ফালুট-সিঙ্গালিলা ফরেশ্ত-গোর্খে-সামান্দিন-শ্রীখোলা-সেপি ট্রেক অংশ
মেঘের ভেলায় ভেসে সান্দাকফু-ফালুট: শেষ পর্ব
ফালুট পৌঁছার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল যা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই বাড়ছিল! সব মেঘ গলে পানি হয়ে ঝরে গিয়ে সকালে একটা ঝকঝকে সূর্যোদয় পাবো এই আশাবাদ নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। রাতে টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম, কিন্তু দেহঘড়ি ঠিকই সজাগ ছিল। ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম ভেঙে গেল, জেগে উঠে দেখি মনির ভাই আগেই জেগে গেছে। যে শব্দ গতরাতে অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি করেছিল সেই একই শব্দ চরম বিরক্তি এবং শঙ্কার সৃষ্টি করলো। হিমালয়ের শৃঙ্গ দেখা তো দূরের কথা, বৃষ্টি না কমলে যে আমাদের ফালুটেই বসে দিন কাঁটাতে সেটা ভাবতেই শঙ্কিত হয়ে গেলাম। জালানার পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আবারও বিছানাতে গা এলিয়ে দিলাম। আলো ফোঁটার বেশ পর বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হলাম। অঝোর ধারায় বৃষ্টি তখনও ঝরছে, অগত্যা নাস্তা সেরে সবার সঙ্গে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা। সাদা চামড়ার জুটিগুলো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে যাত্রা শুরুর সিদ্ধান্ত নিল। ওরা যেতে পারলে আমরা কেন বসে থাকবো, যে ভাবা সেই কাজ ৫ মিনিটে আমরাও রেডি হয়ে গেলাম। আমাদের দেখাদেখি কলকাতার আর সিকিমের গ্রুপ দুটোও যাবার তোরজোড় শুরু করে দিল। আজ আমাদের ১৬ কিমি ট্রেক করে গোর্খে গ্রামে যাবার কথা। পুরো ট্রেকটাই সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে হেঁটে নিচের দিকে নামতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরসীমানায় অবস্থিত সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি, আর সেই পর্বতশ্রেণি জুড়ে বিস্তৃত সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানে ওক, হেমলক, রূপালি দেবদারু, রূপালি ফার জাতীয় গাছ প্রভৃতি দেখা যায়। প্রাণীর ভিতরে দেখা যায় রেড পান্ডা, সোনালী বিড়াল, বনবিড়াল, কালো ভাল্লুক এবং অসংখ্য পাখী। আমাদের মধ্য একটা অন্যরকম উত্তেজনা ছিল আজকের এই ট্রেক কে ঘিরে, কিন্তু এমন বৃষ্টি সব মাটি করে দিল।
যাইহোক, ভারী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ট্রেকার্স হাট ছাড়লাম। ফালুট ছাড়ার আগে নিরাপত্তারক্ষী ক্যাম্পে গাইডকে রিপোর্ট করতেই হবে, সেটাই নিয়ম। ক্যাম্পের গেটে দাড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করা হলো, এই ভারী বৃষ্টিতে মামারা গেট ফেলে রেখে বিছানায় গা এলিয়েছে মনে হয়। অনেক ডাকাডাকি করেও যখন কাউকে পাওয়া গেল না তখন গাইড সিদ্ধান্ত নিল রিম্বিকে গিয়ে রিপোর্ট করবে।
আবার হণ্টন শুরু, যতই বনের ভিতর ঢুকছি ততই মনে মধ্যে একটু আধটু ভয় লাগতে শুরু করছে। মাথার উপর ভারী বৃষ্টি, পায়ের নিচে পাহাড় বেয়ে নামা চলমান পানির ধারা। কখনও কখনও সেই চলমান পানির ধারা বেশ জোরালো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পায়ের নিচে পাথর আছে আবার কোথাও শুধুই কাদামাটি। কোনো দিকে তাকানোর স্কোপ নেই কারন একটু অসাবধান হলে পা হড়কে বিপদ হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর বৃষ্টির প্রকোপ একটু কমে এলো, আমাদের পায়ের মাসলও একটু রিল্যাক্স করার সুযোগ পেল। বৃষ্টি কমে যেতেই সারা উদ্যান ঘন কুয়াশায় ভরে গিয়ে এক অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করলো, কেমন গা ছমছম করা পরিবেশ। মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোনো হলিউড ফিল্মের ক্যারেক্টার।
কখনও নিয়মিত চলার রাস্তা, কখনও শর্টকাট নিতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, কখনও প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদার মধ্য দিয়ে আবার কখনও হাচরে পাঁচরে বা গাছের লতা অথবা ঝুলেপরা বাঁশগাছ ধরে টারজানের মতো স্থান পরিবর্তন। ভেজা শরীর আর বৃষ্টির কারনে ছবি বা ভিডিও ধারন করার তেমন ইচ্ছেই হলোনা। খুব একটা কঠিন না হলেও পথটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল। ঘন জঙ্গল, পায়ের নিচে চল মান পানির ধারা, আবার কোথাও প্যাচপ্যাচে কাদা, কোথাও ঝরাপাতার কার্পেট বিছানো রাস্তা আবার কোথাও ভেঙ্গে পরা বিশাল গাছের নিচ দিলে অথবা ডিঙ্গিয়ে পথ চলা সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
চলার পথে বৃষ্টির কারণে সামান্য দু-একটা পাখি ছাড়া তেমন কিছুই আমাদের চোখে পরেনি, তবে একখানা জোঁক আমার গালে চুম্বন দিয়ে জঙ্গলে ট্রেক করার ষোলকলা পূর্ণ করে দিয়েছিল। গোর্খে যতই কাছে আসতে থাকলো আবহাওয়া ততই ভাল হতে লাগলো আর নামার পথটা আরও খাঁড়া হতে লাগলো। পাহাড়ে উঠতে আমার তেমন সমস্যা হয় না, অনেক সময় ধরে নিচে নামতে থাকার কারনে আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে ব্যথা অনুভুত হতে লাগলো। তাই আমার নামার গতি একটু কমে গিয়েছিল, সাথে মনির ভাইয়েরও তবে আমাদের কনিষ্ঠ সদস্য স্বাভাবিক গতিতেই নেমে যাচ্ছিল। চলতে চলতে একসময় পাহাড়ি ঝরনার শব্দ কানে আসলো, গাইড বলল আমরা গোর্খের একেবারে কাছে চলে এসেছি আর ওটা শব্দটা গোর্খে নদীর পানি বয়ে যাবার শব্দ। কিছুদুর যেতেই জঙ্গল শেষ হয়ে গোর্খে গ্রামটা দৃশ্যমান হল। লিখে বিশ্বাস করাতে পারবো না কিরকম সুন্দর গ্রাম। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচে নামা শুরু করলাম। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে অতি সাবধানে নামতে থাকলাম আর তাড়া করতে গিয়ে রুবেল ইতিমধ্যেই ৩ বার কুপোকাত হলে গেল।
ভাগ্য বেশ ভালই বলতে হবে রুবেলের, তেমন কোনো আঘাত পায়নি। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে আমরা নিচে নেমে আসলাম, হোম স্টে তে থাকার ব্যবস্থা হলো। রুমে ব্যাগ রেখে আন্ডাকারির আর সবজি অর্ডার করে বাহিরের অবিরাম ধারায় ফ্রেশ হতে গেলাম। বেশ সময় নিয়ে বুট আর কাপড় পরিস্কার করে রুমে ফিরে গোসল সেরে নিলাম। ততক্ষণে আমাদের লাঞ্চ রেডি, ঝটপট খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে গেলাম গ্রাম দেখতে, আসলে তর আর সইছিল না।
আমাদের হোম স্টের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে পাহাড়ি চপলা নদী, গ্রামে রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি আর সরকারি ট্রেকার্স হাট, প্রতিটা বাড়িতে রয়েছে নানান রঙের ফুলের বাগান। এমনিতেই পাহাড়ের বাড়িগুলো খুব সুন্দর হয় তার উপর ফুলবাগান বাড়িগুলোকে আরও সুন্দর করে তোলে। শুধু বাড়িগুলো নয়, গোর্খের রাস্তার পাশের ফুটে রয়েছে নানান রকম ফুল। আরও রয়েছে বুনো স্ট্রবেরি পেকে একেবারে লাল টুকটুকে হয়ে আছে, সাইজে অনেক ছোট তবে বেশ সুস্বাদু। আমরা পটাপট কিছু তুলে নিয়ে পেটে চালান করে দিলাম, মজা করে ছবিও তুললাম। গোর্খেতে নদীটাই সিকিম-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত। ছোট্ট পাহাড়ি নদীতে কাঠের সুন্দর একটা ব্রিজ, ব্রিজ পেরিয়ে সিকিম অংশে গিয়ে ঘাসের উপর অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। বসে বসে পাহাড়ি নদীর সৌন্দর্য আর পাহাড়ের ভাজে ভাজে সবুজের মাঝে সাদা মেঘের নৃত্য দেখতে লাগলাম। বেশ খানিকক্ষণ বসে থেকে উঠে পরলাম আর সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত আমরা ঘোরাঘুরি করলাম, গোর্খের উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফুট ঠান্ডা তেমন নেই খুবই মনোরম আবহাওয়া। সন্ধ্যার পর তো আর কোন কাজ নেই, ডিনারের ডাক পরল। এবার ডিনারে একটা স্পেশাল ডিম ভাজি রান্না করে খাওয়ালো রুবেল, ভালই লাগলো । ডিনার সেরে রুমে চলে গেলাম, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বহমান গোর্খে নদী বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে লাগলাম।
আজ এই প্রথম একটু বেলা করে বিছানা ছাড়লাম কারন আমাদের তেমন তারা নেই আজ আর ট্রেক রুটটাও বেশ স্বস্তিদায়ক। নাস্তা সেরে সকাল ৮টার দিকে বেরিয়ে পরলাম, আজ হাঁটবো ২৩ কিমি। শুরুতেই খাড়া উঠতে হলো, একেবারে হাফ ধরে গেল। তবে সামান্য পরেই ঠিক হয়ে গেল, হবেই বা না কেন এমন সুন্দর পাইনবনের মধ্য দিয়ে গেলে সবাই শারীরিক কষ্ট ভুলে যাবে। কিলো এক যেতেই সামান্দিন ভিলেজ পৌঁছে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর গ্রাম সামান্দিন, একবারে ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন পাহাড়ি গ্রামের ছবি দেখি তেমন। সামান্দিনে স্কুল, খেলার মাঠ, ফসলের খেত, প্রার্থনালয় সবই আছে।
খানিকক্ষণ গ্রামটা দেখে, ছবি তুলে পা বাড়ালাম। আসলে মন চাইছিল না, মনে হচ্ছিলো আরও খানিকক্ষণ থেকে যাই কিন্তু যেতে হবে কারণ ট্রাকে আমরা সবসময়ই একটা টার্গেট নিয়ে হাঁটি। ক্যালকুলেশনের বাহিরে সময় নষ্ট করা যায় না। সামান্দিন শেষে আবারও পাইনবন, আরও কিছুদূর যেতে নানান রকমের গাছপালার দেখা পেলাম। নানান পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমরা চললাম শ্রীখোলার পথে। কিলো ২ যাবার পর থামলাম রাম্মামে, হোম স্টেতে চা এর অর্ডার করে বাহিরে চেয়ার পেতে বসলাম। ঝঁকঝঁকে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া, অপর পারে সিকিম। পাহাড়ের ভাজে ভাজে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি এবং স্তুপা। পাহাড় সারির এক মাথায় উঁকি দিচ্ছে সাদা ধবধবে হিমালয় শৃঙ্গ। এখান থেকে পুরো রেঞ্জ না দেখা গেলেও খানিকটা দেখা গেল। স্তুপা থেকে ভেসে আসা বৌদ্ধ ধর্মীয় সঙ্গীত শুনতে শুনতে গরম গরম চা পান করলাম, এরকম পরিবেশে চা পান করতে আমার অসম্ভব ভালো লাগে চায়ের স্বাদ যেমনই হোক না কেন! এই প্রথম মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল, সবাই যার যার বাসায় কথা বললাম। সবার বাসার লোকজন টেনশনে ছিলো সাইক্লোন ফণীর কারণে। কথা বলে সবাইকে আশ্বস্ত করে পা বাড়ালাম শ্রীখলার পথে।
পথে শুকনো ঝরপাতার কার্পেট বিছানো রাস্তা, ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনা, অসম্ভব সুন্দর ছোট ছোট পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম শ্রীখোলা। শ্রীখোলার আইকোনিক ব্রিজে ছবি তুলে পা বাড়ালাম সেপির পথে। আর মাত্র ২ কিলোর পর আমাদের ট্রেকের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি।
সেপির হোম স্টেতে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার একটু হাঁটতে বের হলাম, বেশিক্ষণ বাহিরে থাকা হল না শরীরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল বলে। আমাদের কনিষ্ট ট্রেকার রুবেলের পিড়াপিড়িতে হোম স্টের মালিক একটা মুরগি জোগাড় করলো, রুবেল জবাই করে দিল। রাতের খাবার খেয়ে ফেরার আয়োজন শুরু করলাম। ভোর ৫টায় রওনা হতে হবে, জিপে করে রিম্বিক হয়ে শিলিগুড়ি। তারপর ফুলবাড়ি বর্ডার ক্রস করে দেশের মাটিতে। ট্রেক শেষ করার সন্তুষ্টি নিয়ে আর দেশে ফেরার উত্তেজনা নিয়ে ঘুমুতে গেলাম।