রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে নবাবের নৃত্যনাট্য 'রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’
উত্তর ভারতের এক নবাবের হাতে রচিত হয়েছিল কৃষ্ণচরিতের অনবদ্য শৈল্পিক রূপ। রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে নবাবের সেই ঐতিহাসিক নৃত্যনাট্যের নাম ছিল 'রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’, যার রচয়িতা ও নির্দেশক ছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ।
অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ রাজধানী লক্ষ্ণৌকে সাজিয়ে ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের রাজধানীর বর্ণিল সাজে। তখন দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্যের পতন কাল। সবার নজর উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌ কেন্দ্রিক রমরমা শাসকের দিকে।
শান-শওকত, নাট্য, গীত, আমোদ, প্রমোদ, নির্মাণের প্রাচুর্যে লক্ষ্ণৌ তখন ভরপুর। শিল্পপ্রেমী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের নজরে এলো কৃষ্ণের উপাখ্যান। তিনি সেই কাহিনির রূপান্তর করলেন নাটকে, সঙ্গে যুক্ত করলেন গীতিআলেখ্য ও নৃত্যকলা। পুরো নাটকটি রচিত হয় উপমহাদেশের মধ্যযুগীয় ঋপদী ভাষা উর্দুতে।
উত্তর ভারতের বৃন্দাবনে যমুনা নদীর তীর, সেখানে রাধা এবং অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলাখেলা ছিল, নবাব পছন্দ করলেন সেই প্রেমময় আখ্যান। যদিও ওয়াজিদ আলি শাহ তখন আনুষ্ঠানিক ভাবে নবাব হননি, তখন তিনি তার ভাই সিকান্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসায় মঞ্চস্থ করেন নিজের লেখা গীতিনাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’।
পণ্ডিতরা এটিকেই প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক বলে চিহ্নিত করে থাকেন। রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে এটি ছিল একটি নৃত্যনাট্য। এই ধরনের নাটকগুলিকে ‘রহস’ও বলা হয়ে থাকে।
কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন যে কৃষ্ণের জন্ম হয়, তা হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে জন্মাষ্টমী উৎসব রূপে উদযাপিত। নবাবের নাটকে কৃষ্ণজীবনের অসামান্য উদ্ভাসন ঘটেছে। কৃষ্ণের আবির্ভাবের ঘোরতর সংকুল পরিস্থিতিতে প্রেমাবেগের ছটা বিচ্ছুরিত হয় নাটকের পুরোটা জুড়ে। আখ্যানে তখন ছিল দ্বাপর যুগের শেষ পর্যায়। সে সময় এক কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথির মধ্যরাতে মথুরার রাজা কংসের কারাগারে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। ঐতিহাসিক মথুরা নগরীতে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে বন্দি দেবকীর কোলে জন্ম নিয়ে কৃষ্ণ হয়েছিলেন শুভবোধের প্রতীক। তার প্রেমদীপ্ত জীবন সাহিত্যের নানা অঙ্গনকেও স্পর্শ করে।
শিল্পমনস্ক নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত। আগ্রাসী ঔপনিবেশিক ইংরেজ ততদিনে বাংলা দখল করে দিল্লিও পদানত করেছে। শত শত বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সভ্যতার মহানগর দিল্লিকে লুটপাটের মাধ্যমে ইংরেজরা পরিণত করে মৃতের শহরে।
শেষ মুঘল সম্রাট ও বিশিষ্ট কবি বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দি করে নির্বাসন দেওয়া হয় বার্মার রেঙ্গুনে। প্রসিদ্ধ কবি জওক, গালিব প্রমুখ ঘরছাড়া হয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন।
ইংরেজ তারপর অযোধ্যায় দখল কায়েম করে। গান, বাজনা, গজলের নগরী লক্ষ্ণৌকে দখলদাররা রূপান্তরিত করে প্রেতপুরীতে। লক্ষ্ণৌর মার্জিত ও শিল্পী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে হটিয়ে বন্দি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়। নবাবকে সপরিবারে অন্তরীণ করে রাখা হয় কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বন্দর এলাকা মেটিয়াবুরুজে।
লক্ষ্ণেী ছেড়ে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আসেন ১৮৫৬ সালের মে মাসে। নতুন শহরে এসেও নবাব শিল্পচর্চা থেকে বিরত থাকেননি। বন্দি ও অবরুদ্ধ জীবনকেও তিনি রাঙিয়ে তুলেন শিল্পের বহুবিধ উপাচারে। আদি কলকাতার সাংস্কৃতিক ভূগোলে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় আবির্ভূত হন তিনি।
কলকাতায় নবাব জলসা, গান ও গজলের সঙ্গে নিয়ে আসেন ঋপদ সঙ্গীত। বিরিয়ানির প্রচলন আর সাংস্কৃতিক আসরের আয়োজন করে তিনি তার অবরুদ্ধ জীবনেও পরিণত হন কলকাতার কালচারাল আইকনে।
কলকাতার মেটিয়াবুরুজেও বহুবার ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’ মঞ্চস্থ হয়েছে ওয়াজেদ আলি শাহের উদ্যোগেই। তবে কলকাতায় মঞ্চস্থের সময় অবশ্য নাটকটির আঙ্গিকে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে। উত্তর ভারতের পটভূমি ও আবহের সঙ্গে মিশেছে বাংলার কিছু অনুষঙ্গ।
কলকাতার উপান্তের মেটিয়াবুরুজে অবস্থিত ওয়াজেদ আলি শাহের দরবারের শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সমৃদ্ধ করেছিল কলকাতা তথা অবিভক্ত বাংলার সংস্কৃতিকে। উত্তর ভারতের চরিত্র কৃষ্ণকে তিনি শৈল্পিক বিন্যাসে নিয়ে আসেন কলকাতার আবহে। কৃষ্ণ জন্মের স্মৃতিতে পালিত জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণচরিতের নাট্যরূপদাতা মেটিয়াবুরুজের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের শৈল্পিক অবদানও দোলা দিয়ে যায় ভক্ত ও বোদ্ধাদের মনে।