যে পথে আন্ডাকারিই সবচেয়ে দামী খাবার সেখানে ইয়াকের মাংস!!! আমি বললাম, কই মাংস আগে দেখাও, আমাকে নিয়ে গেল দেখাতে। মাংস দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ, রান্নাঘরের এক কর্নারে ছাদের বাঁশের সাথে কয়েকটি ইয়াকের হাড্ডী দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর তার শেষ মাথায় খুবই সামান্য কালচে রঙের মাংস তার অবস্থান জানান দিচ্ছে। মাংস না বলে মাংসের শুঁটকি বলাই আসলে যুক্তিযুক্ত। ট্রাভেলার মনির ভাইকে ডাকলাম, তার চেহারা দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়ে সুভাষকে বললাম আমাদের মাফ করো। ধোঁয়াওঠা গরম ভাত, সবজি আর আন্ডাকারি দিয়ে পেটপুজা করে রওনা হলাম কাঙ্ক্ষিত সান্দাকফুর পথে। কালিপোখরী থেকে সান্দাকফুর দুরত্ব ৬ কিমি যার শেষ ৩ কিমি বেশ খাঁড়া। সান্দাকফু যতই কাছে যেতে লাগলাম ততই রোমাঞ্চিত হতে থাকলাম। মাঝে মাঝে ঘন মেঘ আমাদের ঢেকে দিচ্ছিল। পুরোটা পথেই সোঁ সোঁ শব্দ করে বেশ জোর হাওয়া বইছিলো। একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করলাম, মেঘগুলো পাইন গাছে আটকে যাচ্ছে আর পানি হয়ে গাছ বেয়ে নিচে নেমে আসছে। কোথাও কোথাও রাস্তা বেশ কর্দমাক্ত হয়েছে পাইন গাছে আটকে বেয়ে গলে পরা এই সব পানির কারনে।
আমাদের দেশের বান্দরবনেও অনেক মেঘ দেখেছি আমরা কিন্তু মেঘ যত ঘনই হোক না কেন এভাবে কোন গাছের পাতাও আটকে পানি হয়ে ঝরতে দেখিনি। আরেকটা পার্থক্য লক্ষ্য করলাম আমাদের দেশের মেঘের গতি খুব বেশ না হলেও হিমালয়ান রেঞ্জে মেঘ যেন চঞ্চলা হরিণ। সান্দাকফু দূরে থাকতেই গাইডকে ছেড়ে দিলাম জিটিএ ট্রেকার্স হাটে আমাদের রুম ঠিক করার জন্য। ট্রেকের সময় আমাদের ক্রস করে অনেকগুলো ল্যান্ড রোভার গাড়ি গিয়েছে সান্দাকফুর দিকে সেই হিসেবে টুরিস্টদের একটু চাপ থাকার কথা। যাইহোক সন্ধ্যার সামান্য আগে আমরা সান্দাকফু পৌঁছে গেলাম, সুভাষ আমাদের মনোনীত জিটিএ-তেই রুম পেয়েছে। একটাই রুম খালি ছিলো, বাকীগুলো বুক হয়ে আছে বেশ কয়েকদিন থেকেই। কোলকাতার কয়েকটি পরিবার ২/৩ দিন থেকে অবস্থান করছেন সান্দাকফু থেকে সূর্যোদয় দেখবে বলে।
সান্দাকফুর উচ্চতা ১১৯২৯ ফুট এবং উপরের দিকে সানরাইজ নামের একটা প্রাইভেট হোটেল আছে যেটা থেকে বেশ ভাল ভিউ পাওয়া যায় বিধায় এখন টুরিস্টরা সেখানেই বেশি থাকে। যাইহোক, রুমে ঢুকে কাপড় ছাড়তে ছাড়তেই হাওয়ার বেগ এমন বেড়ে গেলো যে শব্দ শুনে মনেহল আমরা কক্সবাজার বীচে বসে আছি। সেই সাথে ঠান্ডাটাও বেড়ে গেল, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এলাম। কনকনে ঠান্ডা পানি লাগাতেই আমাদের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো, গায়ে একটা গেঞ্জি আর একটা জ্যাকেট ছিলো তার উপর আরও একটা জ্যাকেট চড়াতে হলো। তাও কাঁপাকাঁপি কমছিল না অগত্যা ১ কম্বল ২ লেপের নিচে সাথে কান টুপি, হাত এবং পা মোজা। সামান্য পরেই কেয়ারটেকার নক করলো খাবার রেডি, কোন উপায় নাই খেতেই হবে কারণ এসব পাহাড়ে সন্ধ্যা ৭টাই ডিনার টাইম। ছোটবেলায় বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন নানাবাড়ি যেতাম তখন এরকম সন্ধ্যা হলেই ডিনার দিয়ে দিত আর সন্ধ্যা ৭-৮টা নাগাদ মোটামুটি পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আমার নানা বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো খুব করে। যাইহোক কাঁপতে কাঁপতে খেয়ে নিয়ে বিছানায় গেলাম, বাতাসের কারনে রুমের বড় বড় কাঁচের জানালাগুলো যেভাবে কাঁপছিল আর সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল যেন ভেঙ্গে না যায়। অনেক কষ্টে হাত পা গরম হলো এবং এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। এলার্ম ছাড়াই ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জেগে গেলাম, ঢাকায় অফিসে যাবার জন্য মোবাইলের এলার্ম ৩ বার চেঞ্জ করতে হয় আর এখানে কিছুই লাগলো না। বিছানা ছেড়ে কটেজ থেকে বেরতেই মন টা খারাপ হয়ে গেলো, ঘন মেঘ ছেয়ে আছে পুরো উপত্যাকা। যদিও জোর হাওয়া বইছে তবুও মন বলল কোনো চান্স নেই। মনির ভাইয়ের মন মানছিল না বললও চলেন ভিউ পয়েন্টে গিয়ে আরেকটু অপেক্ষা করি দেখি মেঘ সরে যেতেও পারে। আমি বল্লাল চলেন, গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম ফেরত যাই উনিও সায় দিল। ভোর সাড়ে ৬টাও ব্রেড-বাটার খেয়ে যাত্রা শুরু করলাম ফালুটের পথে, আজ আমরা হাটবো ২১ কিমি পথ। কোলকাতার সেই গ্রুপটিও বেরিয়ে পরলো আমাদের সাথে। ওরা গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে আর বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটেই যাবে। পথটা খুব ভালো করে চিনেনা বলে আমাদের সঙ্গী হতে চাইল, আমরা বললাম সমস্যা নেই ফলো করুন আমাদের। এই রুটে রাস্তার অনেকগুলো শাখা রাস্তা রয়েছে, ভুল করলে বেশ কয়েক ঘণ্টা বারতি হাঁটতে হবে। সন্ধ্যা নামার আগে ফালুট পৌঁছায় জরুরী। রাস্তায় অনেক যায়গায় রেড মার্ক দেয়া আছে ফালুট কে নির্দেশ করে, একটু দেখে চললে ভুল হবার সম্ভবনা নেই।
আমাদের ট্রেকের সবথেকে সুন্দর অংশ হলো এই ২১ কিমি পথ। ঘন পাইন বন, সবুজ ভ্যালী, নানান রঙয়ের বাহারি ফুল আর ভেসে বেড়ানো মেঘের দল আপনাকে শারীরিক কষ্ট অনুভব করতেই দিবেনা। আপনি ফুল ভালবাসলে মার্চ-এপ্রিল সিজনে এই ট্রেকে আসুন, কথা দিচ্ছি আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে আর হারিয়ে যাবেন দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসা ইয়াকের গলার ঘণ্টার শব্দের ছন্দে।
এই পথে অনেকে গাড়িতেও যায় তবে আমি বলবো প্রান হাতে নিয়ে যেধরনের কষ্ট সয়ে যেতে হবে তাতে করে না যাওয়াই ভাল। রাস্তা মাঝে মাঝে অসম্ভব ভাঙ্গাচুরা, জীপের সিট ধরে বসে থাকতে থাকতে আর ঝাকি খেতে খেতে আপনার হাড্ডি মাংস এক হয়ে যাবে।
সান্দাকফু ছাড়াতেই পথ চলে যাবে পাইন বনের মধ্য দিয়ে, আর পথে পথে রডডেন্ড্রন, ম্যাগ্নোলিয়া আরও নাম না জানা ফুল আপনাকে স্বাগত জানাবে। এমন পাগল করা রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে যেতে থাকলাম।
পাইনবন শেষ হতেই সেই ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ জুটি আমাদের ধরে ফেলল। হাল্কা কথাবার্তা ফটোশেসন শেষে ওরা এগিয়ে গেল। আমাদের অত তারা নেই, আমরা পুরো প্রকৃতি কে উপভোগ করার চেষ্টা করি আমারে ট্রেকে। খানিকটা এগোতেই আমাদের রুট লালে লাল হয়ে গেল, যেদিকে চোখ যায় শুধু রডডেন্ড্রন ফুল আর ফুল। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, নয়ন ভরে দেখে মাথায় গেঁথে নিলাম এই সৌন্দর্য কে। ফুলেল শুভেচ্ছার পর শুরু হলো সবুজ গালিচা, যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। চিত্রের পর এমন সবুজ আর চোখে পড়েনি। প্রতিটা পাহাড় চুড়াই সবুজ ঘাসে ঢাকা, দেখলেই নয়ন জুড়িয়ে যায়।
কয়েকটা চূড়া পেরোতেই একটা যায়গায় কিছু অস্থায়ী স্থাপনা দেখে গাইড কে জিজ্ঞাসা করলাম সেখানে কি, এমন জনমানবহীন যায়গায় কি হতে পারে? গাইড বল্লো ইয়াক ফেস্টিভ্যাল, প্রতি বছর নেপালী নববর্ষে অনুষ্ঠিত। আমাদের মতো নেপালেও ১৪ এপ্রিল বছরের প্রথম দিন। দূর দূরান্ত থেকে সবাই ইয়াক নিয়ে সেখানে হাজির হয় বছরের প্রথম দিনে। ভারত, নেপাল, ভুটান ছাড়াও বেশ কিছু ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান টুরিস্টও নাকি আসে এই ফেস্টিভ্যাল দেখতে। আরও কিছুদুর যেতে এক পাহাড়ের চূড়ায় একটা বাড়ি তৈরি হতে দেখে গাইড কে জিজ্ঞাসা করলাম মানুষ এখানে থাকে কি কিরে, বাজার কোথায় করে, জীবন চলে কিভাবে? আমরা নেপালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, গাইড বললো এখান থেকে ৫-৬ ঘণ্টা হাঁটলে একটা বাজার আছে ওরা ওখানে থেকে রসদ কিনে আনে আর বেঁচে থাকার জন্য ওরা ইয়াক পালন করে। একেকটা ইয়াকের দাম নাকি আড়াই তিন লাখ রুপি আর ইয়াকের দুধের পনির আর ঘী এর দাম এবং চাহিদা নাকি অনেক চড়া। আরও খানিকটা পথ যেতেই একটা ভারতীয় এসএসবি চেক পোষ্ট চোখে পড়লো, সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম আর বিস্কিট, খেজুর ও পানি খেলাম। এর মাঝেই সেখানে অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি এসে উপস্থিত হলো, আড্ডা চলল আরও কিছুক্ষণ। তারপর আবার পা বাড়ালাম, অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি আমাদের ছেড়ে ক্রমশ এগিয়ে গেলো। ওনাদের স্ট্যামিনা অনেক, এই বয়সে আমাদের দেশের কোনো মানুষের এরকম এক্সপিডিশন করতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।
দুচোখ দিয়ে অপার সৌন্দর্য গিলতে গিলতে আমরা সাবারগ্রাম পৌঁছে গেলাম, সেখানের সরকারি ট্রেকার্স হাটে নুডুলস আর বয়েল্ড আন্ডা অর্ডার করলাম। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর আমাদের লাঞ্চ সার্ভ করা হলো, গোগ্রাসে গিলে ফেললাম সব। খাবার শেষে জিজ্ঞাসা করলাম চা পাওয়া যাবে কি, বলল যাবে একটু অপেক্ষা করুন। হাটের বাহিরে চেয়ারে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চা চলে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১১৮০০ ফিট উচ্চতাইয় ইয়াকের দুধে তৈরি চা সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
চা খেয়েই পা চালালাম, আকাশটাও বুজে আসতে শুরু করলো। কপালে মনেহয় খারাপি আছে তাই পায়ে জোর লাগালাম। আগের রাতে রেডিওতে নাকি বলেছে আজ ভারী বর্ষণ হবে, সাইক্লোন ফনীর কারনে নাকি পশ্চিমবঙ্গে হাই এলার্ট জারি করা হয়েছে, বেশ কয়েকটি রুটে নাকি ট্রেন চলাচল বাতিল করা হয়েছে। বেশি দূর এগোতে পারলাম না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। হাঁটা বন্ধ হলোনা, পঞ্চো গায়ে চড়িয়ে হাঁটা অব্যাহত রাখলাম।
সন্ধ্যার বেশ খানিকক্ষণ আগে ফালুট পৌঁছে গেলাম। ফালুটে একটা মাত্র ট্রেকার্স হাট তাই আগে থেকে বুকিং দিয়ে না গেলে এখানে যায়গা পাওয়া বেশ কঠিন। যথারীতি গাইডকে আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম রুম ঠিক করার জন্য তাই রক্ষে। রুমে ঢুকে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হলাম। রাতে ডিনার টেবিলে অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ জুটির সাথে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হলো। অস্ট্রেলিয়ার সার্বিক অবস্থা, ফ্রান্সের ইয়েলো শার্টের তান্ডব, বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা কিছুই বাদ থাকলো না। রাত যত বাড়তে থাকলো বৃষ্টি তত বাড়তে থাকলো। দেশে থাকতেই প্লান করে গিয়েছিলাম ফালুট ভিউ পয়েন্টে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে এবং ফ্ল্যাগ ব্র্যান্ডেড টিশার্ট গায়ে দিয়ে কাঞ্চনজঙ্গাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একটা ছবি তুলবো। সেই ইচ্ছে কে পাথর চাপা দিয়ে আন্ডা কারি দিয়ে ভাত খেয়ে ১ কম্বল ২ লেপের নিচে চলে গেলাম। শুয়ে শুয়ে হাটের টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে থাকলাম, আর মনে মনে দোয়া করতে থাকলাম সকালে উঠে যেন ঝকঝকে আকাশ পাই। ফালুটের উচ্চতা ১১৮১১ ফিট আর এখান থেকেই হিমালয়ের সবচেয়ে ভাল ভিউ পাওয়া যায়। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ধারনাও করতে পারলাম না পরদিন আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে বা পরের দিনের সিঙ্গালিলা ফরেস্ট ট্রেকই হতে যাচ্ছে আমাদের ট্রেকের সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারাস অংশ।
আরও পড়ুন: মেঘের ভেলায় ভেসে সান্দাকফু-ফালুট
****আগামী পর্বে সমাপ্য