বাঘবিধবা



কিঙ্কর আহ্‌সান
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আতঙ্কে রাত কেটেছে সিংগীমারি গ্রামের লোকদের।

ফুলো ফুলো চোখ, চোখের কোণে অল্প পিচুটি মোর্শেদ আলির। দু-চারটা গেঞ্জির ওপরেও শাল জড়িয়েছে সে। পরনে বাটিক লুঙ্গি। পায়ে লাল মোজা আর স্যান্ডেল। সেকি শীত! দুধ-সাদা কুয়াশায় এক হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না। বরফের মতন হাওয়া হাত, পা, কানের খোলা জায়গায় এসে ঝাপটা মারে। মনে হয় ছুরি দিয়ে শরীর চিড়ছে কেউ। দাঁতে দাঁত লেগে যায়। কাঁপুনি ধরে। তাছাড়া আলির শীত একটু বেশিই। নাক বন্ধ থাকে শীতের সময়। কফ জমে বুকে। সারাদিন খক খক কাঁশি আর কফ ফেলা। বেশির ভাগ সময়েই গিলে ফেলা হয় কফ। ঘর নোংরা করলে বউ রাগ দেখায়। মোর্শেদ আলির গলা জ্বলে। কষ্ট হয়। কাঁশির দমকে কঠিন যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা সে চেপে রাখতে চায়। পারে না। কাশি তার কথা শোনে না। বেয়াড়া কাশি। সকালের দিকে কাশিটা বাড়ে। কেন বাড়ে জানা নেই। কাশতে কাশতে বমি হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে। আলো কাটছে ধীরে ধীরে। রোদ আসতে সময় লাগবে। কুয়াশার জালে এখনো বন্দী রাতের অন্ধকার। এই অন্ধকারকে সরিয়ে সূর্যের দখল নিতে সময় লাগবে বোঝা যায়। কাশি দিতে দিতে মোর্শেদ আলি চুলায় পাতিল বসায়। বউ আকলিমার ঘুম ভাঙাতে চায় না। নিজেই একটু পানি গরম করে। গরম পানিতে গলায় আরাম হয়। পানিতে একটু মধু মেশাতে হয়। সুন্দর বনের খাঁটি মধু। মধু কাশির জন্য ভালো। আকলিমা ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে দুটো চালও বসিয়ে দেওয়া যায়। একটা আলু সিদ্ধ। ভর্তা, কাঁচামরিচ দিয়ে ভাত। স্বামীর কাজ দেখে আকলিমা খুশি হবে।

মোর্শেদ আলী ঠিক করেছে আকলিমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে। এই সোহাগ আকলিমার পছন্দ হবার কথা না। তাদের সম্পর্কের মিষ্টি রস ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু তিক্ততা। একদম করলা তিতা। বিষয়টা অস্বাভাবিক না। বিয়ের কিছুদিন পরেই সম্পর্ক শীতের মতন নির্জীব হয়ে যায়। দুটো শরীর প্রয়োজনের তাগিদে তখন মিশে যায় ঠিকই কিন্তু উত্তাপ ছড়ায় না। চুমোচুমি ঢের হয় তবু তাতে ভালোবাসার ঠাঁই হয় না।

এমন তার বাবা আর মায়ের ক্ষেত্রেও দেখেছে মোর্শেদ আলী। ছোটবেলা থেকেই তার কড়া চোখ। এড়ায় না কোনো কিছু। তীক্ষ্ণ নজর সবদিকে।

মায়ের চেয়ে সুন্দরবন বেশি পছন্দ ছিল বাবাটার। পশুর নদীর গর্জন শুনলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যেত। মোটা চালের ভাত আর কোন্দ আলুর ঝাল ঝাল বিদঘুটে একটা তরকারি খেয়ে রোজ দুপুরে সে বের হয়ে যেত নৌকাটা নিয়ে। পশুর আর সন্ধ্যা নদীর অলিগলি চষে বেড়ানো হয়েছে তার। বনের গভীরে, একদম গহীনে কাঠের জন্য যেত বাবা। সাথে থাকত মোর্শেদ আলী। তোবড়ানো একটা টিনের ডিব্বায় মা খাবার দিয়ে দিত। ওটা থাকত মোর্শেদ আলীর হাতে। এক হাতে বৈঠা আরেক হাতে ডিব্বা। বাবা কুড়াল পাশে রেখে নৌকার পাটাতনে কাত হয়ে শুয়ে গান ধরত। ‘ওরে হৈ হৈ, জোয়ান মরদ বয়সের আগে হইলো বুড়া/ নাইরে বিবির সোহাগ/ আনিতে রস ছোবল দিলো শঙ্খচূড়া...।’

একটা সময় নদী ছেড়ে নৌকা ঢুকত খালে। নালার মতন ছোট্ট খাল। সে নালার শরীর চিড়ে ধীরে ধীরে নৌকা যেত গহীনে। এতটা গহীনে যেখানে বনকর্মীরা তো দূরের কথা, জলদস্যুরাও আসত না। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। জলের ওপর বৈঠার ছলাৎ আঘাত। ভূতুড়ে পরিবেশ। মোর্শেদ আলীর ভয় ধরত। বলত, ‘বাপজান, ডর লাগে। ফিরা যাই লন।’ তার বাবা হাসত। বলত, ‘পুরুষ মাইনষের কইলজা হইতে হইব পাহাড়ের মতন। এক বিঘৎ হইলে চলব?’ শুনে মোর্শেদ আলী চুপ যেত। ছোটবেলা থেকেই তার পৌরুষত্ব টনটনা। তবে এদিকে বাঘের ভয় আছে। শুনেছে অন্যদের কাছে। বাঘ জনবসতির কাছে এসে নিত্য টেনে নিয়ে যায় ছাগল, গরু। একটা বাঘ না, অনেকগুলো বাঘ। মোর্শেদ আলীর ভয় তাই কমত না। ইচ্ছে না থাকার পরেও তাই থেকে থেকে বলত, ‘ও বাপজান। ফিরা যাই না।’ বাবা হাসত। ভয়ংকর রকমের ক্ষয়ে যাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসত। বেশি গহীনে ঢুকলে মোর্শেদ আলী বাবার বন্ধু হয়ে যেত। বাবার কথার আগল ছুটত তখন। কতসব কথা। জীবন, চাওয়া, পাওয়া এইসব। মাকে নিয়েও বলত এ সময়। বলত, ‘তোর মারে রাখা যাইব না। নতুন মা আনুম তোর লাইগা। সোহাগ-আদরের কমতি হইব না।’

এই এইভাবেই এক একটা দিন যেত। বাঘ আর ধরত না। কাঠ নিয়ে ফেরা হতো বাড়ি। মোর্শেদ আলী হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। জীবন নিয়ে ফেরা।

বাবা একা গিয়েছিল একদিন। গোলপাতার ঝোপে কুড়াল দিয়ে কোপ দেবার সময়ে পেছন দিয়ে আঘাত করে বাঘ। গলা, কাঁধ, বুকে বাঘের থাবার আঘাত। রক্তে ভিজে একশেষ।

মোর্শেদ আলীর মা কেঁদে কেঁদে বনকর্মীকে বলছিল, ‘আমারে কইলো কাপড়-চোপড় পরিষ্কার কইরি রাখতি। জঙ্গলে যাইব। আমি জামা-কাপড় পরিষ্কার কইরে রাখলি দুপুরে গরম ভাত খাইয়া বাদায় যায় লোকটা। বিকালেই জাইলেরা এসে খবর দেয়, মোর্শেদের বাপ বনে বাঘের খপ্পরে পইড়িছে। তারপর সব শেইষ। লোকটা বাঁইচলোনা।’

এই কান্না কাজে লাগে। বনকর্মীদের মন গলে। তারা মায়ের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়। সরকার বাঘ বিধবাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছে। মোর্শেদের বাবার আর নতুন মা আনা হয় না। লোকটা এর আগেই হাওয়া হয়। মোর্শেদ পায় না নতুন মায়ের আদর-সোহাগ। অভিমান হয়। শুরুতে অভিমান, তারপর রাগ, কঠিন রাগ। বাঘের ওপর রাগ। বাঘের কারণে নতুন মাটা আসতে পারল না। বাঘের শাস্তি হওয়া দরকার। মোর্শেদ প্রতিশোধ নেবে। কঠিন প্রতিশোধ।

সে প্রতিশোধ নেবার সময় আর হয় না। শীতের মতন নির্জীব মা মোর্শেদ আলীকে নিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। লাভ হয় না। ভাতার টাকা অতি অল্প। বিধবা মা ঘর চালাতে নদীতে কাঁকড়া আর রেনু ধরতে বের হয়। ওতে খাবার জোটানো যায় কিছুটা হলেও।

মোর্শেদ বনে যেতে চায়। বয়স তো কম হয়নি। তাকত আছে শরীরে। কাঠ কাটা সম্ভব।

মা রাজি হয় না। হাত, পা ধরে। কসম কাটে। বলে, ‘তোর বাপ গ্যাছে অই জঙ্গলে। তোরে আর হারাইতে পারবু না।’ মোর্শেদ আলী মায়ের কথায় বিরক্ত হলেও কথাটা শোনে। তাকে হারানোর ভয় বুকে পুষে শীতের মতন নির্জীব মাটা একদিন নিজেই হারিয়ে যায়।

ততদিনে বিয়ে হয়েছে মোর্শেদ আলীর। মা-ই ছেলেকে ঘরে রাখার জন্য করেছে এই কাণ্ড। বউয়ের রসে মজবে ছেলে। জঙ্গলে যাবে না। বোকা মা। শীতের মতন নির্জীব বউ এনেছে ঘরে। বাবার মতনই মোর্শেদ বসন্ত ঋতুর জন্য পাগল। শীতে শরীর উষ্ণ হয় না। ওতে ওম ওম গরমের আরাম নেই। বউয়ের সাথে তিক্ততা শুরু হয়। তিতা তিতা জীবন।

মোর্শেদ নানান কথা চিন্তা করতে করতে কাশে। চুলায় ভাত। আগুনের ভেতর কী যেন পট পট করে ফোটে। লাকড়ি জ্বলতে চায় না এই শীতে। ভিজে শেষ।

মোর্শেদ আলির কাশির দমকে একসময়ে ঘুম ভাঙে আকলিমার। উঠে এসে দাঁড়ায় মোর্শেদ আলির পাশে। পরনের শাড়ি আলুথালু। আটসাট পুরনো ব্লাউজের আড়াল হতে বের হয়ে আসার জন্য আকুল উদ্ধত্ব স্তন। আকলিমার দিকে তাকায় মোর্শেদ আলি। তাকিয়ে হাসি দেয়। আর কিছু না। নারীর চেয়েও তার কাছে বরাবরই আকর্ষণীয় গহীন অরণ্য। এসব জানে আকলিমা। তাই বনে না। বেহুদা পুরুষে শান্তি নাই। তিতা জীবনটা আরো তিতা করতে আকলিমা গালিগালাজ শুরু করে। ক্যান পুরুষমানুষ পাকঘরে ঢুকল এই হলো অপরাধ। মোর্শেদ কথা বাড়ায় না। পাকঘরের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে খাটের ওপর গিয়ে বসে। আকলিমা গজগজ করে যায়। মোর্শেদ আলি চুপ থাকে। আজ আর কথার পিঠে কোনো কথা হবে না। আকলিমার শেষ দিনটায় মেনে নেওয়া হবে সব। তার শেষ খাওয়াটা নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ালে ভালোই লাগত মোর্শেদ আলির। সেটা হতে দিলো না আকলিমা নিজেই।

বসে বসে সব ঠিক করে মোর্শেদ আলি। এই দিনটার জন্য অপেক্ষা ছিল অনেকদিনের। বাঘকে বাগে আনার সময় এবারই। কম তো চেষ্টা হয়নি। পারেনি কোনোবারই। এবার লোভনীয় টোপ। বাঘ ধরা না পড়ার কোনো কারণ দেখছে না সে।

গত রাতে সিংগীমারি গ্রামে বাঘ ঢোকার সময়েই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল সব। কাজ চলছে সে অনুযায়ী। বিছানায় বসে চারপাশটা দেখে নেয় আরেকবার মোর্শেদ আলি। ঘরটা এখনো শক্ত পোক্ত। কাঠের বেড়ার ওপর টিনের চালার ঘর। ধার-দেনা করে নতুন করা হয়েছে। বাড়ির একদিকে লোনা পানির খাল আর আরেক পাশে চিংড়ির ঘের। বাঘ লুকানোর জন্য খালের দিকটাই বেছে নেবার কথা। জংলা জায়গা। নিজেকে আড়াল করা যায় সহজে। গত রাতে টিন পিটিয়ে জানানো হয় বাঘ আসার কথা। মোর্শেদ তাই তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে খিল দেয়। ততক্ষণে কয়েক বাড়ির মুরগি আর ছাগল হাওয়া। শোনা যায় আশপাশের বাড়ি থেকে আসা কারো কারো কান্না। এরপর সব চুপ। একদম নীরব, নিঃশব্দ।

ঘটনা কয়েকদিন আগের। গত সপ্তাহে বাঘ বাজার থেকে ফেরার পথে হামলা চালায় পুব কোনার ঘরের বাবলুর ওপর। হাত আর বুকের একপাশের ওপর দিয়ে যায় বিপদ। কোনোরকমে বেঁচে যায় বাবলু। বনকর্মীরা খোঁজ লাগায় বাঘের। বাজি পোড়ায় যাতে গহীন অরণ্যে চলে যায় বাঘটা।

বাঘ যায়নি। বাঘ আছে। মানুষের মাংসের স্বাদ পেলে ফিরে আসতেই হয়। বাঘ এই নেশার টান এড়াতে পারে না। এক জীবনে কম তো দেখল না মোর্শেদ। ভেড়া, ছাগল কত কিছু দিয়েই না ফাঁদ পাতল! কাজ হয়নি। চালাক প্রাণি। অত সহজে কাছে আসবে না। টোপ হিসেবে মানুষই ভালো। মানুষের মাংসের স্বাদ এড়ানোর সাধ্য নেই কোনো বাঘের। কিন্তু মানুষ কই পাওয়া যায়? মরা কিংবা জ্যান্ত মানুষ!

পুতাটা জায়গামতন লুকিয়ে রেখেছে মোর্শেদ আলী। মুগুরের চেয়ে কম নয়। মাথার ঠিক জায়গায় এক ঘাঁ পড়লেই যথেষ্ট। খুব বেশি রক্তপাত হবে বলে মনে হয় না। তারপর মৃতদেহটা টেনে ফেলা হবে ঘরের বাইরে। বাঘ মানুষের শরীরের গন্ধ টের পাবে ঠিক ঠিক। ছুটে আসবে মোর্শেদ আলীর বউয়ের নরম মাংসের লোভে।

আকলিমা নিজেই খাবার তৈরি করে। আলু ভর্তাটা ভালো মতন চটকায়। বোম্বাই মরিচের অর্ধেকটা দেয় সাথে। এই মরিচের গন্ধ মোর্শেদ আলীর পছন্দ। সাথে বেগুন ভাজির এক টুকরা। একটু সময়ই লাগে সব তৈরি করতে। সময় নিয়েই করে। ক্ষিধে লাগুক মোর্শেদ আলীর। ক্ষিধেটা দরকার। আকলিমা তো আর খাবে না।

বাইরে তুমুল শীত। কুয়াশার শরীর টিকে থাকার চেষ্টা করে সূর্যের সাথে লড়াই করে। আকলিমা রান্নাঘরের টিনের ফুটো দিয়ে বাইরের যতটুকুন দেখা যায় দেখে নেয়। কেউ নেই। সব ঘরে লুকিয়ে আছে। বের হয়নি বাঘের ভয়ে।

আকলিমার তোজাম্মেলের কথা মনে পড়ে। এলাকার সর্দার। ডাকাতের মতন চেহারা। শরীরে শক্তির কমতি নেই। মেয়ে মানুষ গিলে খেয়ে ফ্যালে। এক হাত লম্বা জিহ্বা মনে হয় লোকটার। এই লোকের ফাঁদেই পড়েছে আকলিমা। ইচ্ছে করেই পড়েছে। মরদ দরকার তার। মোর্শেদ আলীর মতন ঢিলেঢালা লোক তার পোষায় না। ভালো লাগে তোজাম্মেলকে। ভালোবাসে সে।

তোজাম্মেল এখন বনে। এই সময়ে নিজের দল নিয়ে জঙ্গলে যায় সে কাঠ আর মধু আনতে। বনে গেলে আলগা মাথায় চলাফেরা বারণ স্ত্রীদের। রান্নার জন্য মরিচ পোড়ানো নিষেধ। যাবে না শরীরে সাবান ঘষা। সব ধরনের ভাজা পোড়া বন্ধ একদম। অন্যের জন্য রান্নায় দোষ নেই অবশ্য। শুধু নিজে মুখে তুলতে পারবে না। এসব মানতে হয়। না হলে অমঙ্গল।

তোজাম্মেলের স্ত্রী নেই। মরেছে নিউমোনিয়া হয়ে। তোজাম্মেলের হয়ে এসব রীতিনীতি পালন করছে আকলিমাই। বিয়ে কিন্তু তাদের হয়েছে। গত অগ্রহায়ণে। মোর্শেদ আলী বাড়ি থেকে এক সপ্তাহ ধরে নাই হয়ে গেল। আকলিমা তখন মুক্ত বিহঙ্গ। তোজাম্মেলের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা। উদ্দাম জীবন। দুটো শরীর একে অপরের ভাষা বোঝে। সাড়া দেয় দারুণভাবে। এই তো ভালোবাসা। স্পর্শ যার আরেক নাম। সেবারই গোপনে বিয়েটা সেরে নেয়। তবে কথাটা গোপন থাকেনি। গ্রামের লোকজন কিছুটা বুঝেছে। বুঝেছে তাদের মেলামেশার বিষয়টা। বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে সেটা আঁচ করেনি। আর অতটা ভাবাও নিষেধ। এই সমাজে এটা কঠিন পাপ। সর্দার হলেও তোজাম্মেল অন্যের বউকে নিজের করতে পারে না। মোর্শেদ মরলেই তখন আকলিমাকে নিজের ঘরে আনার বিধান আছে। মোর্শেদ মরবে কবে?

গ্রামের লোকজন মোর্শেদকে আকলিমার ব্যাপারটা বলতে চায়। কিন্তু মোর্শেদের মতন গাবড়কে বলে কী লাভ? সংসারের প্রতি খেয়াল নাই এই ছাওয়ালের। মা মারা যাবার পর এই সংসারটা দেখার কেউ নেই। মোর্শেদ তো শুধু বাঘ, বাঘ করেই কাটায়। দাদা, বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ। অবুঝ, মূর্খ লোক বটে! তাই আকলিমা আর তোজাম্মেলের অবাধ মেলামেশা চলতে থাকে।

আকলিমা তোজাম্মেলকে আরো কাছে চায়। এমন বুনো লোককে বেঁধে ফেলার মধ্যে আনন্দ আছে। মেয়েদের এই যেন অর্জন। এই পালিয়ে পালিয়ে আর কতদিন? তোজাম্মেলের সাথে সংসার গোছাতে হবে। সন্তান সন্ততিতে ভরে ফেলতে হবে ঘর। শেকড় গড়তে হবে। এই তো শান্তি!

মোর্শেদই প্রধান বাঁধা। মোর্শেদকে আজকাল আর একদমই ভালো লাগে না আকলিমার। তাছাড়া তোজাম্মেল কাছে নেই বলে মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অবশ্য আকলিমা চেয়েছিল এটাই হোক। বনে থাকলে ফায়দা। কেউ সন্দেহ করবে না।

আকলিমা খাবার নিয়ে আসে। মোর্শেদের ক্ষিধে পেয়েছে। সে আকলিমাকে সাথে খেতে বলে। আকলিমা খায় না। সে তোজাম্মেলের জন্য স্ত্রীর নিয়ম কানুন মেনে চলছে। সে এড়িয়ে যায়। মোর্শেদ জোরাজুরি করে না। এসব তার ধাতে নেই। সে খেয়ে নেয়। আকলিমার রান্না ভালো হয়েছে। মৃত্যুর আগে ভালো রেধেছে তার বউ। সে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। খেয়েই পুতাটা বের করে আঘাতটা করতে হবে।

আকলিমা মোর্শেদ আলীর খাওয়া দ্যাখে। ক্যামন হাভাতের মতন খাচ্ছে লোকটা। কোনোদিকে কোনো খেয়াল নেই। এটাই তো চায় আকলিমা। সে উঠে যায় রান্নাঘরের দিকে। ফিরে আসে অল্পসময়ের ভেতরেই। হাতে বটি। মোর্শেদ আলী মাত্র ভাত চিবোতে চিবোতে গেলার জন্য যখন একটু পানি খেতে যাবে ঠিক তখনই গলায় একটা কোপ বসিয়ে দেয় আকলিমা। যুতসই কোপ।

মোর্শেদ আলীর শরীর দুর্বল। এক কোপেই ঘায়েল। কোনো ঝামেলা করে না। লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। হালকা শরীরের লাশটা ধরে সাবধানে দরজার একটু দূরে বাইরে ফেলে রেখে আসে আকলিমা সহজেই। কোনো লোকজন নেই আশেপাশে। করুণাময় আজ তার সাথেই আছেন।

ঘরে ঢুকে খিল আটকায় সে। তারপর নিপুণহাতে রক্তটা পরিষ্কার করে। ধোয়া মোছার কাজে সে ভালোই তাছাড়া মোর্শেদের শরীরে রক্ত কম মনে হয়। তেমন রক্ত তো ছড়ায়নি।

এরপর আকলিমার অপেক্ষা। এই সময়ইটা কষ্টের। করুণাময়কে সাথে থাকতে হবে। সাথে থাকতে হবে বাঘদেবতাকে। বাঘ আসুক। ছিড়ে-খুবলে খাক মোর্শেদের শরীর। তবেই বেঁচে যাওয়া। তবেই স্বপ্ন পূরণ। তবেই তোজাম্মেলের সাথে থাকার সুযোগ।

মোর্শেদ বাঘের হাতেই মরবে এ তো জানা কথা। সারাজীবনই প্রতিশোধ আর বাঘ, বাঘ করে কাটল। এমনই হবার কথা মোর্শেদের সাথে। কেউ সন্দেহ করবে না।

বাঘ আসতে হবে। এসে এমনভাবে খুবলে খাক মোর্শেদকে যাতে গলার কোপটা খুঁজে না পাওয়া যায়। একদমই ঠাওর করা না যায় যে এটা মোর্শেদ ছিল।

প্রার্থনায় বসে আকলিমা। তার ভালোবাসা যেন জয়ী হয় এই চাওয়া। সে তেমন কিছু তো চায়নি কখনো প্রভুর কাছে। শুধু তোজাম্মেলের সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছে। আর এটার জন্য মোর্শেদের সাথে এমন করা ছাড়া উপায় ছিল না। করুণাময় তার প্রার্থনা শুনুক। সে অপেক্ষা করতে থাকে। সদ্য বিধবা হওয়া বাঘবিধবা আকলিমার চোখ ভেজে জলে। ‘ও খোদা, ও বাঘদেবতা নিরাশ কইরো না।’ এই তার প্রার্থনা। বাঘ আসবে। আর তখন শুরু করতে হবে বিলাপ। স্বামী হারানোর বিলাপ। সব সাজিয়ে রেখেছে ঠিকঠাক। শুধু বাঘটা আসুক। ভালোবাসার জয় হোক। পৃথিবীতে ভালোবাসারই জয় হয়েছে বরাবর। আজও হবে।

অপেক্ষায় সময় যায় আকলিমার। ভালোবাসা মেশানো করুণ, কঠিন অপেক্ষা।

করুণাময় তার ডাকে সাড়া দিক। আমরা যারা ভালোবাসার সাথে আছি তারা চাই চলুন, প্রভু যেন আকলিমার সাথে থাকে। আর মোর্শেদ? ও নিয়ে ভাবার কী আছে? যে যাবার সে তো যাবেই।

পৃথিবী অযথা, দুর্বল লোক পছন্দ করে না। সেসব তার ধাতে নেই। ধাতে থাকার কথাও না। কথা কি?

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;