কবি সুবোধ সরকারের সাক্ষাৎকার



ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার: শিমুল সালাহ্উদ্দিন
kobi

kobi

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের পাঠকের সামনে বসলে আমার মনে হয় যেন আমি নিজের সামনে বসেছি।
—সুবোধ সরকার

নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বলেছেন, কবিতার গা থেকে সমস্ত গয়না খুলে ফেলতে চান তিনি। সুবোধ সরকারকে বাংলাদেশের মানুষ বেশিরভাগ চেনে মঞ্চে মঞ্চে তুমুল জনপ্রিয় কবিতা ‘শাড়ি’ বা কাল্লু’র কবি হিসেবে। দুই বাংলায়ই আবৃত্তিশিল্পীরা সুবোধ সরকারের অজস্র কবিতা পৌঁছে দিয়েছেন শ্রোতাদের কানে। সুবোধ সরকারের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনির পাঠাগারে, সেই ২০০৩/০৪ সালে। সেই প্রথম পরিচয় সুবোধ সরকারের সাথে।

ধ্বনির পাঠাগারে সুবোধ সরকারের দুটি বই ছিল। ‘কাল্লু’ আর ‘আমি কারো অন্ধকার নই’। কাল্লুর ভূমিকায় একটা লাইন খুব তাড়িয়ে ফিরত তখনকার সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমাকে—“ওগো মৌলবাদ, তুমি আমাদের গলায় ঝুলে থাকা অ্যালবাট্রস, কবে আমাদের ছেড়ে যাবে?”

প্রায় এক যুগ হয়ে গেল সুবোধ সরকার পড়ছি। বলতে দ্বিধা নেই, ভালোলাগা নিয়েই পড়ছি। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা সংবাদমূলক গল্পনির্ভর, খুব সহজে পাঠককের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে সুবোধ সরকারের।

জন্মেছিলেন ১৯৫৮ সালের ২৮ অক্টোবর, কৃষ্ণনগরে। শরণার্থী পরিবারের ছেলে বলেই কি অদ্ভুত এক প্রেম ও সংবেদন আছে সুবোধ সরকারের হৃদয়ে! পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এই কবি ২০১৩ সালে নিজের রচনাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২৮টি। এর মধ্যে আছে—একা নরকগামী (১৯৮৮), রাজনীতি করবেন না (১৯৯৭), ভালো জায়গাটা কোথায় (২০০১), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), সব রাস্তা রোমে যায় না (২০০১), কাল্লু (২০০৩), মণিপুরের মা (২০০৫), যা উপনিষদ তাই কোরাণ (২০০৬), প্রতিবাদের কবিতা (২০০৭)।

সম্পাদনা করেন সাহিত্যের কাগজ ‘ভাষানগর’। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাটিয়েছেন এক প্রেমময় কবিতাজীবন। প্রচণ্ড বিতর্ক ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে।

এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে কবির সিরিটির বাসায়, কোলকাতার টালিগঞ্জে, ২০১৭ সালের ৩ মার্চ, সকালে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা, আপনার বাড়িতে এলাম, সেটা আমার জন্য একটা বড় অভিজ্ঞতাই বটে। আপনি আমার খুবই প্রিয় কবি। শুধুমাত্র আপনি না, আপনারা দুজনই, যেই অর্থে আমরা দুজন বলি। এবং মল্লিকাদির কবিতা, আপনার কবিতা, আপনারা যখন এখানে দুরন্ত সময় কাটাচ্ছেন, আপনাদের একের পর এক বই বেরুচ্ছে, সেই সময়গুলোতে ঢাকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। ফলে আমরা আমাদের মতো করে, জাহাঙ্গীরনগরে যে কবিতা-সমাজ ছিল; এক ধরনের যাপন ছিল আমাদের, পঠন ও মিথস্ক্রিয়া ছিল, আমাদের মধ্যে—আপনারা প্রচণ্ড রকমের প্রভাব রেখেছিলেন। আমাদের মনে হতো যে, আমরা কেউ কেউ সুবোধ-মল্লিকা হয়ে উঠব। মল্লিকাদি নাই এখন, এটা ভয়ঙ্কর বেদনার ব্যাপার আমাদের জন্য। দাদা, কেমন আছেন দিয়েই শুরু হোক।

সুবোধ সরকার: যে যেরকমভাবেই থাকুক না কেন, আমি যেরকমভাবেই থাকি না কেন, তুমি যেরকমভাবেই থাকো না কেন, আসলে আমরা কিন্তু সবাই ভালো থাকি, ভালো থাকতেই হয়। মল্লিকা চলে গেছে, এই প্রসঙ্গটা তুমি আবার শুরুতেই তুলে আনলে, কিন্তু তুমি যদি এই প্রশ্নটা মল্লিকাকে করো, মল্লিকাও হয়তো বলবে ভালো আছি। ঠিক সেরকমভাবেই আমাদের কারুর কোনো অধিকার নেই এই পৃথিবীতে বলার যে, পৃথিবী তুমি আমাকে ভালো রাখোনি। বা সমাজ তুমি আমাকে ভালো রাখোনি। এটা বলার কারো অধিকার নেই। আমরা ভালো আছি, আমি তো ভালো আছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, আপনার, আপনাদের বইপত্র আমাদের ওখানে, ঢাকায়, অনেক পরে পৌঁছায়—

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ, কলকাতার বই তো অনেক দেরিতে যায়, শুনেছি অনেকের কাছেই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমাদের বই তো আসেই না! না?

সুবোধ সরকার: আসে না এমন নয়, আমি তো ঢাকা থেকে নিয়মিত বই আনাই। সীমান্ত আর কাঁটাতার বইয়ের আদানপ্রদানকে কঠিন করে দিয়েছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ, ধরেন গত বছরের বই এ বছর পেলাম আমরা। পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের সিনেমা আমাদের ওখানে মুক্তি পায় না, যেমন পায় না বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কলকাতায়। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের বইপত্র আমাদের ওখানে অনেক দেরিতে যায়। যাদের প্রচণ্ড আগ্রহ আছে তারা ইউটিউবে খুঁজে এখানকার সিনেমাটা দেখে, আমরাও অনেক বেশি খুঁজে পেতে হয়তো মাসে একদিন আজিজে গিয়ে আপনাদের বইটা খুঁজে বের করি। প্রসেসটা অনেক লেন্থি, প্রলম্বিত। আপনার সর্বশেষ কী বই বেরুলো?

সুবোধ সরকার: এই তো কদিন আগেই বেরিয়েছে, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা শেষ হলো, এখানে আমার একটি বই বেরিয়েছে, সিগনেট থেকে, এই বইটির নাম এবার অনেক বড় একটি নাম আমি দিয়েছি। আমি আসলে ছোট ছোট নাম দিই কবিতার বইয়ের। যেমন: ‘ছি’, ‘কাল্লু’—সব ছোট ছোট নাম। কিন্তু এবারের এই বইটির নাম বেশ বড়, সম্ভবত সবচেয়ে বড় নামের বই, ‘তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ডে বিপ্লব আসে না’। এই বইটির পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে করা হয়েছিল। আমি নকশাল আন্দোলনের সময়কার ছেলে। আমি যখন স্কুলে যেতাম, কৃষ্ণনগর নামে একটা ছোট্ট শহর, সেখানে নকশাল আন্দোলন বিরাট আকার নিয়েছিল। স্কুলে যেতাম, যাওয়ার সময় ডানদিকে ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছি, ফেরার সময় হয়তো বামদিকে ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই বেঁচে ছিলাম। মরেই যেতে পারতাম যে কোনো দিনে। কিন্তু এরপর আরো এরকম নকশাল আন্দোলন, তার পরবর্তী সময়ের অনেক আন্দোলন করে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এসছি। তো আমার তিনটে দীর্ঘ কবিতা আছে এই বইতে। সেই তিনটে দীর্ঘ কবিতাই হচ্ছে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনের আংশিক সফলতা এবং বৃহত্তর ব্যর্থতা, এগুলোর কথা যেমন আছে, তেমনি স্বপ্ন দেখার কথা আছে। প্রায় আত্মজৈবনিক। কিন্তু সঙ্গে দুটো ছোট কবিতাও আছে। শেষ যে কবিতাটা আছে, সেটা হচ্ছে, ভারতবর্ষ, যে বিষয়টা নিয়ে একেবারে তোলপাড়, ডিমোনিটাইজেশন অর্থাৎ নোট বাতিল—এটা নিয়ে একটা সাংঘাতিক জায়গায় এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। গরিবের জন্য একটা অর্থনৈতিক দুর্ভিক্ষ তৈরি করা। কালো টাকা ফিরিয়ে আনা হবে বিদেশ থেকে এটা বলা হয়েছিল, কিন্তু কালো টাকা তো ফেরেনি! তার বদলে সাধারণ গরিব মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে। তো আমার ওই শেষ কবিতাটায় একজন বিজন মাহাতো, বিজন মাহাতো হচ্ছে যার কোনো এটিএম কার্ড নেই। সে এক চা-বাগানের ছেলে। সে হতে পারে জঙ্গল-মহলের ছেলে। সে একটা গ্রামের ছেলে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষ ভারতবর্ষে রয়েছে যাদের কোনো এটিএম কার্ড নেই। কোনো কার্ডের অবকাশ নেই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কিংবা ব্যাংকে একাউন্ট নেই।

সুবোধ সরকার: অথচ ইন্ডিয়াকে বলা হচ্ছে ডিজিটাইজ করা হবে। এই যে প্যারাডক্স, এই প্যারাডক্সের জায়গা থেকেও একটা কবিতা আছে। সুতরাং এই কবিতাগুলো নিয়ে হচ্ছে তোমার তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ডে বিপ্লব আসে না। এটাকে আমি ব্যঙ্গ করেই বলেছি। এত তাড়াতাড়ি বিপ্লব হয় না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নিয়ে চাপিয়ে দিলাম সাধারণ মানুষের উপরে, জনগণের উপরে এবং বললাম বিপ্লব হয়ে গেছে। অতো সস্তা না। তো সেটাকেই বিদ্রুপ করে লিখেছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা এখন যে সামাজিক অবস্থা চলছে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, আমরা জানি আপনি রাজপথের সরব কবি, আপনার কবিতায় সব সময় গণমানুষের বেদনা-ব্যথা-কথাই আসলে উঠে এসেছে। আপনি আর্তের, নিপীড়িতের পাশে দাঁড়িয়েই আসলে কবিতা লেখেন। আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা আমাকে সব সময় তাড়িত করে—যে ট্রেনের ওইপারে আরেকটা লোক যে আধখানা রুটি পাবে কি পাবে না সেটা নিয়ে যে আর্টথিংকিং.... ফলে আপনি মানুষের কথা বলেছেন। সেজন্য আপনি বাংলাদেশে, আমি এখানকার কথা জানি না, বাংলাদেশে আপনি সাধারণ মানুষের কাছে ভয়ঙ্করভাবে গৃহীত বলে আমার মনে হয়। আপনার কবিতার আবৃত্তি প্রায় প্রত্যেকটা কবিতার অনুষ্ঠানে হয়। এটাও একটা ব্যাপার। তো মানুষের কথা আপনি বলেছেন, মানবতার গান গেয়েছেন এবং এখনো ডিমোনিটাইজেশনের... সর্বশেষ বইয়ে আপনি কিন্তু ওই ধারাতেই আছেন এবং আপনাদের কবিতা উৎসবের স্লোগান আমার খুব ভালো লেগেছে, ‘তোমাকে নিয়ে বেঁচে রয়েছি কবিতা’।

সুবোধ সরকার: ‘তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা’ এটা বহুদিন আগের কবিতা, লিখেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি উদ্বোধন করছেন এবার পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমির যে কবিতা উৎসব, যেটি আজ থেকে শুরু হবে, আজকে ৩রা মার্চ, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হবে। সেই কবিতা উৎসবের বলা যেতে পারে থিম লাইন, ট্যাগ লাইন—তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা। এটা আমাদের সবার খুব মনের কথা। আর আজকে কবিতা উৎসব শুরু হবে, খুব ভাল্লাগছে এই মুহূর্তে তুমি এসেছো। দুটো সাদা পায়রা উড়িয়ে দেব, সঙ্গে বেলুন, হ্যাঁ! আর কবিরা, আবৃত্তিশিল্পীরা তারা সব রবীন্দ্রনাথের পায়ে এবং রবীন্দ্রসদনের যে রবীন্দ্রমূর্তি তার পাদদেশ থেকে আমরা একটু হাঁটব। অনেকে, যাদের বয়স হয়ে গেছে তারা হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু আমরা ওই একটা প্রতীকে হাঁটা, কবিতার জন্য হাঁটা—সেটার নাম দিয়েছি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার নামে—‘একটু পা চালিয়ে ভাই’।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, যে বইটা এবার আপনার বেরুলো, আপনি যার গল্প বললেন আমাদেরকে—এই বইটা নিয়ে আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

সুবোধ সরকার: কবিতার বইয়ের প্রতিক্রিয়া বা রেসপন্স যা-ই বলি না কেন, খুব সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায় না। সে যত ভালো বই-ই হোক। বা যত খারাপ বই-ই হোক। প্রতিক্রিয়া সব সময় পাওয়া যায় না। একমাত্র কবিতার বইয়ে শুনেছি সাম্প্রতিককালে, ফিডব্যাক পাওয়া যায় একমাত্র শুনেছি যারা ফেসবুকের কবি তারা নাকি পায়। চারশো-পাঁচশো, এক হাজার, দু হাজার, তিন হাজার কেউ কেউ নাকি বলছে এক লাখ দু লাখ লাইক, এসবও নাকি বলে! আমি জানি না। এসব গল্প আমি বলতে পারব না। যারা ফেসবুকের কবি তারা বলতে পারবেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: প্রত্যেক কবির তো একান্ত পাঠক থাকে। তাদের ওপর তিনি নির্ভরও করেন। সব সময় তারা প্রশংসাই করবেন এমন নয়।

সুবোধ সরকার: তা ঠিকই। আমি ফেসবুকের কথা বলতে পারব না অতোটা। শুনি চারপাশে। আমারও ফেসবুক একাউন্ট আছে। তোমাদের কথা মাঝে মাঝে জানতে পারি। ফেসবুক না থাকলে অতো জানতে পারতাম না সব সময়। সবই মানছি, তবে কবিতার বই তো, তার গতি, অনেক ধীরে ধীরে সে, পাঠকের কাছে পৌঁছোয়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে মাত্র, এই বইমেলায় মানে একমাস হয়েছে। আর বিক্রি দিয়ে আমি কখনো কোনো বইকে পরিমাপ করি না। তুমি যদি চাও, কালকে আমি যদি বলি আমার তিন হাজার ছাত্রছাত্রী আছে বা আমার দশ হাজার অধ্যাপক বন্ধু আছে, তাদের সবাইকে যদি বাধ্য করি তোমরা আমার বই কিনে নিয়ে যাও, সেই বিক্রিটা কি কোনো রকমভাবে মাপকাঠি হতে পারে!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা কাউন্টেবল বিক্রি না।

সুবোধ সরকার: এই রকম অনেকে করেন। এখানে নতুন কবিদের মধ্যে এধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কবিতার বইকে রাখতে দিতে হয়। খুব গোপন পাঠক একেক করে আসবে, এসে বইটা দেখবে বা বইটার কথা শুনবে, তারপর একটা কপি কিনে নিয়ে যাবে। এটার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, ওই তাড়াহুড়ো করে হইচই করে সব কবিতার বই শেষ হয়ে গেল, আর আমি কিছু সিনেমার লোকজন ধরে এনে সেই বই কিনিয়ে নিলাম বা রাজনীতির লোকদের দিয়ে কিনিয়ে নিলাম বা সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে কবিতার বই চারশো পাঁচশো কপি কিনিয়ে নিলাম আর বললাম বেস্ট সেলার। এটা খুব অশ্লীল। এটা কখনো হোক আমি চাই না। তার একটা প্রবণতা আমি লক্ষ করছি। খুব দুঃখের সেটা। তবে এই প্রবণতাটা বেশিদিন টিকবে না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এগুলো সব সময়ই থাকে কিন্তু টেকে না। দাদা, প্রতিক্রিয়া বলতে আমি এরকম ব্যাপার জানতে চাইনি।

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ এইটুকুনই বলতে পারি, এই বইটি ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসার পর আমি নিজে যখন হাতে নিলাম, ভালো লাগল, আর আমার মনে হলো যারা সত্যিকারের পাঠক তারা যদি বইটি সংগ্রহ করেন, পড়েন, আমার নিশ্চয় ভালো লাগবে। তবে এটা তো আর হটকেকের মতো বিক্রি হতে পারে না। টি এস এলিয়টের সেই বিখ্যাত কথা এখনো বিশ্বাস করি, উনি বলেছিলেন, যখন উনি ফেভার এন্ড ফেভারের এডিটর, তখন উনি বলেছিলেন, যদি একটা কবিতার বই একশো কপিও বিক্রি হয়, তো জানবেন সেটা খুবই ভালো। এই যে একশো জনকে কল্পনা করেছিলেন টি এস এলিয়ট, এই একশো জন কিন্তু আসলে এক হাজার জন। এমন এক পাঠকের কথা ভেবেছিলেন, যারা প্রভাব বিস্তার করবে পরবর্তী সময়ে। তো আমার মনে হয় সেদিক থেকে কবিতার বই পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতা এবং জেলা শহরগুলোতে, ভারতে কিন্তু কবিতার বই অন্যান্য ভাষাতে খুব একটা বিক্রি হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে কবিতার বই, বিশেষ করে চারপাঁচজন কবি তো আছেনই, যাদের বই নিয়মিতভাবে বিক্রি হয়। এডিশন হয়। প্রকাশকরা তাদের বই চেয়ে পান না অনেক সময়। তো আমার মনে হয়, এটা সব ভাষাতেই, কবিতার বইয়ের বিক্রি এতটাই সীমিত, বলা যেতে পারে এতটাই সুসংহত, ভালো না খারাপ সেটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু কবিতার বই তো উপন্যাস নয়, কবিতার বই তো সিনেমা নয়; সুতরাং কবিতার বই তার নিজস্ব রকম দিক নিয়ে আছে। আমার ভালো লাগে বরঞ্চ এই দৃশ্য দেখতে, বইমেলায় একটা নতুন সময়ে একটা ছেলে একটা মেয়ে হয়তো দেখা যাবে ঘাসের মধ্যে বসে আছে আমার একটা কবিতার বই খুলে, হয়তো আমি পাশ দিয়ে চলে গেলাম। এই যে দৃশ্যগুলো দেখা যায়, বা কোনো একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে ফুটপাতের ওপর তিনজন তরুণ হয়তো আমার বইটা নিয়ে তর্ক করছে—এর থেকে ভালো দৃশ্য আর কিছুতে হয় না। এই দৃশ্যগুলো যখন দেখতে পাই, মন ভালো হয়ে যায়। এটাই কবিতা, এটাই প্রাপ্তি। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছুতে আশা করি না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনি সনেট লিখেছেন শেক্সপিয়রের চাইতে বেশি।

সুবোধ সরকার: হাহাহা। ওটা মজা করে বলেছিলাম।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার ‘দ্বৈপয়ন হ্রদের ধারে’ পড়েছিলাম আমরা। ওটা মজা করে বলেছিলেন ঠিক আছে। কিন্তু কবিতার প্রকরণ, ছন্দ—মানে এগুলোর যে শাসন, আমার মনে হয়েছে আপনি সব সময় এগুলোকে ভাঙতে চেয়েছেন।

সুবোধ সরকার: হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি একশো পঞ্চান্নটা সনেট লিখে বলেছিলাম যে, কেন একশো পঞ্চান্ন, এর জবাবে বলেছিলাম যে, মহামান্য শেক্সপিয়রকে তো আর কোনোভাবেই হারাতে পারবে না কেউ কোনোদিন, একটা সংখ্যায় যদি হারানো যায়! তাই তো আমি উনার যে সনেট সিকোয়েন্স সেটা একশো চুয়ান্ন, ওয়ান ফিফটি ফোর সনেটস, তো আমি একশো পঞ্চান্নটা লিখে বলেছিলাম যে যাক, এই একটা জায়গায় অন্তত.... সংখ্যা দিয়ে যদি ওঁর ঠোঁটে যদি একটা মুচকি হাসি লাগাতে পারি। তো প্রকরণ একটা বিরাট ব্যাপার। আমি বলি যে প্রত্যেকটা কবিতা তার নিজস্ব বিষয় অনুসারে তার প্রকরণ ঠিক করে নেয়। কিন্তু আমি সেই প্রকরণের বিরুদ্ধে, যে প্রকরণ একবার হাতে এসে গেল এবং সেই একই মডেলে, একই রকমভাবে, একই মিল দিয়ে, একই ছন্দ দিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে একই জিনিস লিখে যাওয়ার যে প্রকরণ, সেটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। তাই জন্য আমার কবিতার লাইন কখনো এই রকম বড় হয়ে গেছে! কখনো এই রকম হয়েছে। কখনো ভেঙে এই রকমভাবে চলে গেছে। কখনো ছন্দে লিখেছি। কখনো ছন্দে ভেঙেছি। ঘটনাচক্রে ছন্দেই বেশি লিখেছি। আমার সত্তর শতাংশ কবিতাই আমি খুবই প্রথাগত ছন্দে লিখেও তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সম্পর্কে একটা ধরণা আছে এবং সে ধারণাটা কোনো ভুল আমি বলছি না, সেই ধারণাটা অনেকটাই হয়তো সত্যি আবার অনেকটাই সত্যি নয়। সেটা হচ্ছে যে আমি শুধুমাত্র গদ্যেই লিখি। আমি যদি কোনোদিন সামান্য একটুও কাব্যভাষা তৈরি করতে পেরে থাকি, তার জন্য আমি আমার পূর্ববর্তী এবং সমবয়সী এবং পরবর্তী সময়ের তরুণ কবিদের কাছে ঋণী। কেননা আমি বিশ্বাস করি, আমি এখন কবিতা লিখি, আমি শুধুমাত্র যারা আমার আগে লিখেছেন তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছি আর যারা আমার পরে লিখতে এসেছেন তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা হচ্ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। কেউ এগুলোর ডিএনএ টেস্ট করতে পারে না। এর ডিএনএ টেস্ট করা যায় না। খুব কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, যে ভাষার মধ্যে আমি আছি, তার প্রবীণ এবং নবীন সমানভাবে আমাকে পাল্টে চলেছে। আমাকে দিচ্ছে। এবং আমি নিচ্ছি তাদের কাছ থেকে। সুতরাং প্রকরণ খুব একটা বড় ব্যাপার। প্রতিটা কবিতা তার নিজস্ব একটা প্রকরণ তৈরি করুক। একই কবির কবিতা একই রকম প্রকরণে যেন না হয়, ভিন্ন রকম প্রকরণ যেন উঠে আসে— বিভিন্ন রকম ব্যাকরণ বিভিন্ন রকম বিন্যাস। সুতরাং কবিতার যে ফরমেট, এই ফরমেট শব্দটা কিন্তু টেকনিক্যাল। সাধারণত সাহিত্যে ব্যবহার করি না আমরা। কিন্তু আমি করি। এই ফরম্যাট যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থাকে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বৈচিত্র যেন থাকে!

সুবোধ সরকার: তাহলে সেটা যেন মনে হয় কুয়োর জল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনার ঠিক পেছনে আমাদের একজন কবি কামাল চৌধুরীর বই দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আপনার বিবেচনা কী?

সুবোধ সরকার: বাংলাদেশের কবিতার একটা বড় জায়গা এখনো পর্যন্ত, এমনকি তরুণ কবিদের মধ্যে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রবণতা রয়েছে। অনেক বেশি বাংলাভাষার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কবিরা বা কবিতা। আমাদের এখানে ভাষার একটা বিরাট মিশ্রণ চলেছে। এবং যার জন্য এখনকার নবীন কবিদের কবিতায়, হ্যাঁ তাদেরকেই শুধু বলব কেন, আমি আমার কবিতাকেও বলি, যে, একটা মিশেল লক্ষ করা যায়। বিপুল পরিমাণে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য শব্দ আমাদের কবিতায়—তা হিন্দিই হোক, উর্দু হোক, ইংরেজি হোক, ফরাসি হোক—এই যে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ ঢুকে পড়েছে বংলা কবিতায়, এটা সম্ভবত এর আগে কখনো বাংলা কবিতায় এই রকম ঘটনা ঘটেনি। এত অন্য ভাষার শব্দ বাংলা কবিতায় এসে ঢুকে গেছে, তার একটা বড় কারণ হচ্ছে বাংলা ভাষা চিরকালই বাইরের অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছে, যেটাকে লোন ওয়ার্ডস বলে। যেরকম ইংরেজি ভাষাটাই দাঁড়িয়ে আছে লোন ওয়ার্ডসের উপরে। ইংরেজি ভাষাটায় নিজের শব্দ কটা? বেশিরভাগই তো অন্য ভাষা থেকে নিয়ে আসা শব্দ। তো শুধুমাত্র লোন ওয়ার্ডেস ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজি ভাষা। বাংলাভাষারও এখন, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে, গত তিরিশ বছরে লক্ষ করা যায়, যে, শক্তি-সুনীলের সময়ে যেরকম, বিশেষ করে শক্তিদার তো দেখাই যেত না ইংরেজি শব্দ বা হিন্দি শব্দ বা অন্য কোনো শব্দ। বরঞ্চ তাদের কবিতায় দেখেছিলাম যে, অপ্রচলিত শব্দ বা তৎসম শব্দের বিপুল ব্যবহার। তৎসম শব্দের সঙ্গে একেবারে রাস্তার শব্দ মিশিয়ে দেয়ার খেলা করতেন। এই জিনিসটার বদলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সাম্প্রতিককালের যে লোন ওয়ার্ডস, ম্যাক্স মিডিয়ার যে লোন ওয়ার্ডস, বা ধরা যাক পপুলার মিডিয়ার যে লোন ওয়ার্ডস, তাদের যে শব্দ, দিন প্রতিদিনের যে শব্দ, রাস্তাঘাটের যে শব্দ, সাধারণ মানুষ না জেনে যে সব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন, যেগুলো প্রায় বাংলা হয়ে গেছে—সেই শব্দের কিন্তু প্রবেশ বিরাটভাবে ঘটে গেছে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি—এই তিনটে তো বটেই, তাছাড়াও অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ এসেছে। এই একটা জায়গায় বাংলাদেশের কবিতার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। হয়তো বাংলাদেশের কবিতার সঙ্গে কিছুটা আরবি শব্দ রয়েছে এবং এখনো রয়েছে, সেই শব্দগুলো হয়তো বোঝা যায় না। যারা জানেন তারা বুঝতে পারেন। কিন্তু বোঝা যায় না। অনেক সময়ই বোঝা যায় না। এই একটা শব্দের প্রয়োগের দিক থেকে বাংলাদেশের কবিতা আর আমাদের কবিতার একটা পরিষ্কার পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা, কবি তো আসলে স্বাধীন। কবি কোনো বাধ মানে না। কবিতার প্রকরণ নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রকরণের ক্ষেত্রেও আসলে সে স্বাধীন। কোনোকিছুর বাধ সে মানতে চায় না। কিন্তু কখনো কখনো সেটা লাগে আবার। ওই যে বলছিলেন কাব্যভাষা তৈরি, সেটার জন্যই, দাদা, আপনি অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেও সমাজ-চেতনা আপনার কবিতার মধ্যে যেমন আছে, একইরকমভাবে ব্যক্তি সুবোধ সরকার পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। যেমন কবিতা উৎসবের সংগঠক হিসেবে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তো এই ব্যাপারগুলোকে আপনার কবিজীবনের সাথে কিভাবে মেলান?

সুবোধ সরকার: আমি একটা কথা বলি, যখন এই প্রসঙ্গটা উঠল, এই কবিতা উৎসব এত বড় করে কবিতা উৎসব পশ্চিমবঙ্গে কেন, ভারতবর্ষেও হয়নি। এই তিনদিনের যে উৎসব সেই উৎসবটা করছে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি। পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমিটা বেশিদিন হয়নি। কবিতা নিয়ে যে পুরো একটা একাডেমি তৈরি করা যায়, এই শব্দটা আমাদের হাতে এনে দিয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এটা সম্পূর্ণভাবে তাঁর শব্দ, যে কবিতা নিয়ে একটা একাডেমি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি এই ব্যাপারটা প্রথম তাঁর মাথা থেকে এসেছে। তো এটা একটা বিরাট ব্যাপার। কেননা ভারতবর্ষে কোথাও কবিতা নিয়ে একাডেমি হয়নি। এমনকি পৃথিবীতেও একমাত্র আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহ্যাটনে একটা পোয়েটস হাউজ আছে। দ্য একাডেমি অফ এ্যামেরিকান পোয়েটস। এই ছাড়া তো কোথাও নেই। সেই দিক থেকে আমি বলব যে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমি একেবারে বলা যেতে পারে দ্য ফার্স্ট অফ ইটস কাইন্ড ইন দ্য কান্ট্রি অর ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। তো সেইদিক থেকে এটা প্রায় পায়োনিয়ারিং একটা কাজ হলো। তো এই যে কবিতা একাডেমি, শুধুমাত্র উৎসব নয়, ভারতের অন্যান্য ভাষার কবিতা অনুবাদ হবে, বাংলা কবিতা অন্যান্য ভাষায় পৌঁছবে, আমাদের দেশের ভেতর থেকে অন্যান্য ভাষার কবিরা যেমন কলকাতায় আসবেন, রাইটারস রেসিডেন্স, পোয়েট রেসিডেন্স হবে। বিদেশ থেকেও কবিরা আসবেন। কবিতা নিয়ে কবিতা ফিল্ম, কবিতা মিউজিক, কবিতা আবৃত্তি, কবিতাকে একেবারে জনপরিসরে পৌঁছে দেবার একটা দায়িত্ব কবিতা একাডেমি পালন করবে। সুতরাং কবিতা একাডেমি মানে শুধুমাত্র পাবলিকেশন্স, বিভিন্ন রকম বই, নতুন ধরনের বই, তরুণ কবিদের বই, প্রবীণ কবিদের সুচিন্তিত নির্বাচিত কবিতা—এইসবই থাকবে। যাতে কবিতার একটা ভুবন তৈরি হবে কবিতা একাডেমিকে ঘিরে। এটাই হচ্ছে স্বপ্ন। সত্যি সত্যি এই স্বপ্ন আমাদের হাতে ধরিয়েছেন তিনি, যিনি আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, উনি স্বপ্নটা দেখছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করার জন্য সেই কবিতাঅন্তপ্রাণ মানুষগুলো লাগবে।

সুবোধ সরকার: সে তো বটেই। উনি নিজে কবি বলে হয়তো ওঁর মাথাতে এসেছে। এত কাজ এত চাপ এতকিছু করছেন, মানুষকে দু’ টাকা দরে চাল দেয় থেকে শুরু করে এই যে এখন তোলপাড় হচ্ছে বাইপাসের ধারে যে সমস্ত হসপিটালগুলো, যারা কসাইখানাতে পরিণত হয়েছে, মানুষকে ধরে ধরে গলা কাটছে, তাদের যে ঘুঘুর বাসা এটা এই প্রথম কেউ কোনো মুখ্যমন্ত্রী এই রকম কড়া পদক্ষেপ নিলেন, যে, আজকে ঘটনাচক্রে ঐতিহাসিক দিন যে, ক্লিনিক্যাল স্টার্ক বিষয়ক বিল আজকে রাজ্য-সরকার পাশ করাতে চলেছে। আজকে এসেম্বলিতে এটা গৃহীত হবে। এবং সাধারণ মানুষ যাতে সুচিকিৎসা পায়, যাতে গাফিলতিতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয় এবং যদি গাফিলতির কারণে কারো মৃত্যু হয় সেক্ষেত্রে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা এই বিলে বলা হয়েছে। সুতরাং এই যে জায়গাটা তৈরি হয়েছে এখানে তো কেউ হাত দিতে পারত না। এই প্রথম কোনো মুখ্যমন্ত্রী এখানে হাত দিয়েছেন। এবং এটা হলো সাধারণ মানুষ, রাস্তাঘাটের মানুষ—আমি গত কয়েক দিন ধরে দেখেছি, যেই মানবিক মুখটা তিনি দেখতে চাইছিলেন, এই জন্য তারা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করছে। এটা তো বাংলাদেশের পক্ষেও খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এ কারণে যে আমরা জানি বাইপাসের ধারে বাংলাদেশ থেকে বহু পরিবার চিকিৎসা করাতে আসে। যারা বাংলাদেশ থেকে হয়তো সিঙ্গাপুর যেতে পারেন না, বড় বড় জায়গায় যেতে পারেন না, ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে পারেন না, তারা তো কলকাতাতেই আসেন। আমরা দেখেওছি প্রচুর বাংলাদেশি পরিবার তাদের রোগী নিয়ে এখানে হাসপাতালে রয়েছেন। তো তাদের পক্ষেও এটা খুব ভালো সংবাদ, সুসংবাদ, সারা বাংলাদেশের পক্ষেও ভালো সংবাদ। এখানে যে পরিষেবা দেয়া হচ্ছে, উনি বারবার বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, নার্সিংহোমগুলো, হাসপাতালগুলো তো সেবাকেন্দ্র। এগুলো কি কসাইখানা নাকি! মানুষ ঘটিবাটি বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে, এটা হয় নাকি! এইটা প্রথম উনি একেবারে চেপে ধরেছেন। আমি মনে করি এটাও কবিতার মহত্ম। যে কবিতা মানবিকতার কথা বলে, যে কবিতা মানুষের মুখ নিয়ে ভাবে, মানবিক মুখ নিয়ে ভাবে, সেটাই তো আসলে কবিতা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনি নকশাল আন্দোলনের কথা বলেছেন, সেই সময়কার মানুষ আপনি। আপনি এখন যে রাজনীতি করছেন বা সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন, একজন কবি এবং একজন রাজনীতিক, তাদের মূল যে উদ্দেশ্য তাতে কি কোনো তফাৎ আছে বলে কি আপনি মনে করেন? আমার মনে হচ্ছে আপনি সেই কেস যাতে কোনো তফাৎ নাই আসলে।

সুবোধ সরকার: আমি মনে করি যে একজন কবি যখন লেখেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক উপাদানগুলো আছে বলেই তিনি কবিতা লেখেন। যদি সেগুলো না থাকত উনি লিখতেন না। কেন লিখবেন একজন কবি! ধরা যাক শক্তিদার কথা বলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়—‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’,—এই কথা যিনি বলতে পারেন, এই ডাক যিনি দিতে পারেন তিনি তো সবচে মানবিক। তো আমি মনে করি সেই একই মানুষ যখন তার সামাজিক ভূমিকা তৈরি হয়, তার সঙ্গে হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক ভূমিকাও হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু একজন কবির যখন সামাজিক ভূমিকা থাকে, সামাজিক মানুষ আর কবি মানুষ বলে আলাদা দুটো অস্তিত্ব হতে পারে না। আমি মনে করি তিনি তার পরিবারে যেরকম একজন মানুষ, পরিবারের কোনো উদ্বেগ তৈরি হলে তিনি যেমন রাত্রে ঘুমোতে পারেন না, ঠিক তেমনি তার পাশের বাড়িতে, তার পাশের বাড়িতে যদি কোনো অঘটন ঘটে, তিনিও তো সেখানে ঘুমোতে পারবেন না। ঠিক একজন কবি যখন সেই পাশের বাড়িকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছেন, একটি ছেলের মুখ হয়তো ভেসে উঠল, আরেকটি মেয়ের মুখ সেই দুঃখের মুহূর্তে ভেসে উঠছে তার কবিতায়, সেটাও তো তার মানবিক ভূমিকা। সুতরাং মানবিক ভূমিকা কবি হিসেবে আলাদা আর সামাজিক মানুষ হিসেবে তার মানবিক ভূমিকা আলাদা এটা হতে পারে না। আমার কাছে দুটো আসলে একটাই, কবিতা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা এখন যখন একটা নতুন কবিতা পড়েন, তখন আপনার মাথায় কী থাকে? কোন প্রত্যাশা নিয়ে পড়েন?

সুবোধ সরকার: কবিতার কাছে সবচেয়ে বেশি যেটা আশা করি, শিক্ষার্থীর মতো রোজ নিজেকে বলি, আমি তো পঁয়ত্রিশ বছর নিলাম ঊনত্রিশটা কবিতার বই লিখতে। এই পঁয়ত্রিশ বছরে আমি প্রতিদিন সকালবেলায় চরঘণ্টা করে বসেছি। কোনো কোনো দিন লিখতে পেরেছি কোনো কোনো দিন পারিনি। পঁয়ত্রিশ বছরে প্রতিদিন সকালে যদি লিখতে পারতাম তাহলে আমার ঊনত্রিশটা বই না, আশিটা বই হয়ে যেত। তা তো সম্ভব নয়। তো কোনো একটা সকালবেলায় বসে শুধু একটা কবিতা বারবার পড়ে হয়তো ছিঁড়ে ফেলেছি আগের লেখা একটা কবিতা। সেটাও একটা কাজ। ছিঁড়ে ফেলাটাও একটা বিরাট কাজ। ছিঁড়ে না ফেললে নতুন লেখা যায় না। তো আমি নিজেকে রোজই শিক্ষার্থীর মতো একটা কথা বলি, যে, আমি যেমন একজন তরুণ কবির কাছে বা একজন প্রবীণ কবির কাছে আশা করি, যে, তুমি আমাকে অবাক করে দাও, তোমার একটি পঙক্তি যেন আজ সারাদিন আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আমার মাথা থেকে যেন সেই পঙক্তি বা সেই লাইনটা যেন নামাতে না পারি। সে যেন আমাকে ছায়ার মতো সব সময় ঘিরে রাখে। এটা যেমন আশা করি তেমনি নিজেকেও বলি ধন্য হয়ে যাব যদি একটা লাইন লিখতে পারি, যে লাইনটা আমার একজন পাঠক কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। এই যে চাওয়া, এই চাওয়াটা কবিতার কাছে চাই। কবিতা তুমি আজকে আমাকে অবাক করে দাও। কেননা চারপাশে এত যখন বিপন্নতা, অসুস্থতা, ব্যাধি, অন্ধকার—এগুলো দেখি তখন তো খুব স্বাভাবিক কারণেই মনটা বিষিয়ে থাকে। তার মাঝখানে যখন কবিতার লাইন উঠে আসে, কবিতার লাইন মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে, মাথা থেকে হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন মনে হয় ঠিক আছে, আজকের দিনটা আমার ভালো যাবে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুবোধদা আপনার অনেক সময় নিলাম আমরা। কত কথাই যে বাকি রয়ে গেল! বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য কিছু বলুন। বাংলাদেশে যারা আপনাকে আবৃত্তি করে তাদের ব্যাপারে বলুন।

সুবোধ সরকার: বাংলাদেশের পাঠক টের পাওয়া যায় যখন বাংলাদেশে যাওয়া যায়। আমার সব সময় বাংলাদেশে যেতে খুব ভাল্লাগে। আমন্ত্রণ ছিল ছিল এবারও। পহেলা ফেব্রুয়ারি। এবং বাংলা একাডেমি থেকেও আমন্ত্রণ ছিল। দুটো জায়গায়—কবিতা উৎসব এবং বাংলা একাডেমি দুটো জায়গারই আমন্ত্রণ ছিল। আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবার যেতে পারিনি, কলকাতা বইমেলাতে এবার এত বেশি বিদেশি অতিথি, বিশেষ করে আমেরিকার, ইউরোপের কবিরা সব এসেছিলেন, তো তাদেরকে ফেলে আমি যেতে পারলাম না। তাদেরকে নিয়ে যদি চলে যেতে পারতাম খুব ভালো হতো। তা সম্ভব হয়নি। তবে আরেকটা আমন্ত্রণ আমি পেয়েছি, সেটাতে যাব। সেটা হলো এই, ৯ তারিখ। নাইন মার্চ, আমাকে টাঙ্গাইল থেকে, না আমি ভুল বললাম, চট্টগ্রাম থেকে, বেশ একটা বড় সংগঠন আমাকে ডেকেছে। তাদের অনুষ্ঠানে ওখানে থাকতে হবে। আমি যাব, একদিনের জন্য হলেও এবার আমি কথা দিয়েছি, আমি সেখানে যাব। বারবার বাংলাদেশে যেতে ভালো লাগে এই কারণে, বাংলাদেশের পাঠকের সামনে বসলে আমার মনে হয় যেন আমি নিজের সামনে বসেছি। নিজের সামনে বসার তো খুব দরকার। বাংলাদেশের পাঠকের আরেকটা গুণ আছে, আমি দেখেছি, যতবার দেখা হয়েছে, পাঠকের সামনে তো বেশি দেখা হয় না, দেখা হয় কবি বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও একজন লেখকের খুব জরুরি। তাতে আমি দেখেছি, বাংলাদেশের পাঠক আমাদের এখানকার পাঠকের চাইতে আরেকটু ক্যান্ডিক, আরেকটু সহজ, আরেকটু স্পষ্ট। আমাকে এরকম বহুজন বলেছে—দাদা আপনার শাড়ি কবিতাটা শুনতে শুনতে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি। একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ওই কবিতাটা আর দেবেন না। এই কথাটা আমাকে এখানে কেউ বলেনি। কিন্তু ওখানে বলেছিল। তারপরে গুজরাটের সময়ে আমি যে আলাদা গোটা একটা বই লিখেছিলাম, সেই কবিতাগুলো আমাকে বহু জায়গায় ছেলেমেয়েরা.... স্মৃতি থেকেও বলে। আমার খুব ভালো লাগে। এবং আমি তো প্রতিষ্ঠিত কবি বা প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পীর কথা বলছি না, আমি বলছি একদম সাধারণ পাঠকের কথা। আমি কিন্তু সব সময় সাধারণ পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। বাংলাদেশে কিন্তু সাধারণ পাঠক আছে। আমি বলব যে কলকাতা বা কলকাতার আশেপাশে বা পশ্চিমবঙ্গেও পাঠক যথেষ্ট। সব সময় যে পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়, তা নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পাঠক অনেক সময় বলব বলব করে বলতে পারে না। আমাকে বাংলাদেশের দু’একজন বলেছে, দাদা, আপনার এই বইটা ভালো লাগে নাই। আপনি এই রকম কবিতা আর লিখবেন না। এই এই কবিতাটা পড়ে বড্ড দুঃখ পাইছি—এরকম বলে। এই যে এই বলাগুলোর মধ্যে খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে বলার একটা প্রবণতা, সেটা কিন্তু বাংলাদেশে পাই, খুব পাই। আমাদের এখানে একটা আর্টিকুলেশন তৈরি করে। যে আর্টিকুলেশনটা একটু সাজিয়ে, একটু ভালো করে, হয়তো একই কথাই বলবে শেষ পর্যন্ত—বড় দুঃখ এই কবিতার বইটিতে রয়েছে আপনার। বিশেষ করে মল্লিকা চলে যাওয়ার পর ওই বইটা যখন লিখেছিলাম—‘একটু আসছি রোরোকে দেখো’ তো সেই বইটা নিয়ে বাংলাদেশের দু’একজন পাঠক আমাকে অমন বলেছিল। তখন খুব অদ্ভুত লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, বাহ! এটা তো সত্যি কথা। এটা তো ভেবে দেখার মতো কথা। এটা কিন্তু বাংলাদেশের পাঠক সরাসরি বলতে পারে। এটা আমার খুব ভালো লাগে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, আমার তো মনে হয় যে কবি কখনো ব্যর্থ হয় না। একটা কবিতা লিখলেও কবি ব্যর্থ হয় না। কিন্তু আমাদের সমাজে সফল কবি ব্যর্থ কবি—এরকম ব্যাপারগুলো আছে। এইটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সুবোধ সরকার: আমার কাছে মনে হয় পাঠক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে একজন কবি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, কিন্তু যিনি পাঠক, তিনি কিভাবে একটা একটা করে কবিতা পড়ে নিজেকে তৈরি করছেন এবং তার সফলতা বা ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। তিনি পাঠক হিসেবে কী বই লিখবেন, আমি সেই পাঠকের কথা বলছি না। তিনি কি পাঠক হিসেবে টেলিভিশনে এসে বক্তব্য রাখবেন, আমি সেই পাঠকের কথা বলছি না। যে পাঠক গোপন, যে পাঠক নিঃসঙ্গ, যে পাঠক একা—তার পিঠে যখন কোনো কবিতা এসে হাত রাখে; সুন্দরবন, আমাদের এদিককার সুন্দরবনের কথা বলছি, সুন্দরবনের একটা গাছতলায় একটা মেয়ে, কম বয়সী মেয়ে, খুব শীর্ণা হয়ে গেছে, তার মাকে নিয়ে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে, সে এগিয়ে এসে একটা কবিতা দেখিয়েছিল আমাকে। তারপর মা এগিয়ে এলেন। এগিয়ে এসে বললেন, এই যে কবিতাটা, এই কবিতা আমার মেয়ের জীবন পাল্টে দিয়েছে। তো আমি মা আর মেয়ের দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলাম, পৃথিবীতে আর কোনো মানুষের দিকে ওভাবে তাকাতে পারিনি। তাহলে এটা সম্ভব! পাঠক, এই যে পাঠক, একটা কবিতা সে দেখাচ্ছে, দেখিয়ে বলছে, এই কবিতা আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। বলল, জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসেছিল মেয়েটা। ওই কবিতাটাকে অবলম্বন করে। এই যে ‘তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি কবিতা’ এই পাঠকের জন্য এই কথাটা প্রযোজ্য। যার কাছে কিছু নেই, অসহায় মানুষ, সে একটা কবিতাকে বিশ্বাস করছে। সে একটা কবিতাকে ভালোবাসে। সে ভালোবাসা এমন একটা ভালোবাসা, যে ভালোবাসার ওপর তার জীবন নতুন করে তৈরি হলো। সুতরাং আমার কাছে মনে হয় একজন পাঠক কী নিচ্ছে কবিতার কাছ থেকে সেটা অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকের জন্যই তো কবিতা। পাঠকই তো ভগবান। পাঠকই তো একটা কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা আপনার কাছে সর্বশেষ প্রশ্ন, সেটা হলো একটা বড় সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের পাঠক শীর্ষেন্দু, সুনীল বা সমরেশকে পড়ছে। অনেক দিন ধরে আপনাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপনাদের সময়ে আপনি কিংবা ধরেন জয় বা এই সমসাময়িক যারা—আপনি আমাদেরকে বাংলাদেশের পাঠকের জন্য এমন দশজন লেখকের কথা বলবেন আগামী দিনে আগমী পাঁচসাত বছরে যাদেরকে আমরা পড়ব।

সুবোধ সরকার: হা হা। তালিকা করে দেয়া খুব মুশকিল। আমি বিশ্বাস করি কবিতার দিক থেকে অনেকেই রয়েছেন যারা খুবই উল্লেখযোগ্য। আমাদের পরবর্তী সময়েও তরুণ কবিদের মধ্যে অনেকে এসেছেন যারা খুবই ভালো লিখছেন। তবে আমি যেটা বলব, আপনাদের কানে খুব অচেনা লাগবে এরকম চারপাঁচজন নবীন কবির কথা আমি বলব। যারা সত্যি সত্যি খুবই ভালো লিখছেন। নবীন মানে একেবারে এই সময়ের, তরতাজা, কম বয়সী। তোমার থেকেও তরুণতর অনেকে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাহ! বলুন। তাদের কথা আমাদের শোনা দরকার।

সুবোধ সরকার: তাদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। তারা খুবই ভালো লিখবে আমি বিশ্বাস করি। যেমন জলপাইগুড়ি থেকে লিখছে সুজিৎ দাস। যেমন কলকাতা থেকে কৌশিকী দাসগুপ্ত, এদেরকে আমরা মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার দিয়েছিলাম। তার পরবর্তী সময়ে যেমন ধরা যাক যে অরুণাভ রাহা রায়, তারপর দেবাশীব চট্টোপাধ্যায়। গল্পেও নতুন লিখছে যেমন বিনোদ ঘোষাল—এই রকম নবীন প্রজন্মের দিকে আসলে আমরা তাকিয়ে আছি। আর আমাদের সময়ে বা আমাদের পরবর্তী সময়ের কথা তো সবাই জানে। তাদেরকে সবাই চিনতে পেরে গেছে। খুব দূরে দূরে থাকেন মফস্বল শহরে, প্রত্যন্ত গ্রামে, যেমর পুরুলিয়ার একটা গ্রামে থাকেন শরোদচন্দ্র; খুব ভালো লেখেন বা অভিমন্যু। দেখা যাচ্ছে কবিতা শুধুমাত্র চ্যাটার্জি, মুখার্জি, ভট্টাচার্য, রায়, শুধু এরাই লিখবে না। এটা মনে হয় ঠিক না। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটু সহজ করে বলে দিই—বাংলা সাহিত্যে একটা ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র আছে। যেমন এক সময় তিন বন্দোপাধ্যায় ছিল। পরবর্তী সময়ে এটা অনেকটাই ভেঙে গেছে। আমরা হয়তো এটা নিয়ে আর ভাবিও না। এটা ভেঙে গেছে বলেই ভারতবর্ষের একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য বলে আলাদা কোনো সাহিত্য নেই। সেটা তো আলাদাভাবে লেখা হয়ে গেছে। আমাদের বন্দোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়রাই তো লিখে গেছেন। সুতরাং সেই দিক থেকে আমি বলব যে নতুন সময়ে যে ছেলেমেয়েরা কবিতা লিখছে তাদের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকব।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

সুবোধ সরকার: ধন্যবাদ তোমাকেও, নাও চা মিষ্টি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;