চির বিদায় শাহরিয়ার শহীদ



সৈকত রুশদী  
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

চলে গেল শাহরিয়ার।  আমার অনুজপ্রতীম, অত্যন্ত সজ্জন একজন মানুষ ও  সাংবাদিক। 

খানিকটা হঠাৎ করেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। শনিবার, ১৭ নভেম্বর দুপুরে।  ঢাকায়। প্রায় তিনদিন জ্ঞানহীন থাকার পর। টরন্টোয় শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে প্রথম যে পোস্টটি দেখলাম, সেটিই শাহরিয়ারের প্রয়াণ সংবাদ।  মনটা ব্যথায় ভরে গেল।

একেবারে অকালপ্রয়াণ বলা যায়না। বয়স হয়েছিল পঞ্চান্ন বছর। শুভ্র দাড়ি গোঁফ ও চুলে ঢাকা তার শান্ত, স্থিতধী অবয়ব দেখে বয়স আরও বেশি মনে হতো। তিন দশকের বেশি সাংবাদিকতা জীবনের এই পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় ও সরকারী বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা' (বাসস)-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার এই প্রয়াণ।

অবশ্য খানিকটা জানান দিয়েছিলো ঠিক দুই বছর আগে। একসাথে লিভার, ফুসফুস ও কিডনীর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যমে মানুষে লড়াই করে ফিরে এসেছিলো শাহরিয়ার সেবার। নবায়ন করা নতুন জীবন পেয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছিল সকলের প্রিয় শাহরিয়ার। মৃদুভাষী, অন্তরালের মানুষ।

শাহরিয়ারের সাথে পরিচয়ের দিনক্ষণ আমার মনে নেই।  সালটা সম্ভবত: ১৯৮৭।  আমি বাংলা সংবাদপত্র 'দৈনিক খবর' ছেড়ে সদ্য ইংরেজি দৈনিক 'দ্য বাংলাদেশ টাইমস'-এ যোগ দিয়েছি। রিপোর্টার হিসেবে।  এক দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিচয় ও আড্ডা। পরে দেখা হয়েছে বহু এসাইনমেন্টে সংবাদ সংগ্রহকালে। শাহরিয়ার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বাসস-তে যোগ দিয়েছে নবীন রিপোর্টার হিসেবে। বয়সের ফারাক খুব বেশি না হলেও সাংবাদিকতায় ততোদিনে আমার আট বছর পার হয়েছে। পেশায় অগ্রজ হিসেবে শাহরিয়ার আমাকে খুবই সম্মান করতো সবসময়। কথায় ও আচরণে। 

এর আগেই সরকারের মালিকানাধীন ট্রাস্ট পরিচালিত 'দ্য বাংলাদেশ টাইমস' পত্রিকায় সম্পাদক পদে যোগ দিয়েছেন প্রথিতযশা সাংবাদিক শহীদুল হক। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে 'মিনিস্টার প্রেস' পদে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনশেষে দেশে ফেরার পর। তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি লে. জে. (অব:) হো. মো. এরশাদ।

ছোটোখাটো গড়নের, উজ্জ্বল বর্ণের, সদা হাসিমুখ ও স্নেহপ্রবণ শহীদুল হক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই তাঁর পেশাদারিত্বের ছাপ রাখতে শুরু করেছেন।  আর্থিক সংকটে ভুগতে থাকা পত্রিকাটিকে নতুন করে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নিয়মিত বৈঠক করছেন সকল বিভাগের সাথে। রিপোর্টারদের সাথে নিয়মিত বৈঠকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের পাশাপাশি  সংবাদ জ্ঞানের প্রখরতার পরিচয় পেতে শুরু করেছি। সদ্য নিয়োগ পাওয়া তিনজন (বর্তমানে হল্যান্ড প্রবাসী ও 'বাসুগ' নামের উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী প্রধান বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, কাজী জাহাঙ্গীর আলম ও আমি) এবং আগে থেকেই রিপোর্টারের দায়িত্ব পালনকারী দুইজন (আবদুর রহমান খান ও বর্তমানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরোজ আহমেদ) তরুণ রিপোর্টার তাঁকে অফিসের প্রধান কর্তাব্যক্তির পরিবর্তে মেন্টর বা অগ্রজতুল্য অভিভাবক হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। আমরাও নতুন উদ্যমে কাজ করতে শুরু করেছি।  জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের মতো তরুণ রিপোর্টাররাও তাঁকে শহীদ ভাই বলেই ডাকতাম। তাঁরই দুই পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শাহরিয়ার শহীদ।

এক দুপুরে অফিসে গিয়েই শুনি শহীদ ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শেরে বাংলা নগরের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে  চিকিৎসাধীন। কয়েকজন সহকর্মী সহ ছুটে গেলাম হাসপাতালে। দেখলাম, করোনারী কেয়ার ইউনিটে নাকে ও মুখে নানা ধরণের নল লাগানো অবস্থায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন শহীদ ভাই। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।

অফিসে কাজের চাপ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার পাশাপাশি দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শহীদ ভাইয়ের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। তিন দিনের মাথায় চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন শহীদুল হক। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে, সাংবাদিকতার মানের উৎকর্ষ সাধনে, বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রচেষ্টার পিছনে যাঁর অবদান অপরিসীম, সেই সম্পাদক শহীদুল হক চিরবিদায় নিলেন।  মাত্র তিপান্ন বছর বয়সে।

শহীদুল হকের অকালপ্রয়াণের পর 'বাংলাদেশ টাইমস'-এ স্বল্পকালের জন্য সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র চারুশিল্পী ও ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে খ্যাত শাহরুখ শহীদকে। তিনিও অকালপ্রয়াত। 

সম্পাদক শহীদুল হকের দাফনের পর নরসিংদীর এক নিভৃত গ্রামে তাঁর শেষ শয্যা নিয়ে আমি যে প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম, সেই প্রতিবেদনটি নিজের, মায়ের ও পরিবারের সকল সদস্যের ভালো লেগেছে বলে জানাতে ফোন করেছিল শাহরিয়ার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশকালে প্রতিবেদনের একটি বাক্যে তাদের পূর্বপুরুষের গ্রামের উল্লেখ করতে গিয়ে আমার ব্যবহার করা 'এন অবসকিউর ভিলেজ' (an obscure village) শব্দবন্ধের কথা স্মরণ করেছিল শাহরিয়ার।  বলেছিল, এটিই সঠিক বর্ণনা।  তার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল 'বাংলাদেশ টাইমস'-এর প্রথম পাতায়। 

তখন আমি 'সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ' সাময়িকীতে 'যাও পাখি' নামে একটি কলাম লিখতাম নিয়মিত।  বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল কলামটি।  সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শোনা একটি ভাষ্য উল্লেখ করেছিলাম। কোনো সাংবাদিকের নাম কখন সংবাদ হিসেবে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেতে পারে সেই বিষয়ে  শহীদুল হক কী বলেছিলেন সেকথা।  তিনি আমার সম্পাদক জেনে সেই তরুণ শিক্ষার্থী বলেছিল কথাগুলো।

"শহীদ ভাই আমাদের প্রথম ক্লাসে এসে কী বলেছিলেন শুনবে? সংবাদ কাকে বলে জানো তোমরা? আমরা চুপ। তিনি বললেন, আমার নামতো টাইমস-এর শেষ পাতায়, নিচে প্রিন্টার্স লাইনে দেখো, তাই না? যেদিন প্রথম পাতায়, উপরের দিকে দেখবে আমার নাম, অর্থাৎ আমার মৃত্যু সংবাদ দেখবে, সেটাই হবে সংবাদ।  বুঝলে?

নিরহংকারী মানুষটি সংবাদ হয়েছেন। তাই, দৌকার চরে, আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শয্যা পেতেছেন, আদরের মোরশেদ।"

(সৈকত রুশদী, অচিন পাখি, পৃষ্ঠা ১৪৫, ঢাকা: প্রোব প্রোডাকশন, ২০০২)।

আজ বাসসের অন্যতম শীর্ষ সংবাদ হয়েছে শাহরিয়ার শহীদ।  ঢাকার কোনো পত্রিকার প্রথম পাতায় হয়তো স্থান পেয়েছে দেশের জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিকের নাম, মৃত্যুসংবাদের শিরোনামে।

তবে দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের হাজারো সাংবাদিকের হৃদয়ের মণিকোঠায় জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে তার নাম।  কর্মনিষ্ঠ সাংবাদিক এবং বিনয়ী, নিরহংকারী ও পরোপকারী মানুষের এইতো পুরস্কার!

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/21/1542777709308.jpg লেখক পরিচিতি:  সৈকত রুশদী/ BIOGRAPHY: Shaikat Rushdee

সৈকত রুশদী, পেশাগতভাবে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সম্পাদক, এবং বেতার ও টেলিভিশন ভাষ্যকার। পুরস্কারে ভূষিত এই লেখক ও কবি, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের লন্ডনস্থ সদর দফতরে সম্প্রচারক হিসেবে কাজ করেছেন বছর দুয়েক (১৯৮৩-১৯৮৬)।

জন্ম মেহেরপুরে, ৫ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৮১ সালে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা'য় প্রদায়ক হিসেবে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা (দৈনিক দেশ, দৈনিক খবরদ্য বাংলাদেশ টাইমস) এবং তিনটি সাপ্তাহিকীতে (বিচিত্রা, মতামত ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ) কাজ করেন।  বাংলাদেশে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের দূতাবাসে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জনবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন (১৯৯২-২০০৩) ।

বর্তমানে তিনি কানাডায় সিশন  নামের একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন সম্পাদক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

তিনি ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক (১৯৯১-১৯৯২) ছিলেন।  বিবিসি ছাড়াও বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ভয়েস অব আমেরিকা, চ্যানেল আই, এটিএন কানাডা ও এক্সএম স্যাটেলাইট রেডিওসহ অসংখ্য গণমাধ্যমে সাংবাদিক ও সম্প্রচারক হিসেবে অবদান রেখেছেন।

তাঁর প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে: 'অমর একুশে', বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের উপরে সংকলন (লন্ডন, ১৯৮৪, সম্পাদক); 'হল্ট গ্রিনহাউজ', পরিবেশ বিষয়ক সংকলন (ঢাকা, ১৯৯১, সম্পাদক, বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া সহ); ও 'অচিন পাখি', উপন্যাস (ঢাকা, ২০০২)। কাঠের কাজ: শহীদ মিনার, বাংলাদেশ সেন্টার (লন্ডন, ১৯৮৪)।

তিনি স্ত্রী গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও কবি শিউলী জাহান রুশদী হক এবং একমাত্র সন্তান টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী উপল রুশদী হক সহ কানাডায় বসবাস করেন।

SHAIKAT RUSHDEE, an award-winning author and poet, is a political analyst, editor, journalist and broadcaster. He has worked with BBC World Service in London, UK, as a broadcaster for two years (1983-1986).

He was born on 5 November 1959 in Meherpur. He completed his SSC in 1974 from Intermediate Technical College and HSC from Adamjee Cantonment College in 1976. He obtained his Bachelor’s degree with honours in sociology in 1980 and Master’s degree in sociology in 1981 from the University of Dhaka.

His career in journalism started with weekly Bichitra in 1978 as a contributor. He has worked with three national dailies (Dainik Desh, Dainik Khabar and The Bangladesh Times) and three weeklies (Bichitra and Motamot, and Desh in Kolkata) until 1992. He also worked with diplomatic missions of Canada, Australia and Britain in Bangladesh as a political analyst and public affairs officer (1992-2003). He is now working as an Analyst and Evaluation Editor at Cision, a global media intelligence company, in Canada.

He was an elected Joint Secretary of the Jatiya Press Club (1991-1992) in Dhaka. He has contributed to a number of media networks, including Bangladesh Betar, Bangladesh television, Voice of America, Channel i, ATN Canada and XM Satellite Radio.

His publications include: ‘Amar Ekushey’, an anthology on the Language Movement of 1952 (London, 1984, editor); ‘Halt Greenhouse’, an anthology on environment (Dhaka, 1991, with Barua, B. C., editor); ‘Achin Pakhi’ (Unknown Bird), a novel (Dhaka, 2002). Wood work: Shaheed Minar at Bangladesh Centre (London, 1984).

He lives in Canada with his wife Sheuli, a poet and media analyst, and daughter Upal, a student at the University of Toronto.

Toronto

18 November 2018

 

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;