বিষধর



রেহানা বীথি
রেহানা বীথি/ছবি: বার্তা২৪

রেহানা বীথি/ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সেদিন ছিলো মধ্য বৈশাখের ঝাঁ ঝাঁ এক দুপুর। সবুর মিয়া খালি গায়ে ঘাড়ে গামছাটা ফেলে উঠোন পেরিয়ে চলে গেলো বাড়ির পেছনে। ইচ্ছে তার, গায়ে যদি পুকুরপাড়ের নিম, বরুণ আর ওই ঘন পাতায় ছাওয়া কাঁঠালগাছের ঝিরিঝিরি হাওয়া লাগে একটু। যা গরম পড়েছে! বিশাল ভুঁড়িসমেত এই পাহাড়ের মতো দেহখানা ঘামে চুপচুপে সারাক্ষণ। যদি পুকুরপাড়ের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শুকায় সেই ঘাম। কিন্তু তা আর হলো না। সবুর মিয়ার চুপচুপে ঘামে ভেজা শরীর নতুনভাবে ঘামতে লাগলো কুলকুল করে। সেই ঘামে পরনের লুঙ্গিখানাও যেন ভিজে গেলো। মনে হলো, লুঙ্গি বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার পায়ের তলার মাটি। কিন্তু তা কি করে হয়? শুধু ঘামেই পায়ের তলার মাটি ভিজে কাদা হয়ে গেলো? এ প্রশ্ন মনে জাগতেই যেন হুশ হলো তার। ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারলো, ঘাম নয়... কখন যেন পেচ্ছাবই করে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, হ্যাঁ... লোকমুখে শুনেছিলো বটে সবুর মিয়া, ভয়ে, আতঙ্কে মানুষের পেচ্ছাব পায়খানাও হয়ে যায়। তাহলে কিনা তারও!

এখন কথা হলো, এত ভয়, এত আতঙ্ক তার হলো কেন? প্রচণ্ড গরমে গা ঘামছিলো বটে, তবে মনটা তো তার বেশ ফুরফুরাই ছিলো। নাহ্, কোনো বিষয়ে একবারও তো আনচান করেনি তার মন! কিংবা কোনো দুশ্চিন্তার রেখা ভাঁজ ফেলেনি কপালে। তাহলে? হঠাৎ কী এমন হলো, যার কারণে ঘাম তো ঘাম, সে একেবারে পেচ্ছাবই করে ফেললো? আর তারপর এই যে দিন দশেক পার হয়ে গেলো, এতটুকুও তো কমলো না সেই সেদিনের আতঙ্ক! বরং বেড়েই চলেছে দিন দিন। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেই আতঙ্ক, যে মনে হচ্ছে ওই আতঙ্কই একধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে তার। তাই যদি না হবে, তাহলে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার পরেও কেন বার বার সবার অগোচরে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির কান্টার ওই মজা পুকুরপাড়ে? তাজ্জব ব্যাপার বটে! নানা কিসিমের নেশা থাকে মানুষের, কিন্তু আতঙ্কের নেশা? জেনে বুঝে আতঙ্কিত হতে চাওয়ার নেশা? সে বোধহয় একমাত্র সবুর মিয়ারই আছে। আর এই নেশার কারণে কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে সে। থেকে থেকে চমকেও উঠছে, দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাসও ফেলছে। আট ছেলেমেয়ের মা করিমন নেসা, যে কিনা তার বউ। যতন করে সে যখন পানের খিলি সাজিয়ে ধরছে মুখের সামনে, মুখটা কেমন যেন তিতা তিতা আর বিস্বাদ লাগে তখনও। বউটার পান খাওয়া রঙিলা ঠোঁট দু'টো যে এই বুড়া বয়সেও কত সুন্দর লাগে, সেটা আর চোখেই পড়ে না তার। যৌবন বয়সের মতো বউয়ের লজ্জা লজ্জা হাসিমুখটা দেখে হঠাৎই তার মনে উদয় হয় সেই দুপুরের আরেকটা হাসিমুখ। সে মুখ কোনো মানুষের নয়, মুখটা একটা সাপের। কালো কুঁচকুঁচে, কিলবিল করে ছুটে চলা একটা সাপ। ফনা তোলে না তাকে দেখে, শুধু হাসে।

জলজ্যান্ত দু'টো মানুষকে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সবুর মিয়া কেমন করে যেন করে ফেলেছিলো সে কাজটা। যদিও কাজটা করতে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছিলো। জীবনে ওই একবারই সে চরম বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলো। যার কারণে বাকি জীবনটা তার এমনভাবে বদলে গেলো, যে বদলের কথা সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। যার ঠিকমতো পেটের ভাত জুটতো না, ছিলো না সমাজে মান সম্মানের ছিটেফোঁটা, চুরি চামারি করার কারণে দেখতে পারতো না মা বাপও। সেই সবুর কিনা দেখতে দেখতে হয়ে গেলো সবুর মিয়া! গাঁয়ের দশজন মান্যি করে, উঠতে বসতে সালাম দেয় এখন তাকে, সে তো তার সেদিনের সেই বুদ্ধির জোরেই! সেই বছর চল্লিশ আগে যদি সে অমন বুদ্ধির পরিচয় না দিতো, হয়তো অভাবে জর্জরিত হয়ে এতদিনে সে এই সাধের দুনিয়া ছেড়ে চলেই যেতো ওপারে। কিন্তু তা হয়নি। সবুর সেদিন জীবনের মোক্ষম সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সবুর মিয়া..... গাঁয়ের মোড়ল। সুখে সম্পদে উপচে পড়ছে তার সংসার। কিন্তু হঠাৎ ওই সাপ? কিলবিল করে চলতে চলতে মাথাটা সবুর মিয়ার দিকে ঘুরিয়ে অমন করে হাসছে কেন সে? যে পুকুরপাড়ে এত বছর ধরে পুঁতে রাখা আছে তার সুখ সম্পদের রহস্য, ঠিক সেই পুকুরপাড়ে, ঠিক ওই জায়গাটাতেই রোজ ওই সাপ আসে কোত্থেকে? আসে তো আসে, তাকে দেখে হাসে কেন? সাপ কি হাসে কখনও? দেখে তো মনে হয়, এতবছর ধরে পুঁতে রাখা গোপনীয়তার সব রহস্য সাপটার জানা। সত্যিই কি তাই? একথা মনে হতেই আবারও ঘেমে ওঠে সবুর মিয়া। টপ টপ করে পড়ে তার ঘাম পাকা দাড়ি বেয়ে।

চল্লিশ বছর আগের সেই মাটিচাপা দেয়া ঘটনার পর কোনোদিন পুকুরপাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করেনি সবুর মিয়া। পাঁচ কাঠা ভিটের ওপর ছনের চাল দেয়া মাটির কুঁড়ে, আর কুঁড়ের পেছনে ছোট্ট পুকুর, কিছু গাছপালা, এই ছিলো তার সম্পদ। ধীরে ধীরে ভিটেতে ওঠে দালান, চকচকে হয় তার জীবন। কিন্তু পুকুরের পাড় আগাছায় ঢাকা। ভিটেয় যখন দালান ওঠে, তখন রাজমিস্ত্রিরা চেয়েছিলো বটে, ঘাটটা ইট সিমেন্টে বাঁধিয়ে দিতে। কেন যেন হায় হায় করে উঠেছিলো সবুর। রাজমিস্ত্রিদের কাছে সে ছিলো এক আচানক ব্যাপার। কেন লোকটা অমন হায় হায় করে উঠলো? পুকুরঘাট বাঁধানো এমন কি খারাপ কাজ! যাই হোক, সবুরের তখন টাকার দেমাগ। গাঁয়ের যেসব লোকজন তাকে কোনোদিন গ্রাহ্যই করেনি, তারা এগিয়ে আসে তাকে দেখে দু'টো কথা বলার জন্য। মুখে কিছু না বললেও, হাবেভাবে বলতে চায় তারা, তোমার উন্নতির রহস্য কি সবুর মিয়া? গঞ্জে বড় দোকান, ভিটেতে ঘরের পর ঘর, ক্যামনে কী? এসব প্রশ্ন তাদের মনে খেলা করে সবসময়, কিন্তু বলে না তারা কিছু। জানে তারা, সবুর এখন বড়লোক, তার টাকার জোর বেজায় এখন। ওসব বলে তাকে খামোখা বিরক্ত করা কেন? তারচেয়ে তারা মনোযোগী হয় সবুরের বিয়ে দিতে। মাথার উপর কোনো বটবৃক্ষের ছায়া নেই যে সবুরের, গাঁয়ের লোকের একটা দায়িত্ব আছে না? দেখে শুনে বিয়ে ঠিকও করে ফেলে তারা। সবুরও রাজি। হবে না? করিমন নেসার রাঙা বেদানার মতো চেহারা চোখে যে নেশা ধরায়। বিয়ে হলো সবুরের। একে একে ছেলেপুলেতে ভরে যেতে লাগলো ঘর। পুকুরপাড়ে পুঁতে রাখা রহস্য দিন দিন ঢেকে গেলো ঘন জঙ্গলে। অব্যবহারে টলটলে পুকুর হয়ে গেলো মজা পুকুর। কেউ যায় না ওই জঙ্গলের মধ্যে তেমন। শুধু সবুর মিয়াই মাঝে মধ্যে যায় কাঠের একটা টুল হাতে করে। গিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ওই সেদিন.... সেই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে যেমন গিয়েছিলো!

সেই দুপুরের পর হঠাৎ করেই যেন সত্যি সত্যি একটা বৃদ্ধ মানুষে পরিণত হলো সবুর মিয়া। তার একদিন আগেও নিজেকে কখনও বুড়ো ভাবেনি সে। বুকের ভেতর যে দপদপা তেজ ছিলো, হঠাৎ করেই কেমন যেন মিইয়ে গেলো তা। দিনরাত সবসময় চোখে ভাসে ওই সাপ, আর তার ঘাড় ঘুরানো হাসিটা। করিমন নেসা সুধায় তাকে,
-- আপনের কী হইলো? পাহাড়ের মতো ওই দেহে বয়স তো ছাপ বসাইবার পারে নাই এতদিন। হঠাৎ এমুন ঝিমাইয়া পড়লেন ক্যান?
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে জবাব দেয় সবুর মিয়া,
-- কিছু না গো বউ! কিচ্ছু হয় নাই আমার! খালি কইজাডায় কেমুন জানি অস্থির অস্থির লাগে। আইচ্ছা বউ, তুমি কি কুনুদিন কুনু সাপরে হাসবার দেখছো?
-- হায় আল্লাহ্, কী কন আপনে! মাথাডা কি খারাপ হইলো আপনের? সাপে হাসবো কেমুন কইরা? অবলা জীব, না পারে হাসতে, না পারে কথা কইতে। খোদা তালা তো কেবল মানুষরেই দিছে সেই ক্ষমতা। কথা কওনের, হাসোনের, বুদ্দি কইরা কাম করনের। এই জন্যেই তো মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার সেরা জীব।
-- হ বউ, ঠিকই কইছো তুমি। মানুষ হইলো সেরা জীব। আমরা হইলাম আল্লাহ্ তায়ালার এক নম্বর বান্দা। আমাগোরে কেউ হারাইতে পারবো না। সাপ তো দূরের কথা!

করিমন নেসা ভাবনায় পড়ে, তার স্বামীর হইলোডা কী? সাপ সাপ করে ক্যান?
বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুঁজে আছে দেখে আর কিছু বললো না করিমন নেসা। না জানি কি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে লোকটা, ঘুমাক একটু। এই বয়সেও ধকল তো কম যায় না। গঞ্জের এতবড় দোকান, এত জমিজিরাত, সবকিছুর হিসাব তো তাকেই রাখতে হয়। পোলারা তো বউ বাচ্চা নিয়া ঘুরণ ফিরোনেই ব্যস্ত। বাপের টাকার মর্ম বোঝে না তারা। খালি উড়ানোর ধান্দা। সিনেমা দেখা, আইজ এই মেলা তো কাইল সেই মেলা। নিত্যনতুন জামাকাপড়। আর খাওনের কী ঠাঁট! গাঁ কি আর গাঁ আছে এখন? টিভির চ্যানেল ঘুরাইয়া বিদেশি সব রান্না-বান্না দেইখা মুখস্ত কইরা রাখে পোলার বউরা। কিসব টক-মিষ্টি মিশাইয়া মুরগি রান্ধে, ভাজেও মচমচা কইরা। মাছের কাঁটা বাইছা হাত দিয়া চটকাইয়া মশলা মুশলি দিয়া আঙুলের মতন লম্বা বানায়। সেইগুলারে আবার বিস্কুটের গুঁড়ায় গড়াইয়া ভাইজ্জা ভাইজ্জা খায়। ক্যান, মাছ এমনি রাইন্ধা খাওন যায় না? যত্তসব! এত কষ্টে তৈরি বাপের সায় সম্পত্তি ওরা যেন ঘুরে ফিরে খেয়েই শেষ করে দেবে। ভয় হয় করিমন নেসার, বাপটা চোখ বুঁজলে সব উইড়া যাইবো না তো! সম্পত্তি ধইরা রাখোনের যোগ্যতা তো চাইর পোলার এক পোলারও হইলো না এতদিনেও! মাইয়ারা তো পরের ঘরে। অরা আর কী করবো! বাপের সম্পত্তি তো পোলারাই বাড়ায়। তার স্বামী সবুর মিয়ার কিছুই তো ছিলো না। নিজের বুদ্ধি দিয়ে, খাটনি দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে সব। শুনেছে সব করিমন নেসা স্বামীর কাছে। সেই মানুষটাই আজ অস্থির? হবে না কেন? নিশ্চয়ই ছেলেদের উড়নচণ্ডি ভাব দেখে মনে মনে সে খুব কষ্ট পায়। হয়তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। তাই হয়তো কয়েকদিন ধরে তার এমন অস্থিরতা আজ প্রকাশ পেলো এমন উল্টোপাল্টা কথায়! কে জানে!

আহারে, একটু চোখ বুঁজছে লোকটা, বুজুক!বোধহয় ঘুমাইয়াই পড়ছে, ঘুমাক... একটু ঘুমাক!
বাড়ির পেছন দরজাটা একহাতে ঠেলে খুলে ফেললো সবুর মিয়া। আরেক হাতে তার ছোট্ট কাঠের টুল। একটু বসবে সে পুকুরপাড়ে। না, আজ গরম নেই। আকাশের পূব থেকে দক্ষিণ, পুরোটা জুড়ে ঘনকালো মেঘ। ঝড় আসবে বোধহয়। বসে বসে মেঘ দেখবে সে। দেখবে কেমন করে সেই মেঘ পাক খেয়ে খেয়ে ঝড়ে রূপ নেয়। তার বুকের ভেতর যে ঝড় বইছে ক'দিন ধরে, তেমনটাই কী? দেখবে সে।

বসে আছে সবুর মিয়া। মাথার ওপর মেঘেঢাকা আকাশ। কালো। সেই কালো মিশে গেছে মজা পুকুরটার পানিতে। পুকুরের পানি এখন আরও মিশমিশে, অন্ধকার। হঠাৎ কটমট করে শব্দ হলো নিম গাছটার ডালে ডালে। কচি কচি পাতাগুলো কেন যেন অযথাই ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো গাছতলায়। বাঁকানো বরুণ গাছের সাদা সাদা ফুলগুলো থেকে মাতাল মাতাল গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধ শুঁকছে একটা সাপ। কালো, চকচকে তার গা। কিলবিলে লেজটা নড়ছে এমনভাবে যেন সাপটা গাছ থেকে নামবে এখনই। সবুর মিয়া স্থির, ঠিক যেন পাথর। সাপটা মুখ তুললো ফুল থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে এমন করে হাসলো সবুর মিয়ার দিকে তাকিয়ে, যেন ফুলের গন্ধে মোহিত সে। সড়সড় করে নেমে আসতে লাগলো বাঁকানো বরুণ গাছ বেয়ে। তারপর হঠাৎ যেন মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়।
কোথায় গেলো...... কোথায় গেলো?

নড়ে উঠলো পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়গুলো। সবুর মিয়া নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে আছে ওদিকে। ওই তো.... ওই তো সাপটা! কিন্তু ওর পাশে ওটা কে দাঁড়িয়ে? ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, পরনে ধূতি পাঞ্জাবি!
-- কে... কে ওটা? কে তুমি?
-- আমারে চিনবার পারো নাই সবুর? ভালো কইরা দেখো তো!
-- চিনি না, চিনি না তোমারে! কে তুমি?
-- আশ্চর্য, আমারে ভুইলা গ্যালা! কেমুন কইরা ভুললা তুমি আমারে, আমার বিশ্বস্ত সহচর! ভুইলা গ্যালা, পুকুরপাড়ে পুঁইতা রাখছো তুমি আমার ভালোবাসা, আমার বিধবা বউরে? আমার পোলারে?
-- কই? আমি কিচ্ছু পুঁতি নাই! ক্যান পুতুম। কী পুতুম!
-- আমি সব জানি সবুর। এই অনিল কর্মকাররে তুমি মিছা কথা কইয়া পার পাইবা না। তুমার বাপে মরার আগে হাতে পায়ে ধইরা আমার দুকানে তুমারে কামে রাখবার কইছিলো। তার কথা ফেলবার পারি নাই। আজীবন কাম করছে তুমার বাপ আমাগো দুকানে। মরণের সময় তার কথা ফেলি ক্যামনে? তাই তো তুমার মতো বজ্জাত পোলারে কামে রাখছিলাম। চুরি চামারি করবার ধরছিলা তুমি। ধরা পইড়া মাইর খাইতা মাইনষের কাছে। তুমার বাপ মনে করছিলো আমার দুকানে থাকলে ভালা হইয়া যাইবা তুমি। তুমার মা'টাও তুমার কুকর্মের ব্যথা সইয্য করবার না পাইরা ধুইকা ধুইকা মইরা গেলো। একটাই পোলা ছিলা কিনা মা বাপের। কিছুদিন তো মনে হইতো ভালা হইয়া গেছো তুমি। বিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম তুমারে। সেজন্যেই তো সোনাদানা রাখছিলাম বিশ্বাস কইরা। কিন্তু কই? ভিতরে ভিতরে তুমি সেই বজ্জাতই রইয়া গেছিলা। বুঝবার পারি নাই আমি, হায় রে!
-- কে কইছে তুমারে, ভালা হই নাই আমি! জানো, এখন গাঁয়ে আমার কত সম্মান? সবাই আমারে সবুর মিয়া কইয়া ডাকে। মোড়ল আমি গাঁয়ের। আমার কত সম্পত্তি জানো তুমি?
-- জানুম না ক্যান? আমি আমার দুকানের সমস্ত সোনা, রূপার গয়না আর টাকা পয়সা তুমার কাছে জমা রাইখা ভারত পালাইলাম। আমার বাবা কাকারা আগেই গেছিলো সেই দ্যাশে। মুক্তিযুদ্ধ যখন খুব জোরদার তখনও আমি দ্যাশ ছাইড়া যাইবার চাই নাই। কিন্তু আমার পোলা মাইয়া আর বউয়ের মুখের দিকে চাইয়া যাইতে রাজি হই। না গেলে তো পাকিস্তানীরা পাখির মতো গুলি কইরা মারতো।
অবশ্য যাইয়াও কী লাভ হইলো? পথেই গুলি খাইলাম আমি। বউরে কইলাম, তুমার কাছে সব আছে। টাকা পয়সা, গয়নাগাটি সব। যদি কুনুদিন দ্যাশ স্বাধীন হয়, আইসা সবুরের কাছে সব পাইবা।
-- আসে নাই তো তুমার বউ! আসলে তো দিয়াই দিতাম সব।
-- আসে নাই? এক থাপ্পড়ে তুমার বাকি দাঁতগুলা ফালাই দিবো আমি। দ্যাশ স্বাধীনের সাত বছর পর পোলারে নিয়া আসে নাই সে? আইসা কত তুমার হাতে পায়ে ধরলো, তুমি দিলা না কিছুই। অস্বীকার করলা সবকিছু। পরের দ্যাশে টাকার অভাবে খুব কষ্টে পড়ছিলো বইলাই পোলার হাত ধইরা আসছিলো তুমার কাছে। দুকানের সোনাদানা কম তো ছিলো না! সেগুলা পাইলে কষ্ট লাঘব হইতো তাগো। তা না দিয়া তাগোরেই তুমি সরায়া দিলা দুনিয়া থাইকা। মাইয়াডারে মা ভাই হারা করলা? কইরা আবার মিয়া সাইজ্জা বইছো? গাঁয়ের মোড়ল! পরের ধনে মোড়ল? আমার বউ আর পোলারে খুন কইরা, কুচি কুচি কইরা কাইটা, পুকুরপাড়ে পুঁইতা রাইখা তুমি সবুর মিয়া সাজছো?

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অনিল কর্মকার। গায়ের লোমগুলো এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলো সবুর মিয়ার। সাপটা ততক্ষণে একেবারে তার পায়ের কাছে। ঘুরছে কিলবিল করে তার পায়ের চারিদিকে। কালো মেঘগুলো যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছে সবুর মিয়ার মাথার ওপর। প্রচণ্ড কড়কড় শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঠিক তার মাথার ওপরেই! বাজ পড়ে ঝলসে যাবে বুঝি তার পাহাড়ের মতো দেহখানা। ওই তো অনিল কর্মকার! বিদ্রুপের হাসি হাসছে তাকে দেখে, আর বলছে.... তুমি মরবা... এইবার তুমি মরবা সবুর! কেউ পারবো না তুমারে বাঁচাইতে! যে পাপ তুমি করছো, সেই পাপ-ই তুমারে দংশন করবো সাপ হইয়া। দেখো নাই, ক্যামন কইরা হাসে সে তুমারে দেইখা? ওইডাই তুমার মরণ সবুর... ওইডাই তুমার মরণ!

আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবুর মিয়ার । পা দু'টো ছুঁড়তে থাকে এদিক ওদিক। কিছুই দেখা যায় না ক্যান? এত আন্ধার ক্যান? সে কি দোযখে? মরণের পর দোযখে জায়গা হইছে তার? এখন তারে আগুনে পুড়ানো হইবো? ভাবতেই যেন সারাশরীরে আগুনের ভয়াবহ তাপ অনুভব করলো সে। ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে সিথানে রাখা চর্চ হাতে নিয়ে। সোজা চলে গেলো বাড়ির কান্টায়। পুকুরের পানিতে ডুব দিতে হইবো এক্ষণি, দেরি করা যাইবো না! দেরি করলে তো পুইড়া অঙ্গার হইয়া যাইবো তার দেহ!

তখন ছিলো গভীর রাত। বৈশাখের শেষ দিনের কালবৈশাখীতে লণ্ডভণ্ড পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়। ধীরে ধীরে রাত এগোয় ভোরের দিকে। ফজরের আজান হয়। করিমন নেসা বিছানা হাতড়ে স্বামীকে পায় না। ঘর ছেড়ে উঠোনে নামে সে। দেখে পেছনের দরজা হাট করে খোলা। কোনো এক ছেলের নাম ধরে জোরে চিৎকার করে সে। জেগে ওঠে সবাই। পায়ে পায়ে সবাই এগিয়ে যায় কান্টায়। আলো আঁধারিতে সবাই দেখে পুকুরপাড়। দেখে আর আতঙ্কিত হয়। একটা কালো কুঁচকুঁচে সাপ পেঁচিয়ে রয়েছে সবুর মিয়ার কণ্ঠনালী, কিলবিল করছে। মুখটা অল্প হাঁ হয়ে আছে সবুর মিয়ার। কাঠ হয়ে পড়ে আছে তার বিশাল দেহখানা। বোঝা যায়, প্রাণ নেই ও দেহে।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;