অন্য আমি



আফসানা বেগম
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই আমার নিজেকে।
মানুষ কতকিছুই না ভয় পায়—সাপখোপ, ভূতপ্রেত এমনকি মানুষ! মা নাকি বর্ষার রাতে সারারাত ঘুমাতে পারত না। মা ঝড়-বৃষ্টি ভয় পেত। আর বড়ো আপা তো ঘরে অন্ধকার দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। আমাকে বলে, ‘ঝুনু, যা তো, আগে গিয়ে লাইটের সুইচটা একটু দে।’ আলো ছড়িয়ে পড়ার পরেও মাথা বাড়িয়ে পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারপর আপা ঘরে ঢোকে। আপা কী যে ভয় না-পায়! চোর-ডাকাত, কুকুর, শুঁয়োপোকা—আপার কাছে ভীতিকর জিনিসের এমন লম্বা লিস্ট আছে যে শেষই হতে চায় না। আপার সাথে দিনরাত থেকে থেকেও অবশ্য তার মতো দুনিয়ার সমস্ত কিছুকে আমি ভয় পেতে শিখিনি। আপা আমাকে ‘তোর সারা পেটে কলিজা’ বলে বহুবার বকাবকি করেছে। আমার খারাপ লাগেনি। এই তো বছর দুয়েক আগের ঘটনা—সন্ধ্যার দিকে লোডশেডিং হলে আমরা কলোনির রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কাঁঠালিচাঁপার কড়া গন্ধে মাঝখানের মাঠটা তখন মাখামাখি কিন্তু গরমে সারা শরীর জ্বলছিল। আপা তার সামান্য ভেজা লম্বা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে বলছিল, ‘ইস্ যদি কয়েকটা ফুল কেউ পেড়ে দিত তাহলে খোঁপায় লাগাতাম!’ যেই কথা সেই কাজ, আমি লাফিয়ে কাঁঠালিচাঁপা গাছে উঠে গেলাম। উত্তেজনায় স্যান্ডেল খুলতেও ভুলে গেলাম। প্রায় দশফুট উঁচুতে মাটির সমান্তরালে মোটা ডাল কলোনির পাঁচিলের উপর দিয়ে আমবাগানের দিকে চলে গেছে, সেই ডালের উপর দিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেলাম। আপার হতভম্ব অবস্থা কেটে গেলে তার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম, ‘অ্যাই ঝুনু, নেমে আয়, এই অন্ধকারে গাছে উঠছিস, মাথা খারাপ নাকি রে তোর?’ আমি ততক্ষণে হাতভরে ফুল নিয়ে নেমে আসায় ব্যস্ত, ‘আপা এই নাও, খোঁপায় লাগাও।’ আপা আমার কান মলে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে খোঁপায় কাঁঠালচাঁপাও লাগিয়েছিল। আপার জন্য আমি সব করতে পারি। এসব করার জন্য আমার সাহসের কোনো অভাব হয় না। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে আমি খুব ভীতু। সবসময় আমি আমার নিজেকে ভয় পাই।

মাঝে মাঝে আমার শোবার ঘরে, যেটা আসলে আগে আমার আর আপার শোবার ঘর ছিল, তার বিয়ে হয়ে যাবার পর এখন শুধু আমার একার, ফাঁকা ঘরটিতে ঢুকতে গেলেই আমি আমাকে দেখতে পাই। হয়ত রাতে ভাত খেয়ে এসে ঘরে ঢুকতে যাব, অথবা স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রাখব, তার আগে আমাকে থমকে দরজায় দাঁড়াতে হয়; তাকিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে আমি পা নাচিয়ে নাচিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছি। আপা বারবার আমাকে বসে থাকলে পা নাচাতে মানা করে, মনে পড়তেই আমি দুলতে থাকা পা দুটো পাথরের মতো স্থির করে ফেলি। আবার হয়তো দেখি আমি গোসল সেরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি। অথবা গল্পের বই নিয়ে বিছানার এক ধারে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ছি। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘরের ভেতরের আকাশটা দখল করে নিচ্ছে অথচ আমার উঠে গিয়ে আলো জ্বালতে ইচ্ছে করছে না। কখনো আবার দেখি কেউ আমাকে জাপটে ধরছে; পশুর মতো লোমশ কালো হাতগুলো আমি কিছুতেই ছাড়িয়ে নিতে পারছি না— আবার কোনো শব্দও করছি না। শুধু নিজের সমস্ত শক্তি লাগিয়ে লড়ে যাচ্ছি। তারপর একসময় আর কোনো শক্তি যখন অবশিষ্ট থাকে না, তখন আমি হার মানি। এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে কখনো চমকে উঠি। সেই আমিটাও এই আমার দিকে চমকে তাকায়! তারপর কখনো মিলিয়ে যায়, আবার কোনো সময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। সেই উপহাসের হাসি দেখে আমার খুব রাগ হয়। সে যেন আমাকে দেখিয়ে দেয়, এই যে এটা তুমি করতে পারো, কেন করো না? কখনোই যে করি না তা নয়। হয়তো স্কুল থেকে এসে দেখলাম, সেই আমিটা আলমারি খুলে কাপড় বদলে আকাশি রঙের স্কার্টটা পরছে। তারপর গোসলের পরে আমিও দেখাদেখি ওই স্কার্টটাই পরি। আজকাল বেশিরভাগই এমন হচ্ছে, ওই আমিটা যা যা করে দেখিয়ে দেয় আমি অন্ধের মতো তাই তাই করতে থাকি।

মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, সে যদি বরাবরের মতো একদিন আর মিলিয়ে না যায়, ধীরে ধীরে সে যদি সত্যি আমি হয়ে যায়! আর তারপর সে বাবার সামনে গিয়ে বলে যে সে-ই ঝুনু, আমি কেউ নই; তখন আমি কোথায় যাব? কী করে প্রমাণ করব যে আমিই আমি?

প্রায়ই মন খারাপ করে ভাবতে থাকি কিভাবে সবাইকে বিশ্বাস করানো যায় যে আমিই ঝুনু, সে কেউ নয়। আমাদের পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে গোপন কোনো কথা অথবা অনেক ছোটবেলার কোনো ঘটনা যা হয়ত কেউ জানে না বা ভুলেই গেছে, আমি ধরিয়ে দিলে মনে পড়বে, সেসব মনে মনে জড়ো করতে থাকি। আপাকে যেদিন ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল, সেদিন আপার রান্না কত ভালো তা বোঝানোর জন্য বাবা বলেছিল যে গরুর মাংস ভুনা আপাই রান্না করেছে। শুনে আমি চমকে ওঠাতে বাবা আমার দিকে চোখ বড়ো করে এক ঝলক তাকিয়েছিল। সেখানে বাবা আর আপা ছাড়া একমাত্র আমিই তো জানতাম যে মাংসটা রান্না করেছে পাশের বাড়ির খালা। ওই ঘটনাটা বললেই বাবা বুঝবে যে আমিই ঝুনু। কারণ এটা তো আর কারো জানার কথা নয়! আবার সেই কোন ছোটবেলার শীতকালের কথা। আপা ভেতরের উঠোনের দিকে উঁচু বারান্দার ধার ঘেঁষে সারি করে গাঁদা ফুলের চারা লাগিয়েছিল। বার্ষিক পরীক্ষার পর একমাস আমরা দাদাবাড়িতে থেকে এলাম সেবার। ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরের বারান্দায় যেতেই দেখি অসংখ্য বড় বড় গাঁদা ফুলে উঠোনের দিকে ঢলে যাওয়া বারান্দার ধার ঢেকে গেছে। সবসময়ের শুকনো বাদামি উঠোনে ওরকম কমলাটে হলুদের বাড়াবাড়ি আমাদের তিনজোড়া চোখকে ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। বিস্মিত বাবা বারান্দার সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়েছিল। আপা প্রজাপতির মতো ওড়না উড়িয়ে উড়িয়ে উঠোনের চারদিকে ঘুরানো বারান্দায় ছুটোছুটি করছিল; বলছিল, ‘বাবা দেখেছো, দেখেছো, আমি গাছ লাগিয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মরেই যাবে।’ বলতে গিয়ে আপা হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছিল। তারপর পুরু মখমলের মতো শ্যাওলা ধরা কালচে সবুজ দেয়ালটার পাশে সে বসেই ছিল ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে। ছোটোকালে ওই দেয়ালটা দেখলে আমি বুঝতাম যে ওটা পশ্চিম দিক। কেউ জানতে চাইলে দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের অবস্থানটা দেখে এসে বলে দিতাম। ডাসা ডাসা ফুলের দৃশ্যের বিস্ময় কমলে ধীরে ধীরে বাবা বলেছিল, ‘কিন্তু পানি কে দিল বল তো, রুনু?’ আপা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘এবার কী ঘন কুয়াশা পড়ল দেখোনি, বাবা? তাতেই পানি দেয়া হয়ে গেছে।’ এই যে সেদিনের প্রতিটি কথা আমার মনে আছে, এটা বললেও কি বাবা বিশ্বাস করবে না যে আমিই ঝুনু?

কিন্তু মুশকিল হলো আমি জানি যে বাবা আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। বাবা আপাকে কত আদর করে! অথচ আমাকে সেভাবে কখনো ভালোবাসেনি। এটা আমরা তিনজনই জানি। বাবা আমাকে চায় না, শুধু সহ্য করে। আচ্ছা, আমার জন্মের সময় মা যে টুপ করে মরে গেল সেটা কি আমার দোষ? আপা হওয়ার বারো বছর পরে আমি জন্মালাম। ডাক্তার বলে দিয়েছিল, হয় আমি না-হয় মা যে কোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। মাকে বাঁচানোর রায় দিতে বাবার একফোঁটাও কষ্ট হয়নি। আমার কাছেও এটাই স্বাভাবিক লাগে। মা সে সময় এই সংসারের জন্য অনেক দরকারি; তার একটা উঠতি বয়সের মেয়ে ছিল আর আমাকে তো বাবা তখন চেনেই না। শুধু শুধু মাকে হারিয়ে আমাকে বাঁচাতে চাইবে কেন? মা বোধ হয় ডাক্তার আর বাবার ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিল তাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেই মরে গেল। এটাই ছিল আমার প্রতি মায়ের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।

মায়ের সেই ভালোবাসার অপরাধে সারাজীবন আমি বাবার ভালোবাসা পেলাম না। আমি কখনো বাবার অবাধ্য হইনি। আমার মতো স্কুলের পনেরো-ষোলো বছর বয়সী অনেক মেয়েরা বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় কোথায় চলে যায় কেউ খবরই রাখে না। জানতে চাইলে বানিয়ে বানিয়ে কত্ত কিছু বলে! বন্ধুবান্ধব তেমন নেই বলে আমাকে সেরকম কিছুও করতে হয় না। তবু বাবা আমার কাজকর্মে খুশি না। আবার আমি খুব ভালো কিছু করলেও বাবা আমাকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে না বরং একটু এড়িয়ে চলে। এই যেমন ক’দিন আগে আমি স্পোর্টসে জিতে দুম করে একটা ট্রফি হাতে করে বাসায় ঢুকলাম, বাবা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বাবাকে দেখে তখন রাগ হওয়ার বদলে আমার মায়াই হলো। তার খানিক পরে আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি দেখি নকল ঝুনু বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে আমার যতই ভয় লাগুক, দরজা বন্ধ করে আমি তখন ভেতরে এসে দাঁড়াই যেন তার এই ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদার শব্দ বাবা শুনতে না পায়। অবশ্য আমি জানি তার যাবতীয় শব্দ কেবল আমিই শুনতে পাই; আমি ছাড়া অন্য কেউ তার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না। তা না হলে দুলাভাই চলে যাবার পরে সেদিন যখন সে তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছিল তখন পাশের ঘরে বাবা মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছিল কেমন করে?

বাবার সাথে সাথে দাদিও আমাকে সহ্য করতে পারে না। বছরের যেটুকু সময় আমাকে বাবা আর আপার সাথে দাদিবাড়িতে কাটাতে হয়, আমি সবসময় চেষ্টা করি দাদির নজর থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে। আমাকে সামনে পেলে শুধু শুধু বকাবকি শুরু করে দেয় দাদি। হঠাৎ করে আমার জন্ম হওয়ার আগে সবকিছু নাকি ঠিকঠকমতোই চলছিল। আমি এসেই সব আনন্দ পণ্ড করে দিয়েছি। আমার জন্ম হওয়াতে মা মারা গেছে। তার পরপরই বাবার চাকরি চলে গিয়েছিল। যদিও মাস ছয়েক পরে বাবাকে আবারও চাকরিতে বহাল করা হয়েছে কিন্তু সেই ছয় মাসে দাদি আমার উপরে দোষ চাপিয়ে, তাদের সব দুর্ভাগ্যের একমাত্র কারণ হিসেবে আমাকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই সবকিছুর থেকে দূরে আমাকে আগলে আগলে রেখেছে বড় আপা। তার প্রথম প্রাণবন্ত খেলনা ছিলাম আমি। তার বুকের ওমে মুখ ডুবিয়ে, তার চুলের গন্ধ শুঁকে আমি বড় হয়েছি। সবরকম ঝড় থেকে স্নেহের পালক বিছিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকা আমাকে সে বারবার আশ্রয় দিয়েছে। সমস্ত অশুভ থেকে আড়াল করে রেখেছে। আর সেজন্যই তো তার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমি খুব একা হয়ে গেলাম। কেবলই মনে হয় আমি মাঝসমুদ্রে ঘুরেফিরে বৃত্তাকারে ওড়া একটা দলছুট গাংচিল। আত্মীয়, সম্পর্ক সবকিছু থেকে একটু দূরত্ব রেখে কেবল উড়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও বসে সামান্য জিরিয়ে নেবার কোনো জায়গা সেই। তবে এটা ঠিক যে আপা যেন কষ্ট না পায় তাই অনেক ভয়ঙ্কর সত্যও তার কাছ থেকে আমি লুকিয়ে রাখতে পারি। আমি প্রায়ই বাইরে থেকে এসে দেখি নকল ঝুনু বসে বসে ফন্দি আঁটছে কখন, কী করে সে আপাকে সব গোপন কথা বলে দেবে। তার ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করলেও এই কাজটা আমি কিছুতেই করি না। বিয়ের পরে আপার এই হাসিখুশি মুখটা নকল ঝুনুকে আমি কিছুতেই নষ্ট করতে দেব না।

বাবার কাছে আমাকে ভালো দেখানোর চেষ্টা করতে করতে আপা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, আমি জানি। বিয়ের পরও সে তার স্কুলে পড়ানোর কাজ শেষে প্রতিদিন এ বাড়ি হয়ে যায়। স্কুল থেকে এসে অনেক সময় আপাকে বাসায় দেখলে আমি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরি। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আমি স্কুলড্রেসের বেল্টটা খুলি, আর আমার ঘরের দিকে যেতে যেতে বেল্ট দিয়ে বাঁধা ওড়না। তারপর আপার দিকে পেছন ফিরে বলি, আপা, কামিজের জিপারটা খুলে দাও তো—কখনো জিপার খুলতে খুলতে আপা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দেয়, তখন আমার কী যে ভালো লাগে! তারপর বাবার খোঁজখবর নিয়ে আপা তার বাসায় চলে যায়। সেদিনও এমনই একটা সাদামাটা দিন ছিল। আপার সাথে যে দুলাভাইও এসেছিল আমি জানতাম না। আমার ঘর থেকে যথারীতি ওড়না খুলে যেই মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে জামার জিপার খুলে চাইতে বেরিয়েছি, দেখি ডাইনিং স্পেসে আপার জায়গায় দাঁড়িয়ে দুলাভাই। আপা মনে হয় তখন বাবার ঘরে। দুলাভাইকে দেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার পিঠে একটা হাত। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই হাত আমার জিপার খুলে বগলের নিচে দিয়ে বুকের ওপরে। আমার মুখে শব্দ বের হতে গিয়েই বাধা পায় একই মানুষের আরেকটি হাতের চাপে। তারপর সেভাবেই কখন আমি ঠেলা খেয়ে আমার ঘরে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি, কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারিনি, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল হাতের চাপে। হাত সরাতেই শ্বাস নিয়ে ঘুরে দেখি দুলাভাইয়ের লাল টকটকে চোখ। সেদিন সেই চোখ ইশারায় আমাকে বলে দিয়ে গিয়েছিল যে এ কথা কিছুতেই কাউকে বলা যাবে না, আপাকে তো নয়ই। অনেক রাত পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি আমাকে ঘুমুতে দেয়নি। আর সেদিনই প্রথম মাঝরাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার বিছানায় আমাকে দেখলাম। দেখি ফোন হাতে নিয়ে রাতদুপুরে বসে আমি কাঁদছি। ক্রমাগত কাঁদছি আর ভাবছি, আপাকে কি ফোন করে জানাব? আমি কাঠ হয়ে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, এ কে? এ এমন করছে কেন? আপাকে সব জানিয়ে দেবে না তো! আমার ইচ্ছে হলো পাগলের মতো তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার জন্য এ বাড়িতে অনেক কিছুই তো হয়েছে, এবার কি আমার জন্য আপার সংসারটাও তছনছ হয়ে যাবে? আমি দরজার ধারে চৌকাঠের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডকীর্তি দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই, সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম আমি পাপোশের উপরে ঘুমিয়ে আছি।

দুলাভাই প্রায়ই অফিস শেষে আপাকে নিয়ে যাওয়ার নাম করে আসতে লাগল। কোনো এক সুযোগে এ ঘরে ঢুকে আমার শরীর হাতড়ে চলে যেত। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে সবাই এক ঘরে থাকা অবস্থায় আপা একটু অন্য দিকে তাকালেই একবার ছুঁয়ে দিল কোমর তো আর একবার বুক। আমি নির্জীব হয়ে যেতাম, আমার মুখ সাদা হয়ে যেত। আপা হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বলত, ‘কী রে, ঝুনু, তোর পরীক্ষা সামনে, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস তো? তোকে কেমন ফ্যাকাশে দেখায় আজকাল।’ কোনোভাবে আমাকে ধরার সুযোগ না পেলে দুলাভাই বাবা আর আপার সামনেই হাসতে হাসতে বলত, ‘টেস্ট পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন, ঝুনু? আসো তো তোমার পাটিগণিতটা একটু টেস্ট করি’—আপা সাথে সাথে বলত, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি একটু দেখো তো, সারাদিন স্কুলে বাচ্চা পড়িয়ে বাসায় এসে এসব ভাবতে আমার আর ভালো লাগে না।’ সুড়সুড় করে দুলাভাইয়ের সাথে আমাকে ঘরে চলে যেতে হতো। আর আমি জানতাম এরপর কী হবে।

টেস্ট পরীক্ষার পরে আমার ক্লাস শেষ হয়ে গেল। সারাদিন ঘুরেফিরে পড়াশোনা করাই তখন আমার কাজ। দুপুরে কলিং বেল শুনে ভাবলাম বাবা নিশ্চয়ই আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এসেছে। দরজা খুলে দেখি দুলাভাই। কিছু বলার আগেই সে আমাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর আর কিছুই বলার সুযোগ হয়নি। একটা দানব আমাকে আমার বিছানার সাথে চেপে ধরেছিল। আমার দুই হাত অসহায় যীশুর মতো দুদিকে দুলাভাইয়ের গজালের মতো হাত দিয়ে আটকানো ছিল। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু প্রতিবাদ করার শক্তি ছিল না। দাদিবাড়িতে যাওয়ার সময় লঞ্চের জানালা দিয়ে ধবধবে দুধসাদা ফেনাগুলোকে যেমন ফুলেফেঁপে উঠতে দেখি, তখন আমি তেমনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আমি জানি পরমুহূর্তে ফেনা নিজেই আবার ছড়িয়ে গিয়ে লঞ্চের ছায়া পড়া কালো কুচকুচে পানির কাছে আত্মসমর্পণ করে। কালো পানির সাথে মিশে যাওয়ার পরে তার সেই ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন কোথায় কালো পানিকে ছাড়িয়ে ওঠার সেই উত্তেজনা? কেবলই নতি স্বীকার! আমার পাশে দাঁড়িয়ে নকল ঝুনু অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেছিল, বারবার জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে পাশের বাসার খালাকে ডাকতে গিয়েছিল। কোনো লাভ হয়নি। তার বিকট আওয়াজ, তীব্র আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। দুলাভাইয়ের তাণ্ডব শেষ হলে নকল ঝুনু ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উন্মাদের মতো ধমকে উঠেছিল, ‘বলে দাও যে তুমি আপাকে বলে দেবে, বলে দাও, বাবাকে বলে দেবে।’ তার কথা শুনে আমি খুব ভুল করেছিলাম সেদিন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো কুড়িয়ে পরতে পরতে যেই দুলাভাইকে আপা আর বাবাকে বলে দেবার হুমকি দিয়েছিলাম, সে আমাকে বাথরুমে টেনে নিয়ে গিয়ে বালতির জমানো পানিতে আমার মাথা ডুবিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষণ। কাশতে কাশতে নাক-মুখ দিয়ে যখন সমানে পানি ঢুকে যাচ্ছে, চুল টেনে আমার মাথা উঠিয়ে লাউডস্পিকারের মতো শব্দে সে জানতে চেয়েছিল, ‘কী বলবে?’ জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে আমি ভেবেছিলাম, তাই তো, কী বলব আপাকে! আমি জানি কয়েক মাস পরে আপার বাচ্চা হবে। আপা প্রতিদিন সেই বাচ্চার জন্য কত স্বপ্ন বোনে! স্কুল থেকে এসে ওইটুকু সময়ের মধ্যে চকচকে চোখে আমাকে সেসব শোনায়, ছেলে হবে না মেয়ে, কী নাম রাখবে—আপার স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে দিতে মন কিছুতেই সায় দেয়নি।

গত এক মাসে এগারো দিন দুলাভাই ভর দুপুরে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনটা কেন যেন অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই নকল ঝুনু ক্রমাগত আমাকে একটাই দৃশ্য দেখাচ্ছে। একই কাজ সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছে। দরজায় কলিং বেল বাজছে, নকল ঝুনু রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে দরজা খুলেই সামনে দুলাভাইকে পেয়ে যাচ্ছে। তারপর দুলাভাইয়ের বুকে ছুরিটা সেঁধিয়ে দিচ্ছে। একই ঘটনা চোখের সামনে বারবার ঘটতে দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই চুলের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে টেবিলের ওপরে খোলা ভূগোল বইয়ে মাখা ঠেকিয়ে রেখেছি। নকল ঝুনু আমার চুল ধরে টেনে উঠিয়ে আবার একই কাজ করে দেখাচ্ছে। দরজার চারপাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর তার মাঝখানে দুলাভাইয়ের পলিশ করা দুটো জুতোর তলা দেখা যাচ্ছে।

হ্যাঁ, সত্যিই বেল বাজছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই। রান্নাঘরে যাই, নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে বড় ছুরিটা হাতে নিই; ঘরে কোনো মানুষ নেই, তবু, এত ধীরে যেন কেউ কোনো শব্দ না পায়। বাবা কদিন আগে কোরবানি ঈদের সময় ছুরিটায় নতুন করে ধার দিয়ে রেখেছিল। এখনো তেমনই তীক্ষ্ন আছে। দরজা খুলতে দেরি দেখে বেল আবার বাজছে। আগের চেয়েও অল্প বিরতিতে বেজে চলেছে। আমি ছুরি নিয়ে দরজার দিকে এগোই—আমি আসল ঝুনু নাকি নকল? কিছুতেই বুঝতে পারছি না!

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;