কলকাতার সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট

  • সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কলকাতার নিউমার্কেট।

কলকাতার নিউমার্কেট।

অখণ্ড বঙ্গদেশে বৃহত্তর ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাট থেকে রেল চলতো শিয়ালদহ পর্যন্ত। সেই ট্রেনে চেপে লোকে চলে আসতো কলকাতায়| ঢাকা গেলেই পীযূষ দা, মানে বিখ্যাত অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এতবার এই গল্পটা বলেছেন। চোখ বুজলেই যেন সেই দৃশ্যটা দেখতে পাই|

পীযূষ দা নিজে পাবনার আদি বাসিন্দা, সেই জন্য তাঁদের বিখ্যাত প্রতিবেশিনী রমা সেন তথা সুচিত্রা সেনের পাড়ার অনেক গল্পের সঙ্গে ট্রেনে চেপে কলকাতায় আসার স্মৃতিচারণটাও এত সিনেম্যাটিক ভাবে করেন, যে মনে হয় সামনে পুরোটা দেখতে পাচ্ছি! তখন মনে পড়ে যায় কত বাঙালি লেখকের গদ্যে গোয়ালন্দ ঘাটের অসামান্য বিবরণ আছে, পেটচুক্তি ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খাওয়ার বিবরণ পড়ে কতবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছি|

বিজ্ঞাপন

১৯৬৫ সালের যুদ্ধ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় নিয়মিত ট্রেন চলত| বাংলাদেশের অনেকের স্মৃতিতেই সেই ট্রেনযাত্রার স্মৃতি এখনও অমলিন। যদিও ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস আর শিয়ালদহ পর্যন্ত আসে না, নতুন তৈরি হওয়া চিৎপুরের কলকাতা স্টেশনই তার ডেস্টিনেশন| আর বাংলাদেশের মানুষদের নিয়মিত পরিচয় হাওড়া স্টেশনের সঙ্গে, বিশেষত যাঁরা কলকাতা এসে ভারতের দক্ষিণে যান চিকিৎসার কারণে| ঢাকার স্কুলশিক্ষিকা এবং লেখিকা শাহিন আরা সুলতানা যেমন হাওড়া স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে রাত্রিবাস করেও ভেলোরের জন্য ট্রেনে চেপেছেন পুত্রের চিকিৎসার প্রয়োজনে|

কিন্তু বাংলাদেশের থেকে যাঁরা কলকাতায় আসেন, তাঁদের অনেকেরই হয়তো জানা থাকে না নিউমার্কেট কে কেন্দ্র ধরে এপাশে শিয়ালদহ আর ওপাশে হাওড়া পর্যন্ত বৃত্তের পরিসীমা আঁকলে কলকাতার যে টুকু অংশ, তাকে নিয়েই যাবতীয় আবেগ আর ভালোবাসার ওঠানামা| অর্থাৎ, কলেজ স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গি কিংবা চাঁদনি চকের মতো এই শহরের রক্তবাহী ধমনীগুলোকে ছুঁয়ে নিতে পারা যায়| এটা ঠিক যে গত ৪০ বছরে কলকাতা আড়ে এবং বহরে অনেকগুণ বেড়েছে, ২০ বছরে শহরের পূর্ব প্রান্ত বরাবর প্রায় দুটো নতুন শহর তৈরি হয়েছে| কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি চিকিৎসার প্রয়োজন না হলে বাংলাদেশের মানুষদের পূবের রাজারহাট কিংবা মুকুন্দপুর যাওয়ার আগ্রহ থাকে না|

বিজ্ঞাপন

তাহলে সাহেবি পরিভাষায় যাকে বলে সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট, কলকাতার সেই পুরনো প্রাণকেন্দ্র বা হৃৎপিন্ডকে চেনাটাই বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য সবচয়ে জরুরি| আমি নিজে অবশ্য মনে করি কলকাতার সিবিডি টাকে যদি একটু প্রসারিত করা যায়,অর্থাৎ বিবেকানন্দ রোড থেকে পার্কসার্কাস, তার মধ্যেই কিন্তু শহরের প্রাণভোমরাটা লুকিয়ে আছে| এবং কি আশ্চর্য দেখুন, কেউ যদি কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোকে খুঁজে দেখতে চায়, মানে তাঁর ফুটপ্রিন্টকে অনুসন্ধান করে, তাহলেও তাঁকে এই বৃত্তের মধ্যেই ঘুরতে হবে| বাংলাদেশের যাঁরা কলকাতায় নিজেদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি খোঁজেন, তাঁদের আগ্রহের বৃত্তটাও একই পরিসরে থাকবে| মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দুগুলোও এই ভূগোলে অবস্থিত।

চলমান করোনা মহামারির পৃথিবী, বিভিন্ন বিধিনিষেধ এবং লকডাউন একটা জিনিসকে কিন্তু পরিষ্কার করে দিয়ে গেল, কলকাতার এই সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্টকে কিন্তু পায়ে হেঁটে ঘোরা সম্ভব| আমি অন্তত গত দেড় বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এই কথা হলফ করে বলতেই পারি| নিউমার্কেট এলাকা থেকে হেঁটে চৌরঙ্গি বা চাঁদনিচক চলে আসাটা কোনও বিষয়ই নয়| আর হাঁটতে ভাল লাগলে বা উল্টোটাও, ভালোবেসে হাঁটলে মার্কুইস স্ট্রিট থেকে এপাশে পার্কসার্কাস বা ওপাশে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে যেতেও বেশিক্ষণ লাগে না| মনের তৃপ্তির জন্য কলেজ স্ট্রিট মানে বই কিনতে, আর রসনার তৃপ্তির জন্য পার্ক স্ট্রিট বা পার্ক সার্কাসই তো এখনও বহুলাংশে ড্রিম ডেস্টিনেশন বা স্বপ্নের গন্তব্য|

ম্যানহাটনকে চেটেপুটে নিতে যেমন ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন থেকে হাঁটতে শুরু করে টাইম স্কোয়ারকে টপকে সেন্ট্রাল পার্ক চলে যাওয়াটাই দস্তুর, কলকাতাকে তেমনই পায়ে হেঁটে চেনাটাই সহজ| অন্তত কলকাতার সাবেক ও আদি হৃৎপিন্ডটাকে| এটা ঠিক যে স্মার্টফোন, গুগল চাচা এবং উবের এসে যাওয়ার পর যে কোনও শহরে ঠকতে গেলে বা বেওকুফ বনতে গেলে, ট্যাক্সিচালকের কাছে জবাই হতে গেলে বুদ্ধি লাগে| কিন্তু এই উপমহাদেশে আমরা অনেকেই যেহেতু সেই বিশেষ বুদ্ধি বা স্কিলের অধিকারী, তাই ঠকার চাইতে হাঁটা ভাল! তিলোত্তমা কলকাতাকে হেঁটে আবিষ্কার করাও এক নস্টালজিক প্রেমের সরণি ধরে পায়ে পায়ে চলার শামিল!

সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।