নিদাঘ



পাপিয়া জেরীন
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

না! গাছের উপর পাখি বা কাউয়া কোনোকিছুই নাই। তারপরও কিছুক্ষণ পরপর ছিটা ছিটা পানি পড়তেছে। এইটা তো কাঠবাদাম গাছ, আগার দিকের কয়েকটা পাতা লাল। কিসের পানি কে জানে। একটু আগেই ঘাসের উপর দিয়া পেটমোটা কাঠবিড়ালী দৌড়াতেছিল, পাতার ফাঁক দিয়া কাঠবিড়ালী মুততেছে নাকি? এই পার্কে সবগুলা বেঞ্চ বুক্ড হয়া আছে। দশ-বিশ কদম দূরে বটগাছের গোড়াটা পাকা করা, সেইখানে বসা যায়। প্রবলেম হইল, সেইখানে একটা মেয়ে বসা। মেয়েটার সামনে ছোলা, পপকর্ন, চা, চানাচুর, আচার—দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস। সেইগুলা সে একটু একটু কইরা চইখা রাইখা দিতেছে। হাতে একটা আমড়া, আমড়া শেষ না হইতেই চিৎকার দিয়া উঠল—চাচা, ঝালমুড়ি দেন। মেয়ের চাচা খালি পার্কে পাক খাইতেছে—এইদিকেও আসছিল কয়েকবার। অতনুর দিকে সরু চোখে তাকায়া কী জানি বলতে গিয়াও বলল না।

মেয়েটাও তার দিকেই তাকায়া কেমন কইরা পায়ের মাঝখানের আঙুলটা নাচাইতেছে... একবার আঙুলটা বুড়া আঙুলের উপরে উঠায়, আবার বুড়া আঙুলের নিচে নামায়। মাঝখানের আঙুলটা অসম্ভব লম্বা আর চিকন, দেখলেই গা হাত পা শিরশির করে। দিদিমা বলত, পায়ের মাঝখানের আঙুল লম্বা হইলে নাকি অঢালা টেকাপয়সার মালিক হওয়া যায়। অতনুর নিজের আঙুল দুইটাও অনেক লম্বা।

আবারও ঘাড়ের উপর পানির ছিটা পড়তেছে। অতনুর ভয় ভয় লাগতেছে। সন্ধ্যা নামতেছে, গাছের উপরে কাকপক্ষী কিচ্ছু নাই। ফরিদের উপর চরম মেজাজ খারাপ হইতেছে তার। একঘণ্টা ধইরা বইলা যাইতেছে... এই তো দাদা! আর পাঁচ মিনিট বসেন, আমি কাছেই—আইসা পড়ছি।

ফরিদরে নিয়া সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারতেছে না। সাথীর সাথে ব্রেক-আপের মূল হইল এই ফরিদ। সাথী ওরে দেখলেই মেজাজ খারাপ করত, আরো আজব ঘটনা হইল ফরিদ সাথীরে সহ্যই করতে পারে না। এইটা এত এক্সট্রিম পর্যায়ে গেছিল যে, ফরিদ একবার বইলাই ফেলল—
‘দাদা, তুমি ব্রাহ্মণ। মা-বাপের একমাত্র পোলা, কত আশাভরসা কইরা রাখছে। তারা কি মাইনা নেবে? আর এই যে সাথী আপা—সে তো টাইম পাস্ করতেছে তোমার লগে। সে বিয়া করবে তাগো ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই জাকিররে। সব খবর লওয়া শেষ আমার।
সেগুলা নাইলে বাদ দিলাম, তোমারে কোন দিনটায় শান্তি দিছে কও তো। দুই মিনিট পরপর লোকেশন চেক করে। ফোন ধরতে দেরি করলে কী করে তা তো আমি নিজেই দেখছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভিডিও কল দিয়া দেখাইতে হয়—কই আছো, কার লগে আছো। ফেবু পাসওয়ার্ডও তার কাছে। এগুলা কি প্রেম? মাথা বেইচা দেওনের নাম প্রেম?’

ফরিদের কথায় যুক্তি আছে, অতনু বুঝে এইসব। কিন্তু সাথীরে রিপ্লেস করা যায় না। সে ভালোবাসে তারে। অন্য কোনো মেয়ের কথা চিন্তাও করা সম্ভব না। একবার এই ফরিদ এক মেয়ের সাথে পরিচয় করায়ে দিল, মালবিকা কুন্ডু নাম। দুই দিন অতনু কথাও বলছে, কিন্তু কোনোভাবেই জমে না। মাথায় খালি সাথী ঘুরপাক খায়।

এই যে আঙ্কেল! অনেকক্ষণ ধইরা ভাবতেছি একটা কথা কমু। আমার মানিব্যাগটা হারাইছি এইখানেই। বিকাল থেইকা খুঁজতেছি খেয়াল করছেন মনে হয়।
- ও আচ্ছা। আমি দেখি নাই।
- কাছেই বাস-স্ট্যান্ড। দিঘির পাড়ের বাস। নয়ডা বাজলেই বাস বন্ধ। বহুত বিপদে পড়ছি আঙ্কেল। ষাইট টেকা কইরা টিকেট। যদি একটু হেল্প করতেন। বাড়িত গিয়া আপনের বিকাশ নম্বরে...
- ও...কিন্তু!
- কিন্তুমিন্তু কইয়েন না বাবা। জুয়ান ভাতিজী নিয়া রাইতে কই থাকুম কন! পায়ে ধরি, একটু দেহেন। দুইশো টেকা দেন। আমার ভাতিজীরে আপনের পাশে বসায়া দিয়া যাই। আমি ধরেন এই গেলাম আর এই আইলাম। এই সামনেই দিঘির পাড় বাসস্ট্যান্ড।
- এই যে দুইশো টাকা। কিন্তু ভাতিজী রাইখা যাবেন মানে? এরে রাইখা যাবেন ক্যান? না না! এরে নিয়া যান।
- (ওই রুজিনা এইমিহি আয়া বয়) আংকেল, বুঝবেন না কী জ্বালায় আছি। একটু দয়া কইরা বইতে দেন।অতনুর মাথায় কিছু ঢুকতেছে না। সবকিছু এমন আচানক হইতেছে, সব কন্ট্রোলের বাইরে। রুজিনা তার পাশে বসা। শরীরের রং ছাইবর্ণ মেয়েটার, ঠোঁটটা আরজিনার শরীরের মতো চিকচিক করতেছে। নাকে সাদা পাথরের নাকফুল, সেইটাও হীরার মতো চিকচিক করতেছে। চোখে টানা কাজল। কালো মানুষ এত সুন্দর হয় কেমনে? দূরে যখন বইসা ছিল এত কালো তো লাগে নাই! আাচ্ছা, সে কি কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের ট্র্যাপে পড়ছে? ঐ চাচামিয়া তার ভাতিজীরে ক্যান তার কাছে দিয়া যাবে!

এই যে শুনছেন! আর কতখন বসায়া রাখবেন? চলেন ঐ দিকটায় যাই। ঝোপের পিছনেই আন্ধার।
- কী কও এগুলা। ঐ ব্যাটা কে তোমার? চাচা না!
- চাচা, তয় হেই চাচা না। রাইতে এই চাচা নাগর হইয়া যায়। তাতাড়ি চলেন তো!
- এই মেয়ে, চুপ থাকো।
আরে ফরিদ! তরে যে কী করতে মন চাইতেছে।- ওয়াও দাদা, ব্রেকাপ হওনের লগে লগেই শুরু হয়া গেছে! ব্রাভো। রিয়েল ম্যান!
- কী কছ্! এই মেয়েরে তার চাচা আমার কাছে জিম্মা রাইখা সামনের বাসস্টপে গেছে টিকেট কিনতে।
- অতনুদা, তুমি এহনও সত্য যুগেই আছো। এই মাইয়া স্লাট, আর তার কথিত চাচা পিম্প। এগুলা এইখানে নতুন নাটক শুরু হইছে। এরা বুইঝা ফেলছে কম্পিটিশনের যুগ, আর পুরুষেরা শিকার করতে ভালোবাসে। এইজন্য ভোলাভালা সাইজা কাস্টমাররে একধরনের বিনোদন দেয়। একচুয়ালি এরা প্রফেশনাল.....
- জ্বী ভাইজান! আপনের অনেক বুদ্ধি। আর একশো টেকা বাড়ায়া দেন। চলেন তিনজনে মিলা ঝোপের দিকে যাই। আমার লগে গাঁজাও আছে। চলেন চলেন।
- এই মেয়ে! থাপ্পর খাইছো?
দেখছস্ ফরিদ, কেমন সাহস! ঐ যে অর চাচা আইতেছে। অখনি সব ক্লিয়ার হয়া যাইব।
- ঐ মিয়া, তোমার ভাতিজী কী কইতেছে এইসব? দালালী তো ভালোই শিখছো।
- আংকেল এই নেন আশি টেকা। আর লাগব না। পকেটে যা ভাংতি আছে রিকশা ভাড়া হইয়া যাইব। ও আল্লা! রুজিনা কী কইছস? বেদ্দবী করছস?
- ভালোই ব্যবসা। দেখি টিকেট দেখি।
- এই যে ভাই দুইটা টিকেট।

ফরিদ ভালো কইরা টিকেট দুইটা চেক করতেছে। অতনুর মাথায় আবারও কয়েক ছিটা পানি পড়ল। মেয়েটারে এখন আর অতো কালো লাগতেছে না কেন কে জানে। ফরিদের তর্কাতর্কি আর ভাল্লাগতেছে না। অতনুর কী করা উচিত, সাথীরে আরেকবার ফোন দিবে? ফোন ধইরা যদি আবার ফরিদের গলা শুনতে পায়, তাইলে তো আরেক ভেজাল। আট বছর ধইরা এই প্রেম, এই সাথীরে ছাড়া সে কেমনে থাকবে! ফরিদরেই বরং বুঝায়া বলতে হবে। ফরিদ বুঝে সব, ওরে নিয়া ঝামেলা। তারপরও সে অতনুর পিছ ছাড়ে না। আকার ইঙ্গিতে অনেকবার বুঝাইতে চাইছে অতনু। কিন্তু ফরিদ ইচ্ছা কইরাই আঠার মতো লাইগা থাকে।

এই যে! আপনের বন্ধু কথার তালে পইড়া চাচামিয়ার লগে দূরে যাইতাছেগা। চলেন এই সুযুগ কাজে লাগাই। এই লন প্যাকেট, ব্যানানা ফ্লেভার।
- দূরে সইরা বসো রুজিনা। এক থাপ্পর খাইবা।
- আরে আসেন না।
- ঐ ফরিদ! আমি গেলাম, তুই থাক এগো লইয়া।

অতনু শরীর ঝাড়া দিয়া উঠে। রুজিনা হিহি কইরা হাইসাই যাইতেছে। অতনু পিছ ফিরা তাকাইতেই রুজিনা একটা বাজে ইঙ্গিত কইরা চোখ টিপ মারল। অতনুর মন খারাপ হয়া গেল। সাথীও হাসতে হাসতে এমন চোখ টিপ দেয়। সাথীর আরেকটা বদভ্যাস আছে, কথা বলতে বলতে অতনুর শার্টের বুতাম ঘুরানো। কত বুতাম যে ঢিলা হইয়া আছে, কতগুলির বুকের দিকে বুতামই নাই।

সাড়ে আটটা বাজে। অতনুর কেন জানি হলে যাইতেই ইচ্ছা করতেছে না। এই কাছেই পল্টনে নাকি ফরিদের মামার বাসা, সেইখানে গেলেও হয়। ফরিদের অবশ্য রাজি হওয়ার কথা না। সাথী একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করছে, ফরিদের বিষয়ে স্পেসিফিক কোনো তথ্য জানা নাই। যেমন ফরিদ কই থাকে, দেশের বাড়ি কই, কই পড়াশুনা করছিল। অথচ এই ফরিদ অতনুর বাড়ি তো আছেই, শরীয়তপুরে তার পিসির বাড়ি পর্যন্ত ঘুইরা আসছে।

আর কতক্ষণ এমন দাঁড়ায়া থাকতে ভাল্লাগে। ঐ বেটার সাথে কিসের এত কথা? ভাতিজীর দালাল হইলে হউক। ১২০ টাকা খাইলে খাউক। ধুর! অতনুর হাতে প্যকেটটা রইয়া গেছে। আজব... এইটা তো ম্যাগী নুডুলসের মশলার প্যাকেট! রুজিনা মেয়েটার বিষয়টা আসলে কী! মেয়েটা চরম ফাজিল আর অফকোর্স সে পতিতা না। পার্কের ভিতরে গিয়া আরেকবার কি রুজিনার সাথে কথা বলা উচিত? মেয়েটার প্রবলেমটা কী আসলে!

দাদা চলো। অনেক চাপাচাপি কইরাও শালার থিকা টাকা বাইর করতে পারলাম না। তবে সে বিকাশ করবে। আমি আমার নম্বর দিছি।
- ফরিদ, মেয়েটারে যা ভাবছস, তা না।
- দাদা, কাহিনী তো খারাপ। তোমার হইছে কী? আহো রিকশা লই, হলে দিয়া আসি। ভাইগ্য ভালো তোমার, আজকা সাথী আপা ভিডিও কল দেয় নাই। হাহাহা।
- আজকে হলে যাইতে ইচ্ছা করে না, ফরিদ। চল তোর মামার বাসায়।
- হে হে, আমারেই তারা রাইতে জায়গা দেয় না। লগে তুমি গেলে ত খবরই আছে। এর চাইতে চলো সামনের মাজারে গিয়া শুয়া থাকিগা। সকালে উইঠা সোনারগাঁ বেড়াইতে যামু। আমার মামতো ভাই জসীমের একটা মটর সাইকেল আছে, সেইটা দিয়া রওনা দিমুনে।
- হ, যাওয়া যায়। ঐ দিকটা ঘুইরা টুইরা পরে ট্রলার দিয়া বাড়িত যামু। মারে জানায়া রাখি তাইলে।
- হুররর্ দাদা! এতো আগেই জানানের দরকারডা কী?
তুমি আসলেই! সেইবার নীলগিরি যামু বইলা টেকাপয়সা জমা দিলাম, আর তুমি গিয়া সাথী আপারে জানাইলা। হেয় দিল ব্যাগরা।
- ওহ, সাথীরে ফোন দেওয়া দরকার।
- তাইলে তুমি হলে যাওগা। সে সাথীরে ফোন দিবে। সাথীর বিয়া সামনের সপ্তাহে, বুঝলা? পাত্র ডেনমার্কে থাকে।
- হু, বলছে আমারে।
- কখন কথা কইলা?

অতনু জবাব না দিয়া হনহনায়া হাঁটতে থাকে, বিরক্তিতে মুখ তিতা হয়া যায়। এত খবর ফরিদ জানে কেমনে? ওর জানারই বা দরকার কী? এর আগেও সে এই কাজ করছে। সাথী কই, কোন পোলার লগে বইসা... কোন রঙের জামা পইরা কী কী খাইতেছে সব ডিটেইলে জানাইত। এমনভাবে কইত, মনে হয় এই কামের জন্য ওরে অতনু পে করে। এখনো সে পিছে পিছে আসতেছে আর সাথীর বিয়া বিষয়ক সব তথ্য দিয়াই যাইতেছে। একবার কী হইল, সে সাথীর বিষয়ে গোপন এক্সক্লুসিভ সব তথ্য যোগাড় করছে। মোবাইলে ভিডিও কইরা আনছে সাথীর গাঁজা খাওনের সিন। অথচ এই কাহিনী নতুন না, অতনু জানে এইসব।

হাঁটতে হাঁটতে মাজারের সামনে আইসা দাঁড়াইছে অতনু। ফরিদ একটু দূরে মোবাইল কানে, আঙুল নাড়ায়া সে অতনুরে মাজারে ঢুকতে বলে। ভিতরটা ধুঁয়ার আন্ধার, খিচুরী রান্না হইতেছে। যেই মহিলা রানতেছে, তার একটা হাত দেখা যাইতেছে। তার বিশাল এক ঘোমটা, লাল কাপড় দিয়া সারা শরীর ঢাকা। অতনু হোগলায় বইসা রান্ধুনীর কারবার দেখে। সে পিতলের হাতায় কইরা চাইরবারে একেকটা মালসায় খিচুরি বাড়তেছে। অথচ দুইবারে এইটুক খিচুরি দেওন যায়। একটা সময় সেই মহিলা তারে ইশারায় ডাকে। আশেপাশে ফরিদরেও দেখা যাইতেছে না। অতনু আগায়া যাইতেই হাতে মালসা ধরায়া দেয়।

বাবা, আপনে তো তুলারাশি, এত রাইতে ঘরের বাইরে কেন?
- তাজ্জব ব্যাপার! আপনে পুরুষ মানুষ?
- হ বাবা, আমি আগুন আর ধুঁয়া সহ্য করতে পারি না। কিন্তু রান্দনের কাজটাও আবার আমারই।
- আমার রাশি তো তুলা না, মেষ। ধুয়া সহ্য করতে না পাইরা ঘুমটা দিছেন ঠিক আছে, কিন্তু খোঁপা কইরা ফুল মাথায় লাগাইছেন যে!
- সবকিছু আজকেই জানা লাগবে? বাবা, আপনারে একটা কথা বলি, মিলায়া দেখেন। সবার জন্য ছয় ঋতু, কিন্তু আপনের জন্য এক ঋতু। আপনে শীত কী জিনিস আজও অনুভব করেন নাই। আপনে নিদাঘ, আগুনের হলকা। আপনের জন্য এই দুনিয়ায় খালি গ্রীষ্মকাল আছে।
- ও, তাই!
- বাবা, সামনে আপনের বিপদ। অঙ্গহানি। এই বিপদ আপনে কাটাইতে পারেন এক শর্তে। এই মাজার থেকা তিনদিন বাইর হইবেন না। প্রচুর গরম লাগব, প্রচুর ডাক আসব... কিন্তু এই মাজারে পইড়া থাকতে হইব।
- আইচ্ছা ঠিকাছে। আমার সাথে বন্ধু আছে একজন। তারে বইলা দেখি।
- ভুল করতেছেন বাপধন, আপনের বন্ধু নাই।

লাল কাপড় পরা লোকটা ঝামটা মাইরা চইলা গেল। মনে হয় রাগ করছে। একটু দূরে গান হইতেছে, কয়েকজন লোক কেমন কইরা নাচতেছে। গান ও নাচের ধরনটা সিলেটী গো ধামাইল দেওয়ার মতো। অতনু খাওন হাত দিয়া সরায়া রাখে, ঘুমে চোখ ঢইলা পড়তেছে। ফরিদের বিষয়টা বুঝতেছে না সে, টানা এককঘণ্টা মোবাইলে ফিসফিস করতেছে। তার কোনো কথাই স্পষ্ট শোনা যায় না, মাঝেমইধ্যে শুধু ‘অপরেশন’ শব্দটা একটু শোনা গেল। অতনুর খুব পানির তিয়াস, ঘুমের ঘোরে চাইয়া সে ফরিদরে কয়েকবার ডাকে। ফরিদ কোত্থাও নাই।

সকাল আটটা বাজে। দুইটা লোক মাজারের ফ্লোর ঘইষা ঝকঝকা কইরা ফেলছে। তাদের কানেও ফুল গোঁজা। মনে হয় ফুল নিয়া এই মাজারে কোনো আচার আছে। অতনু মোবাইলের দিকে তাকায়ে দেখে সাথীর কল।

তুমি কই?
- বলা যাবে না, জানলে রাগ করবা।
- তুমি ব্রোথেলে, আমি জানি। তুমি মানুষ না। অতনু তুমি তলে তলে কতদূর যাইতে পার জানতাম। এইজন্যই.....
- থামো তো তুমি। আমি একটা মাজারে আছি, রাতেও ছিলাম এইখানে।
- তুমি সারারাত প্রস্টিটিউটের সাথে ছিলা। খবর পাইছি আমি।
- সাথী, প্লিইজ। তোমার এই সন্দেহ বাতিক নিয়া জীবনেও সুখী হইতে পারবা না।
- একদম চুপ, শুওরের বাচ্চা। কোনো যোগাযোগ করবি না আমার সাথে।
- সাথী!

অতনুর ঘাম দিয়া সারা শরীর গোসল হয়া গেছে। মাথা দিয়া খালি আগুন বাইর হইতেছে। গোসল করতে পারলে মাথাটা ঠান্ডা হইত। মাজারটায় গোছলের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ফরিদ সমানে চিল্লাইতেছে। সে মামাতো ভাইয়ের কাছ থিকা বাইক আনছে, এখন তার মামার বাড়িতে নাকি তুলকালাম কাণ্ড। এখন যেইটা করতে হইব সেইটা হইলো তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া, আর সোনারগাঁ ঘুইরা টুইরা বিকালের মইধ্যে বাইকটা ফিরত দেওয়া। কিন্তু অতনুর কোনোখানেই যাইতে ইচ্ছা করতেছে না। গতরাইতের রাইন্ধইন্যা লোকটা আগায়া আসতেছে তার দিকে। এখন তারে লুঙ্গি ফতুয়ায় নরমাল লাগতেছে। সে কথা বলতেছে না, হাতে ইশারায় থাকতে বলতেছে। এই লোকের হাতে যে চাইরটা আঙুল সেইটা গতরাতে চোখে পড়লো না ক্যান! আজব!

দাদা, তুমি কি আসলে যাবা? চলো তো। যেইখানেই যাও, লেটকা মাইরা বইসা পড়ো।
- ফরিদ, মাজারের খাদেম আমারে তিনদিন থাকন-খাওনের দাওয়াত দিছে। জায়গাটা পছন্দ হইছে আমার।
- অতনু দা, সবারই লাভ-লাইফে ঝামেলা হয়। সেইজন্যে এমন করবা তুমি? এই মাজারগুলি হইলো দান্দালের জায়গা। পয়সার লাইগা এমন কাহিনী করে অরা।
- তা ঠিক। কিন্তু আজব ঘটনা আছে একটা। ঠাকুরদা আমার কুষ্ঠী করছিল নিজ হাতে। কাগজের পিছনে লাল কালি দিয়া ‘নিদাঘ’ শব্দটা লেখা। অনেকরেই এই বিষয়টা দেখাইছি, কেউ কিছু বলতে পারে নাই। অনেকদিন পর এই লোকের মুখে এই শব্দটা শুইনা আশ্চর্য হইছি। সে স্পষ্ট বলছে—তুমি নিদাঘ।
- তুমি না, অতনু দা! এই যুগে কুষ্ঠী আর মাজার নিয়া আসলা? ওকে বুঝছি, তুমি যাইবা না। আমি গেলাম জসীম ভাইয়ের কাছে, বাইক দিয়া আসি।
- না, চল যাই। ঐদিক দিয়া বাড়ি যামু।

সাত দিন পর

গায়ত্রী সান্যাল ছেলে অতনুর পায়ের কাছে বসা। নার্স রেবা অতনুর অবস্থা নিয়া বলতেছে...

একটা লোক অতনুরে এমার্জেন্সিতে ভর্তি করানোর সময় নোট লিখা দিয়া গেছে। বাইক এক্সিডেন্ট, অতনু কোমরে আর পেটে আঘাত পাইছে। একটা ক্লিনিকে চারদিন ট্রিটমেন্টের পর অতনুর সঙ্গের জন মারা গেছে। তার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নাই বইলা বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করা হইছে।

গায়ত্রীর চোখে জল। ফরিদ ছেলেটা খুব ভালো ছিল। গত ঈদে ফরিদ অতনুরে মলম পার্টির হাত থেকা বাঁচায়া বাড়িতে নিয়া আসছিল। মাসীমা মাসীমা বইলা পাগল হয়া যাইত। আহা বেচারা।

অতনু ফরিদের বিষয়টা জানে না। অতনু জাইগা উঠার পর গায়ত্রী একবার এক্সিডেন্টের কথা জানতে চাইল, অতনু মনেই করতে পারতেছে না। সে বারবার বলে—মা! এক সাধু আমারে সাবধান করছিল। বলছিলো. ..নিদাঘ! নিদাঘ! দেখো মা আমার ভিতরটা কেমন পুড়তেছে।

সুদীপ বাবু রিপোর্ট নিয়া ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেছিল। তিনি বললেন, এগুলা এক্সিডেন্টের ইনজুরী না। অরগান মিসিং কেইস, অতনুর একটা কিডনি নাই। ডাক্তার দ্রুত পুলিশরে জানাইতে বলল। তার থেকেও জরুরি ওরে ঢাকায় কোথাও এডমিট করা। আরেকটা যে কিডনি, সেইটাও কাজ করতেছে না।

এইদিকে, ফরিদ চুল ফালায়া দিছে...দাড়ি বড় করতেছে। নতুন এ্যাসাইনম্যান্ট নিবে তিন মাস পর। এই কাজগুলিরে সে আর্ট হিসাবে নিছে। এগুলার প্রস্তুতি বিশাল জিনিস। অতনু, রশিদ, মিলা, নজরুল, বাদল, লিপি....এদের জন্য তার খারাপ লাগে না। আফটার অল, হি ইজ আ পারফর্মার!

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;