একজন ফিরোজের দিন



জুলিয়ান সিদ্দিকী
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আগস্ট মাস। এ মাসের একুশ তারিখটি বিশেষ একটি দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল কালি দিয়ে বেষ্টন করে রাখা আছে কালো রঙে ছাপানো  তারিখটি। এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেদিন যে কোনো মূল্যে ফিরোজকে থাকতে হবে ঢাকায়। সেদিন তার হাত ভাঙুক কি পা ভাঙুক এমন কি ডায়রিয়া হয়ে বিছানা থেকে উঠতে না পারলেও তাকে যেতে হবে সেখানে। বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে তাকে উপস্থিত থাকতে হবে নগর ভবনের সামনে।

তাদের গ্রামের ফরিদ সাহেব চাকরি করেন সেখানে। অনেক বড় চাকরি। দামী আর ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট, পায়ে দামী চকচকে জুতো পরে তিনি মাঝে মধ্যেই গ্রামে আসেন। লোকজন তাকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। মানুষটি খুবই ভালো। গ্রামের বেশ কয়েকজনকে চাকরি দিয়েছেন। কিছুদিন আগে ফিরোজও মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল ফরিদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। অনেক অনুনয় করে মা  ফরিদ সাহেবকে বলেছিলেন ছেলের জন্যে একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে। মানুষটি ভালো বলেই হয়তো একজন মায়ের আকুতিতে সাড়া দিতে দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন যে, আগস্ট মাসের একুশ তারিখ যেন তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে দেন। সেদিন বিকেল চারটার সময় নগর ভবনের গেটে থাকবেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন রতনের গ্যারেজে। পেটে-ভাতে সেখানে কাজ শিখবে আর রাতে সেখানেই ঘুমাবে। কাজ শেখা হয়ে গেলে ভালো বেতন পাবে ফিরোজ। তখন মাতা-পুত্রের খাওয়া-পরার অভাব থাকবে না।

স্কুল মাস্টার রজব ভাণ্ডারীকে জিজ্ঞেস করে ফিরোজ জেনে নিয়েছিল একুশে আগস্ট হতে আর কতদিন বাকি। সেদিনের পর থেকেই মাতা-পুত্র অপেক্ষা করছিল দিনটির জন্যে। দিনটিকে মনে রাখতে বাজার থেকে একটি এক পাতার সরকারি ক্যালেন্ডার কিনে এনেছে দশটাকা দিয়ে। তাতে লাল কালি দিয়ে একটি বৃত্ত এঁকে কালো অক্ষরের তারিখটিকে বন্দী করে দিয়েছেন মাস্টার।

হাটের দিন গাছ থেকে বেশ কটি নারকেল পেড়ে সে নিয়ে গিয়েছিল সিদ্ধেশ্বরী বাজারে। নারকেল বিক্রি করে বাজার থেকে ফিরে আসবার পথে পশ্চিম পাড়ার ছিরিপদ জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে ফিরুজ্যা, একুইশ তারিখ হইতে আর কয়দিন?
- দুইদিন বাদেই।
হাস্যোজ্জ্বল মুখেই জানিয়েছিল ফিরোজ।
কিছুটা পথ একই সঙ্গে চলতে চলতে ছিরিপদ আরো বলেছিল, ঢাকা শহরডা অনেক সোন্দর রে! গণশার লগে যোগালির কাম করছিলাম কয়দিন।
- গণশা কইছে আমারে।
- ঢাকা শহরের খারাপ দিক হইল থাকনের জাগার খুব অভাব। এত বড়বড় দলান থাকলে হইব কী, ঘুমান-থাকনের বেশি জাগা নাই। পানি তো কিন্যা খাওনই লাগে, হাগদে মুত্তেও ট্যাকা লাগে!
ফিরোজ কী বলবে ভেবে পায় না। গ্রামে তো এ বাড়ি ও বাড়ি দু-চার পাঁচদিন থাকলেও কেউ কিছু বলবে না। এমন অনেক গেরস্থ আছে যাদের এক-আধটি ঘর বছরের বেশিরভাগ সময় খালিই পড়ে থাকে। একবার গণশার সঙ্গে সে নিজেও ঢাকা শহরের গুলশানে কাজ করতে গিয়েছিল। যে কয়েকটি দিন সেখানে ছিল, রাতের বেলা একটি ভাঙা দালানের বারান্দায় ঘুমাত। তাও কোনো কোনো রাতে চৌকিদার এসে লাঠির গুঁতো মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। তখনই সে জেনে গিয়েছিল যে, সত্যি সত্যিই ঢাকা শহর একটি কঠিন জায়গা।

ছিরিপদ নিজের বাড়ির দিকে যাবার আগে ফিরোজের একটা হাত ধরে বলল, তুই ভালোয় ভালোয় কাজ-কাম পাইলে আমার লাইগ্যাও খাইয়া পিন্দা চলনের মতন একটা কিছু ভাও করিস।
- আইচ্ছা আইচ্ছা, তুই চিন্তা করিস না!

আর দুদিন বাদেই একুশ তারিখ। ফিরোজের জীবনে খুব প্রত্যাশিত একটি দিন। ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে তার।

এমনিতেই ফিরোজের মা প্রতিদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ে উঠোন-বার ঝাঁট দেন। রাতভর ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলোকে একখানে জড়ো করে একটি পুরনো বস্তায় পুরে রান্নাঘরে রেখে দেন। আর সেই শুকনো পাতার আগুনেই তাদের দুজনের খাবার রান্নাবান্না হয়ে যায়।

ভোরবেলা মায়ের উঠোন ঝাঁট দেবার শব্দে প্রতিদিনই ঘুম ভাঙে ফিরোজের। কিন্তু আজ কেন যেন মায়ের ঘুম ভাঙার আগেই জেগে উঠেছে সে। আজকের দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল সে। এ দিনটাতেই তাকে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন ফরিদ সাহেব। দুপুর বারোটার দিকে কুটিলা স্টেশনে এসে থামবে ট্রেন। মিনিট দশেক জিরিয়ে নিয়ে ফের ছুটতে থাকবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। অতটা কম সময়ে টিকেট কাটা, খালি বগি খুঁজে ট্রেনে ওঠা খুবই ঝামেলার বলে মনে হয় তার কাছে। তাই খানিকটা সময় হাতে নিয়ে বের হলে আগে আগে টিকেট পেতে সুবিধা হয়।

বিছানায় শুয়ে থেকেই সে মায়ের জেগে উঠবার শব্দ টের পায়। অনেক বছর ধরে সে পরিচিত এসব শব্দের সঙ্গে। মায়ের ঘুম ভাঙার পর বিছানায় উঠে বসা। মেঝেতে পা রেখে উঠে দাঁড়ানো। পরনের কাপড় গোছাবার শব্দ। তারপর ছোট ছোট পদক্ষেপে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া। হুড়কো খোলা। কাঠের দরজার পাল্লা টানবার সময় লোহার ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ। পুকুর ঘাটে মায়ের কুলকুচা, গলা খাকারির শব্দ। শ্লথ পায়ে ফিরে আসা। মেঝেতে নামাজের পাটি বিছানো। সব শব্দই আলাদা করে চেনা আছে তার।

অন্যান্য দিন সকাল সকাল কাজে যাবার তোড়জোড় শুরু করলেও আজ কোনো তাড়া নেই বলে কেমন একটা আলসেমিতে পেয়ে বসে তাকে। অন্য দিনগুলোর মতো হাত-পা তেমন ছটফট করে না। মনের ভেতরও নেই কোনো রকম অস্থিরতার দাপানি। হয়তো মায়েরও তেমন কোনো তাড়া নেই আজ। ছেলে শহরে যাবে। সময়টা জানা আছে বলেই হয়তো উঠোন-বার ঝাঁট দেবার শব্দগুলো তেমন একটা জোরালো শোনায় না। ফিরোজ কোনো তাড়া বোধ করে না বলেই হয়তো ফের ঘুমিয়ে পড়ে। এক সময় মায়ের ডাকে দ্বিতীয় ঘুমটা ভেঙে যায় তার। কিন্তু ততক্ষণে বেশ বেলা হয়ে গেছে। সূর্যটাও তেতে উঠেছে অনেকটা। ঘামে ভিজে চিটচিটে হয়ে আছে গলার কাছটা।

ছেলেটা বেলা করে শহরে যাবে বলেই হয়তো মায়ের রান্নার আয়োজনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে খানিকটা ভিন্ন মনে হয়। অন্য সময় প্রতিদিন সকালে পান্তা খেয়ে সে কাজে যেত। আজ পান্তার বদলে নারকেল-চিড়ে আর গুড় দেখতে পেয়ে তার মনটা যেন আরো ভালো হয়ে যায়। বছর বছর গাছে নারকেল ধরলেও তা মাতা-পুত্রের ভাগ্যে খুব কমই জোটে। সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনে প্রায় সবগুলোই বেচে দিতে হয়। ছোটবেলা থেকেই নারকেলের নাড়ু তার খুব পছন্দ। কখনো এমনি এমনি একটা দুটো নাড়ু কখনো বা মুড়ির সঙ্গে খেতে চমৎকার।

গুড়-নারকেল দিয়ে চিড়া মেখে খেতে খেতে সে লক্ষ্য করে যে, তার মা একটি গামছাতে কিছুটা শুকনো চিড়া আর কয়েকটি নাড়ু বেঁধে রাখলেন। তারপর তাকে দেখিয়ে বললেন, এইডা লগে লইয়া যাইস কইলাম!

ফিরোজ জানে, ট্রেনে বসে খিদে পেলেও যাতে অযথা পয়সা খরচ করে বাইরের খাবার কিনে খেতে না হয়, তার জন্যেই এমন ব্যবস্থা।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুটিলা স্টেশনে এসে অবাক হয়ে যায় সে। অন্যান্য সময় স্টেশনে এত মানুষ কখনো দেখেনি সে। ঈদ আর বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের এক দুদিন আগে ছাড়া এমন ভিড় কখনো হয় না। এত মানুষ কেন ঢাকা যাবে বুঝে উঠতে পারে না সে। টিকেট কাটতে গিয়ে দেখে কেউ নেই সেখানে। ট্রেন চলে আসতেই কেমন হুড়মুড় করে লোকজন উঠতে থাকে। বগিগুলোতে জায়গা না পেয়ে জানালায় পা দিয়ে ছাদের ওপর উঠে যেতে থাকে কেউ কেউ। ফিরোজও টিকেট ছাড়া ট্রেনের ছাদে উঠে পড়ে। আস্তে আস্তে ছাদও পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পাশের কয়েকজনের আলাপ থেকে জানতে পারে তারা ঢাকা যাচ্ছে জনসভায় যোগ দিতে। আসলে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়েকে দেখতে, যিনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় ফিরোজের কাছে। কখনো বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, কখনো বা শেখ হাসিনা, কখনো বা প্রধানমন্ত্রী শব্দগুলো তার কানে এসেছে বহুবার। একজনই যে এই তিনটি নামে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত তা সে জানলেও চর্ম চোখে কখনো দেখেনি। একজন নারী হয়ে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, না জানি তিনি দেখতে কেমন। যদিও মাঝে মধ্যে বাজারে কোনো কোনো পত্রিকায় বা কোনো পোস্টারে ছবি দেখেছে, কিন্তু মন তার ভরেনি। নিজের চোখে সামনাসামনি দেখা আর ছবি দেখার মাঝে অনেক ফারাক বলে বিশ্বাস করে সে। তাই অনেকদিন থেকেই ইচ্ছেটি তার মনের ভেতর ডালপালা ছড়িয়ে শক্ত পোক্ত হয়ে শিকড় গেড়ে বসেছিল। কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ সে পায়নি। ট্রেন ছাড়বার আগমুহূর্ত পর্যন্ত লোকজনের টুকরো টুকরো কথায় সে জেনে গিয়েছিল যে, বিকেলের দিকে জনসভায় আসবেন প্রধানমন্ত্রী। তখনই সে ঠিক করে রেখেছে যে, ফরিদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে একবার জনসভায় যাবে। কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চাক্ষুষ করে যাবে একবার।

গ্রামের আকবর সওদাগরের মুখে অনেকবার শুনেছে বঙ্গবন্ধুর কথা। শেখ হাসিনার কথা। ছোটবেলা থেকেই তাদের নাম শুনে শুনে ভালোবাসতে শিখেছে। শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শিখেছে। আকবর সওদাগরের কাছে যারা ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র-পাত্রী, তারা কোনো অংশেই ছোটখাটো মানুষ বা অল্প-স্বল্প ক্ষমতার মানুষ নন। এমন ধরনের মানুষদের সামনে থেকে দেখতে পাওয়াটাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে হয় তার কাছে।

চলন্ত ট্রেনের ছাদে হুহু বাতাস ফিরোজের বাবরি চুল নিয়ে খেলা করে। দুষ্টুমি করে চেপে ধরবার মতো চোখের দু পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। ট্রেনের দু পাশ দিয়ে পেছন পানে ধাবমান জনপদ ক্রমশ তাদের এগিয়ে নিয়ে যায় কমলাপুর স্টেশনের দিকে।

কমলাপুর স্টেশনটা অচেনা নয় ফিরোজের কাছে। তারপরও ট্রেনের ছাদ থেকে নামার পর নিজের মনোমতো হাঁটবার সুযোগ পায় না। স্রোতের মতো লোকজন নিজে চলতে চলতে সামনের আর দুপাশের লোকজনকেও যেন ঠেলতে থাকে সমান বেগে। যেন বাধভাঙা স্রোত সামনের ঘরবাড়ি, জমি ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অবিরাম। সে সঙ্গে হালকা পাতলা হাতাহাতি ঠেলাঠেলি বাকবিতণ্ডা কোনোটাই থেমে নেই। ফলে একটা গমগমে ভাব ফুটে উঠেছে পুরো স্টেশন জুড়ে।

জনস্রোত ছুটে চলেছে দক্ষিণের কাচ লাগানো সদর দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু ডানে বামে বা আগে পেছনে মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না ফিরোজ। চলতে চলতে এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করে স্টেশনের বাইরে। হায় হায়, জনসভায় যাওয়ার জন্যে আসা দলটিকে আর দেখতে পাচ্ছিল না। মনেমনে খানিকটা হতাশ হলেও সে কান রাখে কে কী বলছে সেদিকে। কিন্তু কাউকেই যেন জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন দেখে না। একটি ছোটখাটো মিছিল আসে উত্তর দিক থেকে। নানা রকম শ্লোগানে শ্লোগানে বাতাস কাঁপাচ্ছিল। কিছু না ভেবেই মিছিলে ঢুকে পড়ে সে। যে ভাবেই হোক মিছিল তো জনসভাতেই যাবে। আর সেখানে একবার যেতে পারলে প্রধানমন্ত্রীকেও এক নজর দেখা হয়ে যাবে।

মিছিলের লোকজনের মুখে নানা রকম স্লোগান শুনতে শুনতে আর বিচিত্র সব মানুষের মুখ দেখতে দেখতে কখন যে সে জনসভায় পৌঁছে  যায় বুঝতে পারে না। কিন্তু এরই মাঝে অনেক মানুষ চলে এসেছে। সামনের দিকে বাঁশের ঘেরের ভেতর দুভাগ হয়ে বসে আছে অনেক নারী-পুরুষ। জনসভার সীমানা থেকে অনেকটা দূরে রঙ-বেরঙের শরবত বিক্রি করছে একটি লোক। ফিরোজের ইচ্ছে হয় বের হয়ে গিয়ে এক গ্লাস শরবত খেয়ে আসে। কিন্তু বের হতে গিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে নানা রঙের পোস্টার-ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে আসা নানা দলের ঠেলা ধাক্কায় বের হতে পারে না। নিরুপায় হয়ে সে সামনের সারিতেই মাটিতে বসে পড়ে। পাশের একজন বোতল থেকে পানি খেয়ে সেটা ফেলে রেখেই উঠে পড়ে সামনের দিকে আগায়। সে অবসরে ফিরোজ বোতলটা টেনে নিয়ে পানি খায় আর তখনই চারদিক থেকে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠতে থাকে, শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা!
পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলে, এই মিয়া, চুপ কইরা আছো ক্যান?
ফিরোজ কিছু একটা বলবে বলবে ভাবতেই থেমে যায় শ্লোগান। পেছনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় এরই মাঝে পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। আরো পেছনের দিকে অনেক মানুষ হয়তো বসতে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশের উঁচুউঁচু দালানগুলোর ছাদেও মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো দালানের জানালায়ও দেখা যাচ্ছিল মানুষের মুখ।

প্রধানমন্ত্রী আসতে হয়তো এখনো অনেক দেরি। তাই তিনি আসবার আগে আগে সে চিড়া-আর নারকেলের নাড়ুগুলো খেয়ে নিতে পারে। ভাবতে ভাবতে সামনে গামছার পুটলিটা খুলে মেলে ধরে ফিরোজ। একটি নাড়ু মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে একমুঠ চিড়া-মুড়িও মুখে দেয়। আর খেতে খেতেই টের পায় যে, জবর খিদে পেয়েছে। এতক্ষণ মানুষের শ্লোগান, চিৎকার-ঠেলাঠেলিতে কিছু বুঝতে পারেনি। সামনের উঁচু জায়গাটা থেকে কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুসহ আরো অনেকের কথাই হয়তো বলছিল; যার অনেক কিছুই বুঝতে পারে না সে। খানিক বাদেই সেই উঁচু জায়গাটায় অনেক মানুষ উঠে আসে আর তখনই আবার চারদিক থেকে শেখ হাসিনা, জয়বাংলা চিৎকারে বিমূঢ় হয়ে যায় সে।

চারপাশ শান্ত হতেই সে পানি খেয়ে অবশিষ্ট চিড়া-মুড়ি আর নাড়ু পুটলিটা ভালো করে বাঁধে। কাঁধের ব্যাগে সেটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে শুনতে পায় মাইকে খুব রাগী রাগী কণ্ঠে কেউ কিছু বলছে। লোকটির পেছনে সার বেঁধে চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলোর মাঝে অনেক ফুল যার পেছনে একজন খুব সুশ্রী মায়ের মতো মায়াবী চেহারার নারী উঠে এসে বসলেন। পাশের লোকটিকে ফিরোজ জিজ্ঞেস করে, শেখ হাসিনা ক্যাডায় গো?
- ওই যে, ফুলগুলার পিছনে দামী চেয়ারটায় বইসা আছেন। মাথায় ঘোমটা, চোখে সোনার চশমা।
তাইলে প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কই?
কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না তার। বরং চিৎকার করে লোকটা মাইকে কী কী বলছে তা শুনতেই মনোযোগী হয় আরো। কিন্তু দু একটি শব্দ ছাড়া বেশিরভাগই তার কানে শব্দজট ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

তার আবার চিড়া-মুড়ি খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ব্যাগে হাত দিলেও চিড়া-মুড়ির পুটলি বের করা হয় না তার। একটি বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে যায়। পরপর আরো কয়েকটি বিকট শব্দ শুনতে পায় সে। তারপরই যেন হাজার বছরের নৈঃশব্দ্য গ্রাস করে তাকে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। চারপাশ অন্ধকার বলে বুঝতে পারছে না চোখ দুটো খোলা কি বন্ধ। এমন কি এও বুঝতে পারে না, সে বসে আছে কি শুয়ে আছে।

গলাটা বারবার শুকিয়ে আসছিল। পাশেই পানির বোতলটা ছিল কিন্তু হাত নাড়াতে না পারলে বোতল তুলবে কিভাবে? খুবই নিঃশক্তি লাগছিল তার। তাই শুয়ে পড়ে সেখানেই। পানি পিপাসা ছাপিয়ে যেন রাজ্যের ঘুম এসে জাপটে ধরে তাকে।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;