'নিরুদ্দেশ যাত্রা' শেষে অলৌকিক বৃষ্টিস্নাত বর্ষা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ড. মাহফুজ পারভেজ/ ছবি: বার্তা২৪.কম

ড. মাহফুজ পারভেজ/ ছবি: বার্তা২৪.কম

'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।' 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' গল্পটি এভাবেই শুরু করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তুলনারহিত কথাকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

সত্যি সত্যিই আজ বৃষ্টি হয়েছে অঝোর ধারায়। শনিবার ১৫ জুন মোতাবেক পহেলা আষাঢ় বর্ষা ঋতুর শুরুর দিনটি বৃষ্টিবহুল অবয়বে চিহ্নিত হয়ে হলো।

বিজ্ঞাপন

এবার অস্বাভাবিক গরমের পর বৃষ্টি ছিল বড়ই কাঙ্ক্ষিত। গ্রীষ্মের দহনবায়ুর আক্রোশ যখন প্রকৃতি আর মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন বর্ষা নিয়ে এসেছে শীতল আরাম।

বসন্তকাল ঋতুরাজ নামে অভিহিত হলেও বর্ষা চিরায়ত বাংলার অনন্য ঋতু। বর্ষায় বাংলার রূপ বিকশিত হয় চরম শিহরণে। ফুলে, ফলে, গন্ধে আমোদিত বর্ষার জল ছলছল বিভা ঐতিহাসিক সৌন্দর্য্যের প্রতীক। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ বাংলার বর্ষার মতো বর্ণবৈভবে উদ্ভাসিত হয় না।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ বর্ষার আদি ও অকৃত্রিম গৌরব যদিও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে। নদী, ঝিল, বিল, খাল, নালা কমে গেছে। জলের কল্লোলিত দাপট দেখাও এখন আর সম্ভব হয় না। বন্যা ও দুর্ভোগের নামান্তর হয়ে বর্ষা আসে ক্রম-সঙ্কুচিত বাংলার গ্রামে।

নগরে-শহরে বর্ষা হয়ে গেছে বিভীষিকা। ড্রেন নেই, জলাধার দখল, পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ, অপরিকল্পিত উন্নয়নের তুঘলকি কাণ্ড ইত্যাদি বিরূপতা পেরিয়ে বর্ষার জল নিজস্ব গতিপথ ধরে চলতে পারছে না। পানি জমে যায় রাস্তায়। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হয় তীব্র জলাবদ্ধতা। নাগরিক জীবন বর্ষার নান্দনিক সুধা পান করার বদলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় দুর্ভোগের জলে।

শুরুতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের যে বর্ষামথিত নাগরিক অনুভূতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা কোনো সুদূর অতীতের ভাষাচিত্র নয়। শত শতাব্দী প্রাচীন কালিদাসের 'মেঘদূত' বা রবীন্দ্র-নজরুলের শতবর্ষ প্রাচীন বর্ষা-বন্দনাও নয়। ইলিয়াস অতি সাম্প্রতিক বর্ণনায় যে বর্ষার কথা বলেছেন, তা-ও আমাদের আটপৌরে জীবন থেকে অন্তর্হিত হতে চলেছে:

'... রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।' আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে।
ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আস না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।'

আমাদের জীবন থেকে এইসব বর্ষণমুখর মায়ারী রাত কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, কে জানে! বৃষ্টিকাতর স্বপ্নঘোর আনা দিন আর রাত্রিগুলো চলমান জীবনের দুর্যোগ ও অস্বস্তিতে ভেসে যাচ্ছে। এখন খুব কম মানুষ আছেন, বর্ষার সামাজিক-নাগরিক বিড়ম্বনা তুচ্ছ করে বলতে পারেন: 'এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্ত-কাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে, 'তুই ফেলে এসেছিস কারে', সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই।'

জানি না, কার জীবনচক্রে আজকাল বর্ষার সঙ্গে ফিরে আসে সেইসব অলৌকিক শৈশব: 'সন্ধেবেলা আম্মার ঘরে যখন যাচ্ছি, আকাশ কালো, রাস্তার মানুষজন নেই, চারটে জানালায় আমাদের পাতাবাহারের ছায়া লুফে নিয়ে পালিয়ে গেলো দুটো ফক্সওয়াগন, কাক আর বাদুড়েরা চিৎকার করে উঠলো; আমার মনে হলো আজ আমি একটুও ঘুমোতে পারবো না। আধ ঘন্টা একা কাটিয়ে আম্মার ঘর থেকে যখন ফিরছি তখন ভরা স্বরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার খারাপ লাগলো, আজ আমার একটুও ঘুম হবে না। আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।'

বর্ষা এলেই রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদেরকে ডেকে বলেন, 'তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মনরে আমার', তেমন করেই বর্ষা আরও মনে করিয়ে দেয় সেই মেঘ-বৃষ্টি-ছোঁয়া অতীতের আলো-ছায়াময় স্মৃতি 'আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।'

মানুষের জীবনে প্রতিদিনের অজানা, অচেনা, নিরুদ্দেশ যাত্রা শেষে বর্ষা আসে ঋতুচক্রের মেঘে মেঘে। সঙ্গে নিয়ে আসে অতীত স্মৃতির জলকণা মাখা অবিরল বৃষ্টিপাত। বর্ষা আর বৃষ্টি যতই নাগরিক-সামাজিক দুর্ভোগ নিয়ে আসুক, আরও আনে স্মৃতি-সত্ত্বার অবিস্মরণীয় রূপান্তর। আমরা যেন বৃষ্টির হাত ধরে চলে যেতে থাকি ফেলে আসা মানুষ, জনপদ, স্মৃতির কাছে।

এইসব হৃদয়স্পর্শী দিনে ইলিয়াসের গল্পের চরিত্র মনে হয় বৃষ্টির সঙ্গে মিতালি করে আমাদেরকেও ঘিরে ধরে এমনই এক বন্ধনে: 'বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে আসছিলো, রঞ্জু জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখন একেবারে নেই। বকুল পাতার নিঃশ্বাস বড়ো শূন্য মনে হয়। ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলছে বৃষ্টির শিশির, জলের ফোঁটাগুলো একপলক পর পর গানের টুকরোর নিচে ঝড়ে পড়ছে। কাজলা দিদি এই তারের মধ্যে দিয়ে কোথায়, কার বাল্বে জ্বলে উঠছে? কোথায়? 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই, মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই?'

বৃষ্টির এমনই ভাবালু আবেশে অতীতের মাটি ও মানুষের মুখ কিংবা কাজলা দিদির জন্যে রঞ্জুর মতো আমাদেরও ভারি খারাপ লাগবে। রঞ্জু যেমন ব্যাকুল ও দ্রুত হাতে ধাক্কা দিতে দিতে রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে, 'আম্মা দরজা খোলো, দরজা খোলো, আম্মা দরজা খুলে দাও, খোলো না তাড়াতাড়ি, খোলো।'

আমরাও তেমনি অতীতের কোনও জানালা বা দরজা খোলার জন্য আকুপাকু করি। ঘোরতর বর্ষার অমল ধবল বৃষ্টির টোকায় ফিরে আসি অতীতের দরজা-জানালা পেরিয়ে বর্তমানের চৌকাঠে। হয়ত তখন আশেপাশে, অতি কাছেই, কোথাও বৃষ্টির সমান্তরাকে শোনা যাবে মন উচাটন ডাক: 'যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বর্ষায়...।

বর্ষা শুধু বৃষ্টিই নয়, হৃদয়ের মর্মমূলে টুপটাপ ডাকও! 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' শেষে অলৌকিক বৃষ্টিস্নাত বর্ষায় যে জলছোঁয়া ডাক আসে প্রকৃতিতে, পরিবেশে, অতিক্রান্ত জীবনে এবং মানুষের তাপিত অন্তরে।