স্বপ্নপর্বের তিন কাহন



ইকবাল হাসান
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

স্বপ্নপর্ব

নুরনাহার বানু ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন!
দেখেন, তার স্বামী আবদুর রশীদ পাটোয়ারী বারান্দায় মুরগি কোলে নিয়ে বসে আছেন।
এমত দৃশ্যে যে কোনো মানুষেরই চমকে ওঠার কথা।
স্থবির নুরনাহার বানু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবার চেষ্টা করলেন, বাড়িতে কী হচ্ছে এসব!

প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, তার স্বামীর কোলে কাপড়ের পোঁটলা। মাঝেমধ্যে রশীদ পাটোয়ারী গরম লাগলে গায়ের চাদর, শাল কিংবা সোয়েটার খুলে পোঁটলা করে কোলের ওপর রাখেন। দূর থেকে মনে হতে পারে, একটুকরো অন্ধকার কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি। আজও তাই ভেবেছিলেন, কিন্তু দৃশ্যের ভেতরে তৃতীয় প্রাণীর উপস্থিতি টের পেয়ে মুরগি কক্ কক্ করে ডেকে উঠলে এমত ভ্রম ভেঙে যায় নুরনাহার বানুর।
মুরগী জানান দেয়, ‘কাপড়ের পোঁটলা নয়, অন্ধকারও নয়। আমি, আমি বসে আছি তোমার স্বামীর কোলে। অসুবিধা আছে?’
নুরনাহার বানুর বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বাসায় তো মুরগি পালা হয় না। তাছাড়া এপার্টমেন্ট বাড়িতে সে সুযোগও নেই। তাহলে এ-ধরনের কথা বলা মুরগি এলো কোত্থেকে? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান নুরনাহার বানু।

তখন সন্ধ্যাবেলা।
বারান্দায় আলো আঁধারির দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর আবদুর রশীদ পাটোয়ারী দোল-চেয়ারে মুরগি কোলে নিয়ে দোল খাচ্ছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। ছায়ার মতো নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ান নুরনাহার বানু। দেখেন, তাঁর স্বামীর কোলের ভেতর মুরগিটিও পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে আছে। এমতাবস্থায় তার কী করা উচিত সহসা বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। তবে এরকম দৃশ্য অমরত্বের দাবি রাখে। একথা মনে হতে না হতেই তিনি নিঃশব্দে স্বামীর পেছন থেকে সরে আসেন।

‘বৌমা, ও বৌমা দরজা খোলো।’
একটু আগে বাইরে থেকে ফিরে নিজের ঘরে কাপড় পাল্টাচ্ছিল পুত্রবধু ঋতু। দরজা খুলে দিতেই নুরনাহার বানু ফিসফিস করে বলেন, তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে আসো বৌমা। একটা ছবি তুলতে হবে, এমন দৃশ্য জীবনেও পাবে না।
বারান্দার দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে ঋতু। তারপর অবাক বিস্ময়ে জানতে চায়, বাবার কী হয়েছে? ওরকম কোলের মধ্যে মুরগি নিয়ে বসে আছেন কেন?
এসব প্রশ্নের জবাব তাঁর কাছ থেকেই জেনে নিও। এখন বাহাস না করে ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে ফেলো। আজই ফেসবুকে দিতে হবে।
আমি এ ছবি তুলতে পারব না মা। বাবা জানতে পারলে মাইন্ড করবেন। আপনি তোলেন বরং। আপনাকে কিছু বলবেন না। 

   ২.
ঋতুর কথায় কপট রাগ দেখালেন নুরনাহার বানু। বললেন, হয়েছে হয়েছে। তোমাকে বাহাস করতে হবে না। আমিই তুলছি। এই বলে তিনি কয়েকটি ছবি তুলে ফেললেন। আর তখন ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠতেই মুরগিটি কক্ কক্ শব্দ করে উঠল। আবদুর রশীদ পাটোয়ারী চোখ মেলে তাকালেন। তারপর গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, কী হচ্ছে এসব?
আপনাদের অমর করে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মানে?
আপনাদের দুজনের ছবি তোলা হচ্ছে।
নুরনাহার বানু কিছু বলার আগেই ঋতু বলল, আপনাদের দুজন, মানে আপনার আর মুরগির ছবি তুলেছেন মা। ফেসবুকে দেবেন।
ননসেন্স। আবার চোখ বন্ধ করলেন আবদুর রশীদ পাটোয়ারী।
দৃশ্যটি থেকে ঋতু সরে গেলে স্বামীর পাশে এসে বসেন নুরনাহার বানু।
রাগের পরিবর্তে তার অবয়বে এখন কৌতূহল। ইতোমধ্যে বারান্দার আলো জ্বালানো হয়েছে।
তোমার কি শরীর খারাপ?
না।
মন? মন খারাপ?
না।
এই সন্ধ্যাবেলা বাইরে না গিয়ে বারান্দায় মুরগি কোলে নিয়ে বসে আছো কেন? মুরগি কোথায় পেলে?
মুরগি কোথায় পাওয়া যায়? বাজার থেকে কিনে এনেছি।
মুরগির মাংস খেতে ইচ্ছে করছে?
না।
তাহলে?
এই মুরগি কিছুদিনের মধ্যেই সোনার ডিম পাড়বে। তখন বুঝবে মুরগি কেন কেনা হয়েছে।

আবদুর রশীদ পাটোয়ারী ও নুরনাহার বানুর এই কথপোকথনের সময় মুরগী পুনরায় কক্ কক্ করে উঠলে তাঁদের কথাবার্তা বাধাগ্রস্ত হয়।
নুরনাহার বানু স্বামীর সঙ্গে অযথা তর্কে জড়াতে চান না।
বললেন, তুমি মুরগি মনে করে লাল ঝুঁটিঅলা যাকে কোলে নিয়ে বসে আছো, তাকিয়ে দেখো, তিনি আসলে একজন মোরগ। তার মাথায় সম্রাট আলেকজান্ডারের লালঝুঁটি। মোরগ ডিম পাড়ে না। সোনার ডিম পাড়া তো দূর কি বাৎ হায়।
এ কথায় কিছুটা উদাসীন হয়ে ওঠেন আবদুর রশীদ পাটোয়ারী।
বললেন, মোরগ হোক আর মুরগি হোক কথা একই।
একই মানে, মোরগ আর মুরগি এক কথা হলো?

   ৩. 
একই কথা। কারণ, মুরগি এখানে একটি প্রতীকমাত্র। এখন আমাকে বিরক্ত না করে আমার সামনে থেকে দূর হও।
নুরনাহার বানু কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো কিছুই মেলাতে পারছেন না আর। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? কোনো কোনো সন্ধ্যায় ইদানীং এমন হচ্ছে। বাস্তব ব্যাপারগুলোকে স্বপ্ন মনে হয়। স্বপ্নগুলোকে বাস্তব! কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগে। এই যেমন এখন লাগছে। তাঁর স্বামী আবদুর রশীদ পাটোয়ারী কি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন?
ঋতু বলল, বাবা পাগল হবেন কেন? তিনি ভালো আছেন। নাথিং রং উইথ হিম।
কী বলছো বৌমা! দেখলে না, সন্ধ্যাবেলা তোমার শ্বশুরবাবাজি কোলের মধ্যে লাল ঝুঁটিওয়ালা একটি মোরগ নিয়ে বসে আছেন।
কী যে বলেন মা!
তাহলে আমি কি ভুল কিছু দেখলাম? কী জানি, হবে হয়তো।

স্বপ্নপর্ব ২

তখন অন্ধকার।
অমাবশ্যার রাত্রির কালো থাবা চারদিকে।
আমি ছুটছি। গন্তব্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। নদী নালা খাল বিল বন-বাদাড় পেরিয়ে অবশেষে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। এসে শুনি, কারা যেন বলাবলি করছে, পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে মাঝনদীতে আটকা পড়েছে ফেরি। আজ রাতে তো হবেই না, কাল সকালে ফেরির দেখা মিললেও মিলতে পারে। তখন তোমার শাশুড়িআম্মা, তিনি হঠাৎ দৃশ্যের ভেতর উদয় হলেন, বললেন, চলেন হেঁটে নদী পার হই।
আমরা পাটুরিয়া ঘাটে এসে উঠলাম। তারপর আবার ঢাকার পথে দৌড়।
রাস্তায় চেকপোস্টে আমাদের থামানো হলো বার-কয়েক। পকেটে যা ছিল দিয়ে দিতে হলো। এরপর যেন দোজখের পুলসিরাত, এটা পার হতে পারলেই আপাতত ঝামেলা শেষ। আমরা তখন শেরেবাংলা নগরের কাছাকাছি। হঠাৎ দেখি, আমার পাশ থেকে নুরনাহার বানু উধাও। অথচ সাতচল্লিশ বছর আগে যখন কোর্টে বিয়ে করি, তখন আমাদের মধ্যে ডিল হয়েছিল, আমরা বিপদে-আপদে কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না।
আম্মার এই কাজটি করা ঠিক হয়নি। ঋতু বলল, আই মিন, আপনাকে ওইভাবে একা ফেলে রেখে...
কথার মধ্যে বা’হাত দিও না বৌমা।
কোথায় যাচ্ছেন? রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারেও কালো চশমা পরা লোকটা জানতে চাইল। চেকপোস্টে তার পাশে আরো চারজন। বললাম, ঢাকা যাচ্ছি।
আপনি ঢাকায়ই আছেন। 
ও।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/02/1543706704976.jpg
ইকবাল হাসান

 

   ৪.
আপনার চাদরের নিচে নড়াচড়া করছে ওটা কী?
মনে হলো, লোকটা অন্ধকারেও আমার নাড়িভুঁড়ি দেখতে পাচ্ছে। এখন কোনো ধরনের রাখঢাক করা ঠিক হবে না।
বললাম, মুরগি।
অন্ধকারের ভেতর সাদা দাঁত দেখে মনে হলো, লোকটা হাসল।
মুরগি? মুরগি মানে? আপনি এত রাতে মুরগি নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
যাচ্ছি নির্বাচন কমিশন অফিসে। মুরগি প্রতীক বরাদ্দ নিতে। অফিসটা তো কাছাকাছি কোথাও?
লোকটা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং আমার কথায় বেকুবের মতো হাসল আবার।
পাশ থেকে ওই চারজনের একজন বলল, স্যার, মুরগিটা রেখে দেব?
এই, মুরগি রাখবে মানে? আমাকে চেনো? আমি একজন রিটায়ার্ড সচিব, আমার সঙ্গে ফাজলামো হচ্ছে?
না স্যার। আপনার মুরগি আপনার কাছেই রাখুন। তবে ওই যে অফিসটার কথা বললেন, ওটা এখন আর ওখানে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না।
আপনারা জানেন না? তাহলে চাকুরি করছেন কেন?
সবার পক্ষে তো আর সবকিছু জানা সম্ভব নয় স্যার। এই যেমন ধরুন, আপনিও জানেন না স্যার ওই অফিসটা কোথায় গেছে! কিংবা আপনার বাড়িটি এখান থেকে ঠিক কত কিলোমিটার দূরে।
তা ঠিক। মনে মনে ভাবলাম, এই অসময়ে এদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো মোটেই সঙ্গত নয়। বললাম, আমি এখন যেতে পারি।
জ্বি মুরুব্বি, আপনি এখন যেতে পারেন। কালো চশমাওয়ালার পাশে দাঁড়ানো লোকটা বলে উঠল। একটু আগে এই লোকটাই তো মুরগিটা রেখে দেবার কথা বলছিল।

আবার দৌড়। রাস্তাঘাট শূন্য বলা চলে। মনুষ্যপ্রাণীর টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। একসময় মনে হলো, আমি রাস্তাঘাট সব হারিয়ে ফেলেছি। ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে সবকিছু। তবে অন্ধকার আর নেই, এখন আমার চারপাশ ঘিরে আছে ঘন কুয়াশা। আর সহসাই সেই জমাটবাঁধা কুয়াশায়, যেন স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নের মতো ভেসে উঠল বাড়িটি। আমি আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, নির্বাচন কমিশন!
তবে আমি অবাক হলাম। বাড়িটিকে মনে হলো একটি ভূতুড়ে বাড়ি। কোথাও কোনো লোকজন নেই। পুরো সাইনবোর্ড ধুলোর আস্তরণে ঢাকা। দু একটি বর্ণ উঁকি দিচ্ছে মাত্র। পরিত্যক্ত পোড়োবাড়ি যেন। ফিল্মে ভূতের বাড়ি যেমন হয়। চারদিক মাকড়শার জালে ঘেরা। যেন দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে এখন একটি কংকালের মতো। বাড়ির কাঠামো আছে ঠিকই, তবে ভেতরে বাড়িটি নেই।
বাবা আপনি ভয় পেলেন না? ঋতু বলল, আমার তো শুনেই হাত পা হিম হয়ে আসছে!
বৌমা, তোমাকে কতবার বলব, কথার মধ্যে বা’হাত দিও না।
মাকড়শার জাল সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শা’দত আলী খানের অফিস।

   ৫.
তিনি অফিসে নেই। এই মুহূর্তে ‘বাংলা ভাষা উন্নয়নে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা’ শীর্ষক টক শো-তে ব্যস্ত আছেন । তবে তাঁর চেয়ারে একখানা পাথরের মূর্তি বসিয়ে রেখে গেছেন। আমি বসলাম মূর্তির বিপরীতে। আমাদের মাঝখানে ধাতব টেবিল, শূন্য। ধুলোয় ধুলোময়।
হোয়াট ড্যু ইউ ওয়ান্ট? কথা বলে উঠলেন পাথুরে শা’দত আলী খান।
প্রতীক বরাদ্দের জন্যে এসেছি।
হোয়াট ড্যু ইউ মিন? দিস ইজ নট অ্যান ইলেকশন টাইম। ইউ হ্যাভ টু ওয়েট এনাদার টু টু থ্রি ইয়ারর্স।
তা হোক। আমি এখন থেকেই প্রচারাভিযান চালাতে চাই। অসুবিধা আছে?
নো। ফ্রম মাই সাইড, নো প্রব্লেম অ্যাট অল। হোয়াট সিম্বল ড্যু ইউ ওয়ান্ট? এন্ড ফ্রম হুইজ পার্টি?
মুরগি। মুরগি মার্কা নিয়ে দাঁড়াতে চাই। কোনো দল থেকে না। আমি জানি, বড় দল আমাকে নমিনেশন দেবে না।
এই সময় আমি চাদরের ভেতর থেকে বের করে মুরগিটিকে ধাতব টেবিলের ওপর বসতে দিলাম। বেচারা এতদূর জার্নি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। 
টেল মি ওয়ান থিং, হোয়াই ইউ ওয়ান্ট টু চুজ চিকেন এ্যাজ ইওর সিম্বল?
কারণ একবার এমপি হতে পারলে অই মুরগি প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম পাড়বে। বছরে ৩৬৫টি সোনার ডিম। পাঁচ বছরে ৩৬৫ * ৫ = ১৮২৫টি। ভাবা যায়! তার ওপর কাবিখা, টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য এসব উপরি তো আছেই।
আই সি।
মুরগি প্রতীক বরাদ্দে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
নো।
যদি না থাকে তাহলে আমাকে প্রতীক বরাদ্দ করুন, আমি চলে যাই।
ওকে।
ঠিক এ-সময় মুরগিটি ধাতব টেবিলের ওপর হাগু করে দেয়, যা শা’দত আলী খানকে সহসা উত্তেজিত করে তোলে।
নাউ ক্লিন দ্য টেবল এন্ড গেট লস্ট।
আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুরগির হাগু পরিষ্কার করে পকেটে রাখলাম।
মুরগির হাগু পকেটে রাখার কথা শুনে ঋতু বলল, ইয়াক্!
ইয়াক্ ইয়াক্ করছো কেন? বিদেশে দেখেছি, মানুষ কফের দলা, কুকুরের হাগু পকেটে নিয়ে ঘোরে, যেখানে সেখানে ফেলে না।
শা’দত আলী খানের রাগত চোখ তখনও আমার দিকে।
বললাম, ভাষার মাসে আপনি আমার সঙ্গে ইংরেজি না বললেও পারতেন।

   ৬.
ভাষার মাস, সো হোয়াট! আই হ্যাভ টু সে বাংলা উইথ ইউ? হোয়াট ক্যান ইউ ড্যু ইফ আই স্পিক ইংলিশ? মাই ফ্রেন্ড বিগ্রেডিয়ার হরিদাশ পাল, নাউ রিটায়ার্ড, ওয়েন্ট টু চিটাগং শহীদ মিনার উইথ হিজ স্যুজ অন। নাথিং হ্যাপেন্ড টু হিম আফটারওয়ার্ড। আই এম ডান উইথ ইউ, নাউ গেট লস্ট।

স্বপ্নপর্ব ৩

অতি প্রত্যুষে দূর থেকে আবদুর রশীদ পাটোয়ারী দেখেন, তাঁর এপার্টমেন্ট ভবনের সামনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। এম্বুলেন্স, র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি, টিভি চ্যানেল, সাংবাদিক, দোকানদার, ঝাড়ুদার, গোয়েন্দা, উৎসুক মানুষের ভিড় সব মিলিয়ে যেন একাকার পুরো এলাকা। কী হচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। তবে একটা কিছু যে হয়েছে তা নিশ্চিত। এই ভিড় ঠেলে ওদিকে না যাওয়াই সাব্যস্ত করেন আবদুর রশীদ পাটোয়ারী।
একজন পথচারীকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁর উদ্বেগ কিছুটা কমে যায়।
কী হয়েছে ওখানে? জানতে চাইলেন রশীদ পাটোয়ারী।
এমন কিছু না। ও বাড়ির এক সাহেব গুম হয়েছেন।
বলেন কী! কী নাম তার জানেন?
আমি ভাই অতো-শত জানি না। তবে শুনলাম, সাহেব কাল সন্ধ্যায় মুরগি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আর ঘরে ফেরেননি। গুম হয়ে গেছেন।
কারা তাকে গুম করল শুনেছেন কিছু?
কাল সন্ধ্যার একটু পরে কালো মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকে ছয়জন লোক তাঁকে ওই বাড়ির সামনের থেকে তুলে নিয়ে গেছে। পাশের এপার্টমেন্টের বারান্দা থেকে মিজান নামে একজন সব দেখেছে। সবার হাতে তাক করা ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
কী ভয়ঙ্কর!
আবদুর রশীদ পাটোয়ারী এখন বারান্দার দোল-চেয়ারে বসে স্মরণে আনার চেষ্টা করছেন, কারা তাঁকে গুম করল! কিংবা গতকাল সন্ধ্যার পর আদৌ তিনি গুম হয়েছিলেন কিনা!

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;