বাবার বিয়ে |



মোজাফ্‌ফর হোসেন
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাবাকে কিছুই বলার ছিল না। বিয়ের খবরটা শুনে ছাদে গেলাম। আগামীকাল কিংবা পরশু বিয়ে করবেন বাবা। বাড়িতে চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। ছোটবোন ফোন করে রাতে জানাল। মায়ের মৃত্যুর ছ’মাসও হলো না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে মুখ দেখাব কেমন করে, বলে ছোটবোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কিছু বলিনি। ওর কথা শেষ হলে মোবাইলের কলটা ও নিজেই কেটে দিল। মা জানতেন তার মৃত্যুর পর বাবা ফের বিয়ে করবেন। আমাকে বলেওছিলেন, ছোট সন্তান হিসেবে আমি যেন বাধা না দিই। মায়ের আদেশ ঠিকঠাক মেনে চলার মতো আদর্শ সন্তান আমি না। মৃত যে তার কাছে দায় তো আরো কম। তবু বাবার বিয়ে করার খবরটি আমার মধ্যে এতটুকু নাড়া দিল না। ছোটবোন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে চিন্তিত। ওর সমস্যা আন্দাজ করতে পারি। আমার ওরকম কোনো সমস্যা নেই। শহর থেকে দূরে আরেকটি শহরে পড়াশোনা করছি। এখানে আমার মা জীবিত না মৃত, বাবা আবার বিয়ে করলেন কিনা, তাতে কার কী এসে যায়। কারো কিছু এসে গেলেই বা আমার কী করার আছে!

ছাদে আজ আলোটা বেশ। এত চড়া আলো রাতে বেমানান। কোনো এক রাতে এমন আলোয় বাবাকে দেখেছিলাম মাকে উঠোনে বেঁধে ঘরের হুড়কো দিয়ে পেটাচ্ছেন। সকালে উঠে মায়ের হাতে-পায়ে কোনো দাগ দেখিনি। বড় ভাইবোনদের বললে ওরা হাসতে হাসতে বলেছিল, বাবা কখনোই মায়ের গায়ে হাত ওঠান না। এরপর খেতে বসে আমার সামনেই বাবাকে যখন ওরা বলল, বাবা তুমি নাকি কাল রাতে মাকে উঠোনে মেরেছো! সঙ্গে সঙ্গে মা বাবাসহ ওদের হেসে ওঠা দেখে আমি তো লজ্জায় বাঁচি না। এরপর যতবার এ দৃশ্য দেখেছি আমি চুপ করে থেকেছি। আমার দেখার ভুল নিয়ে আরো অনেক সন্দেহ থেকে গেছে। সংসারে সব সন্দেহ দূর হয় না। এটা মায়ের কথা। কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন আজ আর মনে করতে পারি না। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক কথা উড়োকথা মনে হয়। কোনো কোনো কথা ভেসে ওঠে বাতাসে। মানুষের মৃত্যুর পর যদি কিছু থেকে যায় পৃথিবীতে, সে হলো কথা। সেই কথা থেকে আবার নতুন কথা তৈরি হয়। যেমন, মাসখানেক আগে মা বললেন, ন্যায় অন্যায় সমাজের ব্যাপার। খুন করাও কখনো কখনো অন্যায় না, প্রকৃতির চেয়ে বড় খুনি তো আর কেউ হতে পারে না। তাই মনের ভেতর ন্যায় অন্যায় বলে কিছু পুষে রাখতে নেই। এই কথাগুলো মা যখন আমাকে বললেন তার কয়েকমাস আগেই তিনি মারা গেছেন। মায়ের ভাসতে থাকা কথা থেকে এমন আরো অনেক কথা তৈরি হয়, আমি কিছু শুনি, কিছু আমার অন্য ভাইবোনরা শুনতে পায়। কিছু হয়তো কেউ শোনে না। আমি কারো না শোনা কথাগুলো প্রায়ই ধরে ধরে মেলানোর চেষ্টা করি। সেদিন ভুল করে অন্য একজনের কথা ধরে ফেলেছিলাম, আমার মা নয়, অন্য মা, তার সন্তানকে বলছেন মরে উঠতে। সন্তানের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাইনি। জীবিত মানুষের কণ্ঠস্বর শূন্যে ভাসে না। মা কেন তার সন্তানকে মরে উঠতে বলবে? কথাটি কি বেঁচে উঠতে হবে? মৃত মা কেন তার জীবিত সন্তানকে বেঁচে উঠতে বলবে? নাকি সন্তানও মৃত? সন্তান মৃত হলে মরে উঠতে বলবে কেন? অনেকদিন এই কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি।

ছোটবোন ফের ফোন করে। ওর স্বামী বলেছে, তোর বাবা যদি সত্তরে বিয়ে করতে পারে, আমি করলে দোষ কোথায়? সম্ভবত মেরেছেও। ও না বললেও বুঝেছি। মার খাওয়াটা ওর জন্য ঘটনা না, আরেকটা বিয়ে করার হুমকি শুনে ভড়কে গেছে। একটা মেয়ে প্রাইমারি শেষ করবে, আরেকটা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বিয়েটা যদি সত্যিই করে ফেলে তো ওর জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু ওর কষ্ট আমাকে এখন ছুঁতে পারে না। আমি যত চেষ্টা করি তত দুলাভাইয়ের কথা মনে হয়। এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছে। শুয়েছেও। লোকজন সব এখন জানে। ও বিয়ে না করলে ওই নারী আত্মহত্যা করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমি বোনের হয়ে ওকালতি করতে গিয়েছিলাম। সংসার টেকাতে ওকে হালকা করে হুমকিধামকিও দিতে হয়েছে। মহিলা রাজি হয়েছিল এক শক্ত শর্তে। আমি যদি বিয়ে করি তো ও আমার দুলাভাইকে ছেড়ে দেবে। মহিলার মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনেছি। এরপর আর ওর ব্যাপারে আমি কিছু বলিনি। তুই বিয়েটা করে ফেল। ছোটবোন আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার দুধের শিশুদুটোর কথা ভেবে। আমি বললাম, ঠিক আছে করব। ও তখন নিজেই তেড়ে ওঠে, ও বেশ্যা মাগীকে বিয়ে করে তুই কেন জীবন নষ্ট করবি? ওই খানকি তো এটাই চায়, কারো গলায় ঝুলে যেতে পারলেই হয়। ও কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা রেখে দেয়।

নীলার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে আমার। এটাকে ঠিক ব্রেকআপ বলা যায় কিনা জানি না। ও চেয়েছিল স্বামীটা যতদিন পিএইচডিটা শেষ করে দেশে ফিরছে ততদিন আমাকে দিয়ে বিছানার কাজটা মিটিয়ে নেবে। চারদিন ওর বাসাতে আর একদিন আমাদের মেসের রুমে চেষ্টাও করা হলো। কিন্তু আমার সাড়ে তিন ইঞ্চি দিয়ে ওর হলো না। বিবাহিত, এক সন্তানের মা। আমাকে দেখে নাকি ধারণাই করতে পারেনি এত ছোট হবে। ও খুব হতাশ হয়েছে। আমার কোনো অপরাধ নেই, ওকে বলেছি। এইটুকু নিয়ে কেউ প্রেম করে, তাও পরকীয়া—নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। নীলার মনটা খুব নরম। হাসনা চাচির মতো হিজড়া গালি দিয়ে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়েনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকেছে। কেঁদেছে, একটু আমার জন্য একটু নিজের জন্য। আমার চেহারা ও শরীরটা দেখে আরো অনেক নারী ধোঁকা খেয়েছে। অধিকাংশ মেয়েদের সমস্যা ওরা মোড়ক দেখে কোয়ালিটি বিচার করতে চায়। আমার রুমমেট শফিকের সাইজটা ঠিক আছে, কিন্তু চেহারা খারাপ, ছোটখাটো মানুষ বলে কোনো মেয়েকে বিছানা পর্যন্ত আনতে পারেনি। শফিকের জন্য আমার খারাপ লাগে। ভেবেছিলাম নীলাকে বলব শফিকের কথা। তার আগেই নীলা একজনকে পেয়ে গেল। ওর মেয়েকে পড়াতে আসে ছেলেটা। আমাকে ফেসবুকে ছবি দেখিয়েছে। অল্পবয়সী ছেলে। শুকনো শরীর। কিন্তু যেটা দরকার সেটা ঠিক আছে। নীলাকে খুশি দেখে আর কিছু বলিনি।

বড়ভাইয়ের ফোন এলো। বুঝেছি বাবার বিয়ে নিয়ে বলবে। ভেবেছিলাম আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে বলবেন আপত্তি না করতে। বড়ভাবী বাবাকে রান্না করে খাওয়াতেন। কিছুদিন থেকেই বলছেন বাপের বাড়ি চলে যাবেন। বাবা বললেন, বাবাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যও তো একজন দরকার। বুড়ো হয়েছে, বিছানায় পড়ে গেছে কে দেখবে? আমি কোনো কথা বলিনি। মায়ের মৃত্যুর পর ঠিক হয়েছিল বাবাকে বড়ভাবী আর মেজভাবী পালা করে খাওয়াবেন। গতমাসেই মেজভাই শহরে বাড়ি ভাড়া উঠেছেন। গ্রাম থেকে নাকি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। বাবার বিয়ের বিষয়ে তার অমত থাকার কথা না। মেজভাই ফোন করে বাবার বিয়ে নিয়ে কিছু বললেন না। বললেন, বিয়ের আগে সম্ভব হলে বাবার কাছ থেকে বাড়িটা লিখে নিতে হবে। না হলে শেষ বয়সে নতুন কেউ সংসারে এসে বাড়িটা তার নামে লিখে নিতে পারে। মাঠের জমির বণ্টননামা ঠিক করে নিতে হবে। বিয়েতে আমরা মত দিলে বাবা সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। মেজভাবীর হাত থেকে মোবাইলটা বড়ভাবী নিলেন। বললেন, নতুন বউকে লিখে দেয়াটা বড় কথা না। যদি তার ঘরে সন্তান হয়, তাহলে সে বাড়ি-জমিজমার অংশীদার হয়ে যাবে। বাবার বয়স সত্তর পার। এ বয়সে সন্তান হয় নাকি? ভাবীকে বললাম আমি। ভাবী বললেন, সন্তান হতে বাবাকে লাগবে কেন? আশেপাশের পুরুষ মানুষের অভাব নাকি? অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে দু বছরের মধ্যেই পেট হবে, আমি বলে দিলাম, তুই লিখে রাখ। ভাবী আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন। সন্তান হলে সম্পত্তির ভাগ পাবে। বড়ভাই আর মেজভাই কি আমাদের ভাগ দিচ্ছে না? আমরা আলাদা মায়ের সন্তান হলেও তো কেউ বঞ্চিত হচ্ছি না? আমি প্রশ্ন করি ভাবীকে। কিন্তু এখন যে সন্তান হবে সে তো বাবার সন্তান না, আমরা তাকে ভাগ দেব কেন? ভাবীর উত্তর। এতটা নিশ্চিত হয়ে ভাবী যখন বলেন আমার আর কিছু বলার থাকে না। শুধু আস্তে করে বলি, আমরা কে বাবার সন্তান আর কে বাবার সন্তান না, সেটা আর এখন শতভাগ নিশ্চিত হই কেমন করে যখন আমাদের মায়েরা মৃত। ভাবী আমার কথা শুনে রাগ করে ফোনটা রেখে দেন। ভাবীর পুরানো ইতিহাস আমি জানি, ইঙ্গিতটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখে কথা বাড়াননি।

ব্যক্তির ইতিহাস সমষ্টির ইতিহাস না। এটা সবসময় লিপিবদ্ধ থাকে না। জাতির ইতিহাস ব্যক্তি ধারণ করে সেখানে তার নিজের ইতিহাস নেই দেখেও। আমার মুক্তিযুদ্ধ-পলাতক বাবা জাতীয় ইতিহাসে নিজের ভুল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে গবেষক শান্তিবাহিনীর তালিকাতে বাবার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভারতে প্রথম স্ত্রীর বড়বোনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস পর গ্রামে ফেরেন। ওখানে কিছু ঋণ করে আর একটা দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে শরণার্থী ক্যাম্পের জন্য ছোটভাইয়ের হাতে নিয়মিত টাকা দিতেন। দেশে ফিরে জানতে পারলেন তার ছোটভাই, মানে আমার আপন ছোটচাচা, কলকাতায় হোটেলে আরামে থেকেছেন সেই টাকায়। ওই গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ছোটচাচার নামটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ আছে। বাবাকে বলেছিলাম গবেষক ও প্রকাশকের নামে একটা মানহানির মামলা করতে। বাবা করেননি। বলেছেন, টাকা যখন শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছায়নি তখন আর পলাতক ও শান্তি কমিটির মধ্যে পার্থক্য করে কী লাভ! বাবা লাভ লোকসান না দেখলেও ক্ষতি একটা হয়েছে আমাদের। সেজবোনের বেসরকারি স্কুলের হওয়া চাকরিটা হতে দিল না প্রতিপক্ষ ক্যান্ডিডেটের বাবা, আমার বোনকে রাজাকারের মেয়ে অভিযোগ তুলে। সেই ছোটচাচার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হিসেবে সগৌরবে চাকরিটা পেল। বাবা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। সেজবোনটা আত্মহত্যা করলেন তার এক বছর পরে। চাকরি না হওয়ার জন্য নয়, স্বামী অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, বিয়েও করেছিল। বোনটাকে মেরে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। আত্মহত্যা বলে সেজবোনের ব্যক্তিগত ইতিহাসে লেখা রইল।

সেজবোনের কোনো কোনো কথাও শূন্যে ভেসে ওঠে। আমাকে একদিন বলেছিল মেয়েটা খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। মরার সময় ওর পেটে ছিল। সাত মাসের। আর একদিন বলেছিল, ওর খুব আনন্দ হয় বেঁচে থাকতে। ও তো মৃত, বেঁচে থাকতে আনন্দ হয় কিভাবে আমি বুঝিনি। মৃতদের যে কথাগুলো শূন্যে তৈরি হয় তাদের আগের কথাগুলো থেকে তাতে অনেক সময় কোনো অর্থ থাকে না। থাকলেও আমরা জীবিত মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে পারি না। কখনো কখনো সক্ষমতার প্রশ্নে কে বেশি এগিয়ে— জীবিত না মৃত আমি বুঝতে পারি না। যেমন আমার নিজের সক্ষমতা কতটুকু? নীলা কিংবা হাসনা চাচীকে কেন খুশি করতে পারি না? বাবার বিয়ে থামাতে বলে ছোটবোন, বড়ভাই-মেজভাই বলে বিয়েতে আপত্তি না তুলতে। কিন্তু আমি কি চাই সেটা নিজেও ঠিক করতে পারি না।

মাঝে মাঝে মনের এমন নিষ্ক্রিয়তা থেকে কোনো কোনো কাজ করে বসি। ছোটবোন সেদিন রাতে বলল দুলাভাইয়ের প্রেমিকার বাসায় ফের যেতে। গেলাম আমি। মহিলার বয়স আমার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। ঘরের ভেতরে গিয়ে বসলাম। মহিলার মা বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিল। আমি কিছু বলি না। জানি না কী বলতে এসেছি। ছোটবোন কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারি না। মহিলা শাড়িটা খোলে। ব্লাউজ না খুলে পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। আর কিছু পরেনি ভেতরে। এরপর কী হবে আমার জানা। কিন্তু এই মহিলা অন্য নারীদের মতো আমার নগ্নতা দেখে হতাশ হয় না। হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে। আমি কী বলতে এসেছিলাম, কী করছি সেটা ভেবে লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মহিলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। কেউ একজন দরজাটা ফাঁক করে। ক্যাচ করে শব্দ হয়। মোবাইলে ছবি তোলার আওয়াজ আসে। ক্যামেরার সাউন্ড অফ করতে ভুলে গেছে কিংবা ইচ্ছা করেই অফ করেনি। ছবি তোলা শেষ। এখন মহিলার থেমে যাওয়া উচিত। তা না করে আমাকে বসিয়ে এক পা বিছানায় তুলে মুখটা চেপে ধরে। বের হ মাগি। ওর মা বাইরে থেকে বলে। থাম, বের করে নিই। মহিলা ভেতর থেকে ঘনস্বরে উত্তর দেয়। আমার নিস্ক্রিয়তা কখনো কখনো কারো জন্য সক্রিয়তার কারণ হয়ে ওঠে। আমি আর সে রাতে বোনের বাসায় ফিরে যাই না। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পেছনের মসজিদে কয়েল জ্বেলে ঘুমায় পাড়ার শফি হুজুর। মসজিদে গেল সপ্তায় দু রাতে দুটো ফ্যান চুরি হয়েছে। জুম্মার নামাজে টাকা তোলায় ব্যবহৃত টিনের বাক্সটাও কখন কে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে শফি হুজুর পাহারায় থাকে। বউ ডাকলে উঠে যায়, কাজ সেরে আবার এসে মসজিদে ঘুমায়। মাঝরাতে মসজিদের টিউবওয়েলে ওর গোসল করার শব্দ শুনে বুঝি। আমার এখন গোসল করা উচিত কিনা জানি না। কোনো নারীর সামনে নগ্ন হলে কি গোসল করতে হয়? পাশে শুয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি। কাজ না করলে গোসল করার দরকার নেই। শফি হুজুর আমাকে বলে। কাজ করা বলতে যা বোঝায় তা আামাদের হয়েছে কিনা বুঝে উঠতে পারি না। আমরা মসজিদের ভেতরে আর এসব নিয়ে কথা বলি না। কিছুক্ষণের মধ্যে শফি হুজুরের নাক ডাকার শব্দ আসে। একজন নারী আমাদের মাথার কাছ থেকে ছায়ার মতো ঘুরে যায়, আমি টের পাই। পেছন ফিরে তার চলে যাওয়া দেখি। শফি হুজুরের বউ সালোয়ার-কামিজ পরে না। শাড়ি পরে। সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি শফি হুজুরের বাড়ির উল্টো দিকে আমবাগানের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে মিলে যায়। ওদিকে গোরস্থান। কোনো বাড়িঘর নেই। আমি উঠে বসি। স্বপ্ন দেখছেন, ঘুমিয়ে পড়েন। শফি হুজুর বলে। গোলস করে শুলে ভালো করতেন। ওর কথা শুনে আমার আর ঘুম আসে না।

বড়দুলাভাই ফোন করেন। উনার ধারণা বাবার বিয়েতে আমার জোর আপত্তি আছে। আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর তোর মাকে যখন শ্বশুর বিয়ে করলেন তখন আমরা আপত্তি করিনি। শশুরের বয়স তখন কম ছিল, আপত্তি করলেও শুনতেন না। পুরুষ মানুষ ওই বয়সে একা থাকলে নানা বদনাম হতে পারে। তারচেয়ে বিয়ে ভালো। এখন শ্বশুরের বয়স হয়েছে। আমরা আপত্তি করলে জোর করতে পারবেন না। কিন্তু তার দেখাশোনার জন্য তোর বোনরা পড়ে থাকতে পারবে না। তোর দু ভাইয়ের বউ তো কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তুই বিয়ে করে বউকে রেখে যা। গরীবঘরের অল্প শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে থাকবে। দুলাভাইয়ের কথাগুলো আমি শুনলাম। বিয়ে আমি করতেই পারি। বউ আমার টিকবে না। বাবার তৃতীয় বিয়ের কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে আরেকটা কেলেঙ্কারি তৈরি হবে। দুলাভাইকে সব বোঝাতে পারি না। বলি, বাবা বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়? তাহলে তোর অমত নেই? দুলাভাই আমার মত পেয়ে খুশি হন। তখন বুঝতে পারি উনি আসলে কৌশলে আমার মত নিতে চেয়েছিলেন।

রাতটা ছাদে বেশ কাটে। শহরের সন্ধ্যারাতের প্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভে গেলে কিছুটা অন্ধকার আসে এদিকে। কিংবা অন্ধকার আগে থেকেই ছিল, আলো সরে গেলে দৃশ্যত হয়। অন্ধকারটাই পৃথিবীর, আলোটা আসে বাইরে থেকে। গাছগুলো যে আছে এতক্ষণে টের পাওয়া যায়। প্রাণ আছে যতকিছুর তার মধ্যে গাছ এক যে নিজের ইচ্ছায় স্থান বদল করতে পারে না। শহরে এক একটা গাছ আমাদের পূর্বগাছদের বিস্মৃত স্মৃতি হয়ে অপেক্ষা করে। কোনো কোনো অপেক্ষা জড় বস্তুর মতো নিস্ফলা, বৃক্ষের মতো নিশ্চল।

রাত আরো গভীর হলে আমার স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। অতীতের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা আগাম মনে পড়ে। মনে হয় মা বেঁচে আছেন। আমি গনগনে দুপুরে গোলাঘরের ছায়ায় বসে। বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তখন আর মা বেঁচে নেই। উঠোনে দেখি রোদের ভেতর মা শুকোতে দেওয়া সিদ্ধ ধানগুলো নেড়ে দিচ্ছেন খালি পায়ে। সেই উঠোনেই আবার নতুন বউ নিয়ে বাবা বসে আছেন এক বিকালে। ঘোমটা সরিয়ে লোকজন দেখছে। আমি উঠে গিয়ে দেখি আমার মায়ের চেহারা। বাবার বয়স তখন অনেক কম। মাকে বিয়ে করে এনেছেন। আমার জন্মের আগের দৃশ্য কিন্তু আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। বাবার বয়স আরো কমে, ঘোমটার ভেতর চেহারাটা বদলে যায়। আমার বড় মা কিংবা মেজ মা হবে। আমি তাদের দেখিনি বলে নিশ্চিত হতে পারি না। মা যখন ধানগুলো নেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে যান, তখনই অন্ধকার নামে। দুপুর থেকে সরাসরি রাত। বিকালটা গায়েব। রাতে আমি বারান্দায় বসে। সামনে অচেনা দৃশ্যপট। একজন নারী আমার সামনে চায়ের কাপ তুলে ধরে বলে, পেনশনের টাকাটা কাল তুলে আনো। আমার পায়ের শক্তি কমে আসে। বুঝতে পারি বয়স হয়েছে। চায়ের কাপ ধরে থাকা হাতটির মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী হতে পারে। কিন্তু আমি বিয়ে করলে আমার স্ত্রী টেকার কথা না। আমার বাকি জীবন একা থাকার কথা কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অনেক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। একজন জোর গলায় বলছে, আমাকে কেউ মারেনি। আমি একা একা মরেছি। কিন্তু আত্মহত্যা করিনি। আমার মেজবোন কিংবা মায়ের কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়। আরেকজন বলছে, চেষ্টা করলে হয় না, সব চেষ্টা হওয়ার জন্য না। কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারি না। আমি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কার্ণিশের কাছে চলে যাই। এই আমি অতীত, বর্তমান নাকি ভবিষ্যতের কিছুক্ষণের জন্য বুঝে উঠতে পারি না।

ঘুমটা ভাঙে বড় দুলাভাইয়ের কলে। ভালো একটা পাত্রী পেয়েছি। বয়সটা কম, কিন্তু সন্তান হবে না। আগের স্বামী সেই কারণে তালাক দিয়েছে। কোনো বদনামের সুযোগ থাকল না। আমার আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। আজ ভার্সিটি যাব না। দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয় ছোটবোন। বাবার বিয়ে হয়ে গেছে। ও বলে। ততটা অখুশি বলে মনে হয় না। ওই মহিলার সঙ্গে। বড় দুলাভাইয়ের প্ল্যান।
কোন মহিলা? আমি জানতে চাই।
মাগীটা। বলে আমাকে আবার প্রশ্ন করে—এখন কি গালি দেওয়া ঠিক হবে? বাপের বউ মানে তো আমাদের মা। মানি আর না-মানি।
রাখ তুই। আমি ঘুমাব। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকব। যখন জেগে উঠব আমার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠবে শূন্যে। তুই মোবাইল ছাড়াই শুনতে পাবি।
দিন কোথায় পেলি? এখন তো রাত। ছোটবোন বলে।
জানালা খুলে দেখি সকাল হয়েছে। মা বাসি উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ময়লাগুলো টোকায় তুলছেন। একবার মনে হয়, মাকে ডেকে বলি বাবা আবার বিয়ে করবেন। তখন মনে পড়ে যায় মা আগে থেকেই জানেন, মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন। আমি ভবিষ্যৎ দেখে এলাম নাকি অতীতে ফিরে গেছি বুঝে উঠতে পারি না। নিজের বর্তমান ছাড়া সময়ের আগপিছ নির্ণয় করা কঠিন। মৃতের কি কোনো বর্তমান থাকে?

   

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;