কবি সাঈদ চৌধুরী- তার কবিতা



বাছিত ইবনে হাবীব 
কবি সাঈদ চৌধুরীর আত্মার অলিন্দে

কবি সাঈদ চৌধুরীর আত্মার অলিন্দে

  • Font increase
  • Font Decrease

(এক)

কিছু কবি থাকেন একান্ত নিজের মতো। বিচিত্র বোধের দিগন্ত ঘুরে এসে খুঁটি বাঁধেন নিজের রুচির বীজতলায়। এখানেই বোপন হয়, রোপণ হয়, চাষ হয় নিজস্ব চিন্তা চেতনার। যাদের আলোকিত অবদানে নিজেরা হৃদ্য, ঋণ স্বীকার করতে গিয়ে তাদের প্রতি দেখান অকৃত্রিম সম্মান ও ভালোবাসা। কবিতায় প্রকাশ করতে  চান তাদের অমরত্ব। সাঈদ চৌধুরীর কবিতা পড়লে আপাতত তা-ই মনে হবে নবীন পাঠকের। যদিও এটা  একটা স্টাইল বা তাঁর কাব্য ঠিকানা আবিষ্কারের একটি সুন্দর  চাবি। সাঈদ চৌধুরীর ভার্চুয়াল আকাশে ভাসানো ৫২টি কবিতার মধ্যে দুটো কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যকোবিদ আল মাহমুদকে নিয়ে।

(দুই)

সব কবির স্থান সব কবির হৃদয়ে হয় না। সাঈদ চৌধুরীর ‘আত্মার অলিন্দে’ নিজ কাব্যগুণে স্থান পাওয়া কবিদের ভিড়ে আল মাহমুদ উজ্জ্বলতম। তাঁর তাবৎ সৃজনশস্য পাঠককুলের সেবনোপযোগি করে একটিমাত্র কবিতার থালায় রাখার বিরল প্রচেষ্টা, ‘রুপালি আলোয়' কবিতাটি ছড়াচ্ছে কবি’র প্রতি কবি’র অপার ভালোবাসা। ছড়াচ্ছে এক নিমিষেই আল মাহমুদের অনুপম আলো।  

‘তুমি এলে আগুনের ফুলকির মতো/ রৌদ্র কিরণে ঝলসিত চারিদিক/ উচ্ছ্বাস আনন্দ ছড়িয়ে মুখরিত/ ছেলেবুড়ো আনন্দে দিক-বিদিক।/ উনুনের ধার ঘেঁষে দাই মা/ আয়াতুল কুরছি পড়ে/ আগুনের আঁচে বসে তা দেয়/ সফেদ কাপড়ের ভাজে, জিন-ভূত/ যেন আসেনা ঘরে।/ ছায়ারৌদ্র মেঘের খেলা/ বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে ওঠে/ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।

গ্রীষ্মের দাবদাহ মুছে যায়/ সোনার রবি ছড়ায় কিরণ/ মরু মুষিকের উপত্যকা’য়।/ যেভাবে বেড়ে ওঠি প্রাণের স্পন্দনে/ জ্যোতিস্রোতে মিশেছে প্রিয় স্বদেশ/ জীবন্ত মুক্তিসংগ্রামে কাবিলের বোন/ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাল বোনে উপমহাদেশ।/ কবির আত্মবিশ্বাস কবির কররেখা/ আগুনের মেয়ে অর্ধেক মানবী/ নিশিন্দা নারী যতই হোক দেখা।/ কবির সৃজন বেদনা কবিতার আঁচল/ দশ দিগন্তে উড়াল ডাহুকী দিনযাপন/ কবিতার জন্য বহুদূর কবি ও কোলাহল।/ তুমি, আরব্যরজনীর রাজহাস/ আমি, দূরগামী/ প্রহরান্তের পাশ ফেরা এক চক্ষু হরিণ/ পাখির কাছে ফুলের কাছে/ কালের কলস- কিরণ ছড়ায়।/ তুমি, সোনালি কাবিন/ মায়াবী পর্দা দুল ওঠো/ বখতিয়ারের ঘোড়া’য়।/ তুমি, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না/ প্রহরান্তের পাশফেরা, দোয়েল ও দায়িতা/ লোক লোকান্তর- বিদ্যুৎ চমকায়।

তোমার ভরাট গলার সুকণ্ঠ উচ্চারণ/ মেঘমালা হয়ে উড়ছে হাওয়ায়/ শ্যামল শ্যামল নীলিমায়।/ সৌরভসিক্ত আল মাহমুদ/ বাংলাভাষা হয় গতিময়/ তোমার দৃপ্ত রুপালি আলোয়।’  

না। এতটুকুতে পূরণ হয়নি আল মাহমুদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভালোবসার ক্ষুৎপিপাসা। 'আত্মার অলিন্দে' বইটির আরেকটি কবিতা নিবেদিত ‘আল মাহমুদ, আকাঙ্ক্ষার তীব্র মেঘমালা’।

’আমি দুর্দান্ত ধূসর সমভূমিতে/ মধ্যরাতে দ্রুত হেটে যেতে যেতে/ একটি ছায়ার সামনে দাঁড়িয়েছি।/ তোমার পায়ের চিহ্ন, সফেদ চেহারা/ আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি!/ তোমার দর্শনে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে/ যেখানে পুরুষ এবং মহিলারাও ছিল/ কোথায় চলে গেল, তোমাকে দেখেনি?/ তোমার কবিতার সুকন্ঠ উচ্চারণে/ আমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল।/ ভালবাসার পরিপূর্ণতায় যেন আবদ্ধ/ উল্লাসে ঝলমলে তারকার তরঙ্গগুলি/ এই মহিমাময় পৃথিবী ও মঙ্গলগ্রহ।/ তুমি বলেছ, চাঁদের মাঝখানে চিত্র আছে/ বাংলার স্বাধীনতার পতাকার বৃত্তের মত।/ সবুজ গাছের পর মনোরম চারণভূমি/ পাহাড়ের গায়ে ঝলমলে চাঁদের আলো/ অভ্যন্তরীণ চোখে এক ঝলক দেখা হলো!/ আমার জন্য এটাই নির্জনতার আনন্দ/ আল মাহমুদ, আকাঙ্ক্ষার তীব্র হে মেঘমালা!’

নজরুলের আগমনও সাঈদ চৌধুরীর 'আত্মার অলিন্দে' সতঃস্ফুর্ত ঝড়ের মতো। ‘শৈল্পিক সুষমায় নজরুল‘ কবিতায় তা পরিস্ফুটিত হয়েছে।  বিশিষ্ট আবৃত্তিকার নাসিম আহমদের কন্ঠে যা ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

’কবি নজরুল, তুমি প্রভাতের সোনালী সূর্য/ এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, অন্য হাতে রণতূর্য/ শুদ্ধ অনুভবের অনাবিল শৈল্পিক সুষমায়/ তুমি জন্মেছিলে নান্দনিকতার শ্রাবণ ধারায়/ কুয়াশা ভেজা সন্ধ্যা ও মুঠো ভরা জোৎস্নায়/ গোলাপের কলিতে আর শিশির সিক্ত সবুজ ঘাসে/ বৃষ্টির ফোটা গুলো ধরতে তুমি আপন ভালবাসায়।/গ্রীষ্মের রোদেলা তপ্ত দুপুরে নিস্পেশিত/ নিপীড়িতের প্রতিবাদী কন্ঠে তোমাকে পাই/ অলঙ্করণে অভিনব সৌন্দর্যে সুশোভিত/ কবিতার পরতে পরতে জীবনের জয়গান গাই/ এক অপূর্ব মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়/ তোমার সাথে আমার ভাবের লেনাদেনা হয়/ প্রতিদিন সুবহে সাদেকে আর গোধূলী বেলায়।/ তিমির রাত বিদূরিত, নব প্রভাতের অরুণোদয়/ আলোকে উদ্ভাসিত বাংলা, বিদ্রোহী কবির অভ্যুদয়/ সার্বভৌম চেতনা ও প্রেরণায় জাতীয় কবি নজরুল/ বাংলার গৌরব, কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রস্ফুটিত ফুল/ বিরহ-বেদনায়, বিদ্রোহের তেজোদীপ্ত উত্তেজনায়/ পরাধীনতার শৃঙ্খলে ও স্বাধীনতার জ্বলন্ত অগ্নিশিখায়/ মায়াময়-ছায়ায় এক ব্যঞ্জনার প্রাণদীপ্ত জীবন ধারায়।’

’সৃষ্টির হিরন্ময় বিস্ময়’ কবিতায় সাঈদ চৌধুরীর ভাষায় পাই নজরুলের প্রাণময় ঢেউয়ের আওয়াজ-

’কাজী নজরুল, বিদ্রোহী কবি স্বমহিমায় উজ্জ্বল/ বাংলার জাতীয় কবি, অপূর্ব বর্ণাঢ্যতায় সমুজ্জ্বল/
নিরন্ন বুভুক্ষ ও বঞ্চিত মানুষের প্রেরণার আশ্রয়/ জাতির মননে আন্দোলিত সৃষ্টির হিরন্ময় বিস্ময়।/ কাব্য সাহিত্যের যুগস্রষ্টা, অমৃত অহঙ্কার/ ব্রহ্মাণ্ডের দ্যুতিময় প্রেমময় শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার/ বহুমাত্রিক কবিতায় অগ্নিঝরা বিদ্রোহের সাজ/ বর্ণিলতা মিশ্রিত যেন প্রাণময় ঢেউয়ের আওয়াজ।/ কবিতার শরীরে প্রাণবন্ত বসন্তের তাজা ফুল/ ময়ূরের অলঙ্কারে যেন সাজানো কানের দুল/ জ্বলজ্বল চোখে বিরহ, বিপ্লব, দ্রোহ মানবতাবাদ/ কী এক মধুর তানে বহুমাত্রিক কাব্যের চাষাবাদ।/ সৌরভে গৌরবে সৌন্দর্যের নিরন্তর প্রেরণায়/ গজল সঙ্গিতে পথিকৃৎ পরম অধ্যাত্ম চেতনায়/ অবিনাশী শক্তি, অমরত্বের সঞ্জীবনী আস্বাদন/ যুগ যুগ ধরে ছড়াবে কবিতার স্বাদ, অবগাহন।’  

(তিন) 

সমকালীন পৃথিবীর তাবৎ সমস্যা প্রায় প্রতিটি কবি মনে দুঃখ-প্রতিবাদের ঝড় তোলে। কবি সাঈদ চৌধুরীও এ দলের গর্বিত সদস্য। সত্য কথাখানা এই- যে তার সমকাল নিয়ে লিখে, সে প্রকৃতপক্ষে মহাকালের লেখক। 

সাঈদ চৌধুরীর 'আত্নার অলিন্দে' কবিতাগ্রন্থে অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতা আছে কোভিড ১৯ নিয়ে রচিত। যেখানে মানবজাতির প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। যেমন- বন্ধু আমার চলে গেছে অনেক দূরে/ তার স্মরণে নিরব শোকের কবিতা... (ক্ষমা করে দিও প্রিয়তম)

মা'কে নিয়ে রচিত কবিতাগুলো গ্রন্থটির মানচিত্রকে অনন্য উচ্চতায় উপস্থাপন করেছে। এই কবি অত্যন্ত সহজ ভাষায় মূল্যবান কথা বলার মুন্সিয়ানা আয়ত্ব করেছেন। যা তার কবিতা কৌশলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন- ‘মমতাময়ী মা’।

‘মা, তুমিই তো পৃথিবীতে স্মিত হাসিতে আমাকে স্বাগত জানিয়েছ। তুমি না বলেছিলে, আমার মহান পিতার আনন্দাশ্রু আলিঙ্গন ও আযান ধ্বনি সুবহে সাদেক মাড়িয়ে বাঙময় হয়ে উঠেছিল পূর্বাকাশের রক্তিমাভায়।/ মহান প্রভুর কাছ থেকে আমার পৃথিবীতে তৃপ্তি এনে দিয়েছ এবং আমার বিশ্বকে করেছ আলোকিত।/ মা, তুমি আমার মনটা আনন্দে আর জীবনটাকে ভালবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছ। প্রথম নিঃশ্বাস থেকেই আমাকে আলতো করে ধরে মাথায় বুলিয়েছ তোমার হাত।/ তুমিই তো শিখিয়েছ, কীভাবে প্রতিবেশীকে সালাম জানাতে হয়, নিকটাত্মীয় আর গরীব মানুষকে হাসি দিয়ে করতে হয় বরণ।/ মা, আমি প্রতিদিন বার বার তোমার হাতটি ধরতাম, গরীব ও এতিমের জন্য তোমার দানের কলসে চাল ভরে রাখতাম।/ তুমিই তো আমাকে বরকতময় কল্পনা শিখিয়েছ, কেমন করে স্বপ্নের জাল বুনতে হয়। আমার বাবার সাথে তোমার নিখাদ ও পরিতৃপ্ত ভালোবাসা, আমার ও আমার সন্তানদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আছে।/ মা, প্রতিদিন প্রতিমুহুর্ত তোমার চুম্বন ও স্মিত হাসি আর পিতার আনন্দাশ্রু আলিঙ্গন জন্ম দিনের গল্পগুলিকে করে রেখেছে স্মৃতিময়।/ বিদায় বেলাও তুমি আলতো করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছ। হাতগুলি ধীরে ধীরে আমার মুখ ও বুক ছুয়েছিল। স্পর্শ করেছিল হৃদয়। /রাব্বির হা‘ম হুমা- কামা- রাব্বায়া-নি- সাগী-রা।’

(চার)

কবিতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। কবিরা আহবান করেন চিরন্তন সত্য সুন্দরের পথে। ক্ষমতাবানকে বলেন- ক্ষমতার অপব্যবহার করোনা। বেপরোয়া রাজনীতিককে বলেন- টিকবেনা তোমার দৌরাত্ম্য। অতএব  সাবধান হও।

অসুস্থ সমাজদেহের ওপর কবি সাঈদ চৌধুরী'র দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। ‘মাফিয়াদের উল্লাস নৃত্য' কবিতায় তিনি বলিষ্ট সাহসিকতার সাথে দেশ ও সমাজচিত্র তোলে ধরেছেন এভাবে -

‘আনন্দশূন্য দেশের মানুষ, শ্রমজীবী মেহনতি জনতা/ লুটেরা হয়েছে আজ সমাজ ও জাতির ভাগ্য বিধাতা।/ হাতিয়েছে অঢেল সম্পদ, বেড়েছে অহমিকা ও আমিত্ব/ সার্বভৌম স্বদেশে চলছে শুধুই মাফিয়াদের উল্লাস নৃত্য।/ ক্ষমতার মদমত্তে জীবন কেটে যাবে অনাবিল আনন্দে/ আমজনতা থাকুক জ্বরাক্রান্ত, বিষাদ আর নিরানন্দে।/ হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে তারা জঘন্য পাশবিকতায় লিপ্ত/ অনাচার-পাপাচারে নেই কোন আত্মগ্লানি, নয় অনুতপ্ত।/ ঔদ্ধত্যের চিরকালীন অলিক স্বপ্ন হয়না কখনো পরিপূর্ণ/ পেতে হবে কৃতকর্মের মাশুল, দাম্ভিকতা হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ।/ ক্ষমতার আধিপত্যে যারা রাহাজানি আর লুটপাটে মত্ত/ দুঃসময়ে পাবেনা যে নিষ্কৃতির পথ, ওরা চির অভিশপ্ত।’

স্বাধীনতা একটি জাতির জীবনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ঘটনা। অর্ধ শতাব্দী কাল পেরিয়ে এসেও আমাদের  স্বাধীনতার দেহে রক্তপাত কবিকে নিষ্ঠুরভাবে আক্রান্ত করে। ‘রক্তাক্ত  স্বাধীনতা'  কবিতায় সাঈদ চৌধুরী বলছেন-

‘আগ্রাসন আর পরাধীনতা ছেয়েছে আজ পৃথিবীকে, দিকে দিকে/ সুবর্ণ জয়ন্তীতে রক্তাক্ত স্বাধীনতার দেহ, গুলিবিদ্ধ লাশ/ ট্রিগারে রাখা হাত, মোদিবাহি সন্ত্রাস!/ শাহাদাতের/ সুধা পান করে/ প্রতিবাদী জনতা।/ রক্ত দিয়ে উদযাপন/ রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা/ স্বাধীনতার সার্বভৌম পরাধীনতা!/ বাহারি আলোর ঝলকানিতে মেতেছে/ কিছু সংখ্যক দলদাস, আধিপত্যবাদের সেবাদাস/ অন্ধ-বধির আত্মহারা, তবুও তারা জ্ঞানের ফেরিওয়ালা!/ নরেন্দ্র মোদি, রক্তের হোলি খেলায় নেই কোন জুড়ি তার/ ধিক্ ধিক্ ধিক্কার! জাগ্রত জনতার। সংগ্রামী মমতার।/ তবুও নেই তার পরিতাপ! অফুরান অভিশাপ!’

এ বিষয়ে কবির আশাবাদ আমাদের দারুণ উৎসাহিত করে। ‘আলোকদীপ্ত’ কবিতায় তার উদ্ভাসিত উচ্চারণ- ‘তথ্য সন্ত্রাস আর পাকানো মিথ্যা দিয়ে/ কেউ তোমাকে ময়লা করে ফেলতে পারে/ তবুও, ধূলোর মতো তুমি উঠবে।/ কুকুরটিকে সরস হাড়ের সাহায্যে/ ঘেউ ঘেউ করা থেকে বিরত করো না।/ কোন বাঁকা পথ অনুসরণ করে নয়/ সত্য সেখানে, সমস্ত মিথ্যা যেখানে সমাপ্ত।/ রাত পোহাবে, সম্মুখে আলোকদীপ্ত বেলা/ রৌদ্রের কিরণে মিথ্যুক পালাবে নিৰ্জন পথে/ নিশ্চয়ই, সূর্যের মতো তুমি উঠবে।’

 (পাঁচ) 

বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে অবিকল্প আনন্দের বন্যা নিয়ে আসে। একজন প্রকৃত বন্ধু মানে একজন অকৃত্রিম সংগী, দরদী, হিতাকাঙ্ক্ষী ও দার্শনিক। জনৈক  কবি লিখেছেন- 'তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে পথভুলে তবু মরি/ তোমারে ছাড়িয়া মসজিদে গিয়া কী হবে মন্ত্র স্মরি।'

চরণগুলোতে যথেষ্ট আবেগ আছে। তারপরও বন্ধুত্বের গুরুত্ব অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে উদ্ভাসিত। কবি সাঈদ চৌধুরীর কবিতায় হারানো বন্ধুর কথা এসেছে অত্যাধুনিক পোশাক পরিধান করে- ‘আমি টিপটিপ বৃষ্টিতে তাকে মিস করি।'

 প্রেম -ভালোবাসাকে বলা হয় জীবনের পাল। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে এই পালের হাওয়া গায়ে লাগবেই। সাঈদ চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম নন। 'প্রতিদানহীন ভালোবাসা’ কবিতায় লিখেছেন- হৃদয়ের ঐ দূর আকাশে তাকিয়ে দেখো/ ভালোবাসা! শুধুই ভালোবাসা! প্রতিদানহীন ভালোবাসা!

এখানে তার উচ্চারণ কিছুটা কবি গোলাম মোস্তফার মতো- ‘আমার এ ঘর ভাংগিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।' প্রকৃত কবিরা প্রকৃত ভালোবসার চায় না কোনো প্রতিদান। 

(ছয়)

প্রকৃত কবিদের কাছে প্রকৃতি হলো পৃথিবীর স্বর্গ। কবিরা প্রকৃতিদেহ, এর কান্তিময় স্নিগ্ধতা অনুভব করেন অনেক গভীর থেকে। সাঈদ চৌধুরীর অনুভূতিও বেশ আকর্ষণীয়। পাঠক নিশ্চই ‘বর্ণের ঐশ্বর্য’ কবিতা পড়ে আনন্দ পাবেন।  

বসন্ত কিংবা শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায়/ কবিতা যেন বর্ণের ঐশ্বর্যে হৃদয়ের দুল/ সাধের গোলাপ বা রক্তজবা ফুল।/ কবিতা বিশ্রাম দেয় না, সুবহে সাদেকে/ সূর্য দিগন্তের উপরে চলে আসে অবিরত/ সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে যাওয়া সূর্যাস্তের মত।/ কবিতা তো প্রিয়তমার সাথে রোজ/ বিকেলে দুই কাপ চা, দুই বাটি স্যুপ/ সপ্তাহান্তে বারান্দায় মধ্যাহ্ন ভোজ।/ কবিতা তো আঙ্গিনায় বৃষ্টির আগমন/ দুর্দান্ত প্রাণময়তার উল্লাসে উপচে পড়া/ নির্মল ভালোলাগা-ভালোবাসা অগণন।/ কবিতার জন্যে যাই সবুজ পাহাড়ের কাছে/ হরেক রঙের অজস্র ফুল ফুটে আছে/ গাছগুলো অভ্র-উজ্জ্বল রং ধরেছে।/ শুভ্রতার জন্য পূর্ণিমা রাতে যাই চাঁদের কাছে/ আজ চাঁদ এসেছে আমার জানালার কাছে/ স্ফটিক চাঁদের আলো আমাকে ঘিরেছে।/ চন্দ্রালোকিত রাতের ঐশ্বর্যময় বর্ণাঢ্য শোভায়/ ইচ্ছেরা সব উড়তে দেখি, উচ্ছল উল্লম্ফন।/ হৃদয় জুড়ে ভালোবাসার প্রস্ফুটন।’

নিরাশার পৃথিবীতে কবিরা শোনাতে চায় আশার বাণী। যেমনটি সাঈদ চৌধুরী শুনিয়েছেন তার ‘মেলবন্ধন’ কবিতায়। 

’বহুকালের প্রতীক্ষা শেষে/ একটি সংবাদ এল আজ/ গ্রীষ্মের ঝরঝরে বাতাসে/ হৃদয়ে পরিতৃপ্তির আস্বাদ!/ খবরটির জন্য স্মৃতিমগ্ন/ প্রহর গুনেছি, বছর বছর/ জোৎস্নারাতে মন ছুঁয়েছে/ অলৌকিক আলোর বহর।/ আমরা যাকে প্রকৃতি বলি/ মায়ের মত, কল্যাণী পৃথিবী/ সেতো মহিমাময় জগৎস্রষ্টা/ এ জীবন ও মন তারই সৃষ্টি।/ ঝমঝম করে ঝড়েছে বৃষ্টি/ বিজলি চমকেও রেখেছি দৃষ্টি/ মুমিন কখনো হতাশ হয় না/ লা-তাকনাতু মির রাহমাতিল্লা।/ জড়ের বৃষ্টি শেষে রৌদ্রস্নাত/ সুরভী আমায় আবার খুজেছে/ সাধনার ফসল অমৃত, সহজে/ আসেনা, কিন্তু ঠকায়না কারো।’

বহু বিচিত্র বোধের কবি সাঈদ চৌধুরী। লিখেছেন নবীশ্রেষ্ঠ মুহাম্মদ সা. এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে। সুদ, ঘুষ,  ঈদ, রোযা বিলাতের জীবনচিত্র, আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, মাতাপিতা, মাফিয়াচক্রের উৎপাত এসব নিয়ে লিখেছেন। এমনকি গোলক রাজনীতির ভোজভাজির দিকেও আছে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এরদোয়ানের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতার দুঃসাহসী গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁর কবিতায় এমন বক্তব্য ফুটে উঠেছে। 

কবিরা মূলত রচনা করেন মানুষের জীবনসংগীত। গীতলতাবিহিন কবিতা সার্থক কবিতা নয়। সাঈদ চৌধুরী কবিতা লিখতে  লিখতে মাঝে মধ্যে ঢলে পড়েন সংগীতের কোলো। মশিউর রহমান কর্তৃক তাঁর খোদাপ্রেমের সংগীত শুনে মনে হয় তিনি ইসলামি ভাবধারার কবি। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে রচিত, তারকাশিল্পী ফাহিম ফয়সাল কর্তৃক পরিবেশিত সংগীত শুনে মনে হয় তিনি মানবতার মহান কবি। 

জয়তু সাঈদ চৌধুরী। আপনার কলম আরো শানিত হোক আগামীদিনের বাংলা সাহিত্যের খেদমতে।

লেখক: অধ্যাপক, কবি ও সাহিত্য সমালোচক

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;