শহর কলকাতার উত্থানপর্ব
চট্টগ্রামের বদলে ইংরেজদের কাছে গুরুত্ব পায় কলকাতা
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে এসে প্রথমে মাদ্রাজে ঘাঁটি স্থাপন করলেও পরে মূল শক্তি সঞ্চয় করে অখণ্ড বাংলার অজ্ঞাত-অখ্যাত গ্রাম কলিকাতায় (অধুনা কলকাতা)। ধীরে ধীরে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গড়ে তোলে কলকাতা নগর এবং বাংলা তথা ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ।
যদিও শুরুর দিকে কলকাতা এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে ইংরেজের অধিকারেও ছিল না। এর মালিকানা ছিল বিচিত্র। ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশীয় জমিদারদেরও অধিকারে ছিল কলকাতা অঞ্চলের অনেক জমিজমা। পলাশী যুদ্ধের পর মীরজাফরের সনদের বলে অঞ্চলটি সর্বপ্রথম ইংরেজদের পূর্ণ কর্তৃত্বে আসে। ১৭৭৩ সালে ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ অনুসারে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতাকে তাদের কার্যক্রমের অফিসিয়াল মূলকেন্দ্র বা রাজধানীতে রূপান্তরিত করে।
ব্রিটিশদের এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে রাতারাতি কলকাতা অঞ্চলের ভাগ্য প্রসন্ন হয়। ইংরেজ কোম্পানি এই নতুন শহরকে প্রাচীন রাজধানী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের বিপরীতে দাঁড় করায় এবং বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ শাসনের নীল নকশা প্রণয়ন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে।
পলাশীর বিজয়ের পর স্থানীয় শাসনের অবসানের মাধ্যমে বহিরাগত ইংরেজ আর কলকাতার বিকাশ সমান্তরালভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আবার এ কথাও সত্য যে ইংল্যান্ডবাসী ইংরেজরা কলকাতায় কিছু তাবেদারকে নিয়ে একটি ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল বলেই এই শহরটি থেকেই পুরো দেশে শাসন, শোষণ, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে পেরেছিল। ফলে পলাশীর পূর্ব ও পরবর্তী সব কার্যক্রমেই কলকাতাস্থ ইংরেজ তৎপরতার কথা বার বার ইতিহাসের পাতায় এসেছে।
অজ্ঞাত গ্রাম থেকে আধুনিক কলকাতা এবং বাংলায় উপনিবেশিকতাবাদের ভিত্তি গঠনের মূলে ইংরেজ কুঠিয়াল জোব চার্নকের ভূমিকাই প্রধান। এই জোব চার্নক ঠিক কোন সময়ে ইংল্যান্ড থেকে এদেশে আসেন তা ঠিক ঠিক জানা যায় না। কেউ বলেন, ১৬৫৫ সালে, আবার কেউ বা বলেন তারও পরে। ১৬৫৮ সালের ১২-১৩ জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি প্রথমে বাংলায় কোম্পানির তৎকালীন কেন্দ্র কাশিমবাজার কাউন্সিলের কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। পরে ১৬৮০ সালে কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলায় কোম্পানির প্রধান অধ্যক্ষও হয়েছিলেন।
জোব চার্নক তিনবার বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্গত সুতানুটি গ্রামে আসেন। প্রথমে এসেছিলেন হুগলি থেকে পালিয়ে। নবাবের আদেশ অমান্য করে জোব চার্নক গোপনে হুগলির কুঠিতে উপস্থিত হলে ১৬৮৬ সালের এপ্রিল মাসে হুগলির মুঘল ফৌজদার আবদুল গণির সঙ্গে স্থানীয় ইংরেজ কুঠির সৈন্যদের সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে জয়ী হলেও জোব চার্নক বাংলা-বিহার-ঊড়িষ্যার নবাব শায়েস্তা খাঁর ভয়ে অল্প দিনের মধ্যে হুগলি ত্যাগ করে বালেশ্বর যাবার পথে সুতানুটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন বসবাসও করেন। এটি ছিল ১৬৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা।
পরের বার ১৬৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চার্নক কলকাতার নিকটবর্তী হিজলিতে গিয়ে এলাকাটি অধিকার করেন। মুঘল সৈন্যের প্রতিআক্রমণের ভয় ও ম্যালেরিয়া জ্বরে পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে নবাব শায়েস্তা খাঁর অনুমতি নিয়ে চার্নক প্রথমে উলুবেড়িয়া ও পরে সুতানুটি ফিরে আসেন। দিনটি ছিল ২০ সেপ্টেম্বর ১৬৮৭ সাল।
বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারের জন্য মুঘল শাসকদের সঙ্গে জোব চার্নকের ক্রমাগত সংঘর্ষের ফলে কোণঠাসা কোম্পানি অনেক ভাবনা-চিন্তা করে শক্তির কৌশলী পথে অগ্রসর হয়। তারা চার্নকের সাহায্যার্থে বিলাত থেকে ক্যাপ্টেন হিথকে বাংলায় পাঠায়। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্যাপ্টেন হিথ জোব চার্নক ও তার নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীকারী সঙ্গীদের ১৬৮৯ সালের ৫ মে কলকাতা থেকে সরিয়ে দেন।
বিতাড়িত চার্নক জাহাজে চড়ে প্রথমে বাংলার আরও পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামে যান। কোম্পানি চেয়েছিল চট্টগ্রামে ঘাঁটি করার জন্য। কিন্তু চার্নক কলকাতায় ঘাঁটি গাড়ার পক্ষে অনড় থাকেন। কলকাতার পক্ষে দেন-দরবার করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে চার্নক সেকালের কোম্পানির স্থানীয় সদর দফতর মাদ্রাজে চলে যান। চার্নকের উদ্যোগের ফলে চট্টগ্রামের বদলে ইংরেজদের কাছে কলকাতার গুরুত্ব পায়।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।