কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি



ফজল হাসান

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলেবেলায় স্কুলে বিশ্বনন্দিত আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফট-এর (১৬৬৭-১৭৪৫) উপন্যাস ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ আমাদের পাঠ্য ছিল। ব্যঙ্গাত্মক এবং ফ্যান্টাসিমূলক এই উপন্যাসের কাহিনীর পুরোটাই কাল্পনিক। প্রায় তিনশো বছর আগে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির ব্যাপ্তি নিয়ে প্রকাশক জন গ্রে ১৭২৬ সালে বলেছিলেন, ‘বইটি বিশ্বব্যাপী পড়ার মতো, ক্যাবিনেট কাউন্সিল থেকে শুরু করে নার্সারী লেভেল পর্যন্ত।’ আসলে জন গ্রের কথাটাই ধ্রুব। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এতদিন পরে আজও এই আলোচিত এবং আলোড়িত গ্রন্থটির চাহিদা সারা বিশ্বজুড়ে।

স্কুলে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী স্যার আমাদের এত সহজ এবং সাবলীয় ভাষায় ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ পড়িয়েছেন যে, আমরা ক্লাশে প্রায় সবাই একটা ঘোরের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকেছি। স্যারের পড়ানোর সময় আমাদের মধ্যে অনেকের এমন ভাব ছিল যেন আমরাও বুঝি লেম্যুয়েল গালিভারের সফরসঙ্গী এবং তার সঙ্গে সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। প্রায় আটচল্লিশ বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে আছে লিলিপুট এবং ব্রবডিংনাগের কাহিনী। দৈহিক গড়নে লিলিপুটের মানুষজন ছিল খর্ব এবং সেখানে গালিভার ছিল রীতিমতো দৈত্য। অন্যদিকে ব্রবডিংনাগের মানুষদের আকৃতি ছিল বিশাল এবং সেখানে গালিভার ছিল খর্বাকৃতির।

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরের অদূরে নির্মিত ‘ককিংটন গ্রিন গার্ডেনে’ গেলে প্রতিবারই আমার ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’-এর লিলিপুটবাসীদের কথা মনে পড়ে। পড়বেই না কেন? কারণ সেখানে দৈহিক গড়নের দিক থেকে আমি এবং আমার মতো দর্শনার্থী সবাই হলাম লেম্যুয়েল গালিভার এবং আশেপাশের সবকিছু লিলিপুট শহরের মতো ছোটখাটো আকৃতির। ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের ভেতরের রাস্তায় হাঁটলে তাই মনে হয়।

মানুষের তৈরি প্রত্যেক সৃষ্টি কিংবা আবিষ্কারের পেছনে কোনো না-কোনো ঘটনা বা কাহিনী জড়িয়ে থাকে। তবে ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ রচনার আড়ালে সুইফট্ সাহেবের মতিগতি কী ছিল, অথবা কী অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তার মনের মধ্যে, কিংবা কোথা থেকে তিনি উপন্যাসটি লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন, তা আমার জানা নেই এবং আমি কোথাও কোনো তথ্য খুঁজে পাইনি। তবে বর্তমান সময়ের কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি ‘ককিংটন গ্রিন গার্ডেন’ নির্মাণের নেপথ্যে যে ঘটনা বা কাহিনী জড়িয়ে আছে, তা আমার জানা।

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের কোনো এক সময়ে। সেই সময় ডাগ (ডাগলাস-এর সংক্ষিপ্ত) এবং ব্র্যান্ডা সারাহ্ দম্পতি ইংল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ভ্রমণের এক পর্যায়ে তারা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ডেভন শহরের সামুদ্রিক এলাকা ট্যরকোয়ের কাছে বাবাকোম্বের আদর্শ গ্রাম (মডেল ভিলেজ) পরিদর্শন করেছিলেন। সেই আদর্শ গ্রাম দেখে তারা এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ফিরে এসে অস্ট্রেলিয়ায়, বিশেষ করে ক্যানবেরার আশেপাশে, পর্যটকদের জন্য সেই আদলে একটি মিনি গ্রাম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। পুরো এক বছর তাঁরা অর্থনৈতিক অবস্থা, সম্ভাব্য জায়গা, নির্মাণ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগী গাছ-গাছালি নিয়ে গবেষণা করেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে দুই একর জমির ওপর তারা ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, বিশেষ করে মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিং, প্রদর্শন এবং বাগানের ল্যান্ডস্ক্যাপিং। ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৯ সালে এবং উদ্বোধনের পরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, উদ্বোধনের পরে বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনীর জায়গার কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বছরের দুটি বিশেষ দিনে (বাবা দিবস ও মা দিবস) পরিবারের সবার প্রবেশ করার জন্য টিকেট ক্রয় করলে বাবা দিবসে বাবাকে এবং মা দিবসে মাকে বিনিমূল্যে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, এমনকি বাবা কিংবা মায়ের জন্য আলাদাভাবে চা-চক্রের ব্যবস্থাও করা হয় ।

মূলত ককিংটন গ্রিন গার্ডেন দুটি আলাদা এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এগুলো হলো মূল প্রদর্শনী এলাকা বা মেইন ডিসপ্লে এরিয়া এবং আন্তর্জাতিক অংশ। তবে লাল সুড়কির পায়ে চলা পথের দুপাশে এবং ডিসপ্লের চতুর্দিকে বাহারি ফুলের গাছ আছে। শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ডিসপ্লে হলো বাগান থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তের ‘রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশন’। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি ।

মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিং পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই প্রথমে পড়ে মূল প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী গ্রেট ব্রিটেনকে উৎসর্গিত। শুরুতেই একপাশে আছে মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিংয়ের রেপ্লিকা। এখানে আছে হাতে কাটা টার্ফ মেইজ বা গোলকধাঁধা, গ্রামীন বাড়িঘর এবং জনমানব, ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলার মাঠ এবং মেষদের জন্য চারণভূমির মতো অনেক ডিসপ্লে আইটেম। টার্ফ গোলকধাঁধা তিনশো মিটার দীর্ঘ। মালি মোট নয়শো মিটার হেঁটে দশ মিনিটে ঘাস কাটে এবং আরো কুড়ি মিনিটে গোলকধাঁধার আশেপাশে ছেঁটে সুনশান করে। দর্শনার্থীরা অবাক হয়ে প্রতিটি ডিসপ্লে খুঁটিয়ে দেখে, বিশেষ করে দক্ষ হাতের অপূর্ব কারুকাজ। এছাড়া মূল প্রদর্শনী এলাকায় দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে ট্রেন ভ্রমণের ব্যবস্থা। মাত্র কুড়িজন উৎসাহী পর্যটক নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে তেরশো যাত্রী নিয়ে বছরে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ চলে। শুরুতে ট্রেনটি কয়লায় চলত, কিন্তু পরবর্তীতে গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়। চারপাশের নান্দনিক দৃশ্যাবলির মাঝে কুঁ ঝিক ঝিক শব্দ তুলে ধীর গতিতে চলা এই ট্রেন যাত্রা শিশু-কিশোরদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও প্রদর্শনের জন্য আছে মডেল ট্রেন।

/uploads/files/YzdEmGClfm3QO5jMj1TFqrMWVlUorSYO93YtT4bg.jpeg
ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের মূল অংশে টার্ফ মেইজ বা গোলকধাঁধা

মূল প্রদর্শনী থেকে খানিকটা জায়গা পেরুলেই দেখা যায় আন্তর্জাতিক অংশ। এই আন্তর্জাতিক অংশ ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখযোগ্য ডিসপ্লের মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাগ-ঐতিহাসিক আমলের স্টোনহেঞ্জ এবং লিনমাউথ ক্লিথ রেলওয়ে, জর্ডানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক শহর পেট্রার ট্রেজারি বা ‘ট্রেজারি অফ পেট্রা’, উক্রেনের সেইন্ট এন্ড্রু চার্চ, নিউজিল্যান্ডের ফার্ম হাউজ, স্কটল্যান্ডের ব্রেইমার ক্যাসেল, পেরুর মাচ্চু পিচ্চু, ইরানের প্যালেস অফ দারিয়াস, ক্রোয়েশিয়ার সেইন্ট মার্ক’স চার্চ, ইসরাইলের মাসাদা নর্দান প্যালেস, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের বেনডিগোর সেন্ট্রাল ডেবোরাহ্ গোল্ড মাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার আদিবাসীদের বিশেষ ধরনের ঘর ‘টোরোগান’। এখানে তিরিশটিরও অধিক দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে স্থান পেয়েছে। তবে ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দেশের নতুন আইটেম নিয়মিতভাবে যোগ করা হয় ।

/uploads/files/KZEBpZhu6NOt3LXTXK6EBYzA6uMOfB8oCeLfpztt.jpeg
ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের আন্তর্জাতিক অংশে উক্রেনের সেইন্ট এন্ড্রু চার্চ

উল্লেখ্য, ককিংটন গ্রিন গার্ডেনে যেসব দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে নেই, সেসব দেশ ইচ্ছে করলে নাম লিখিয়ে রাখতে পারে। পরবর্তীতে গার্ডেনের কর্তৃপক্ষ সুযোগ ও সুবিধা মতো সংযোজন করবে। অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটক বা ভ্রমণার্থীদের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি উত্তম পন্থা। আমি মনে করি প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে স্থাপনের ব্যাপারে ক্যানবেরায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নিঃসন্দেহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

/uploads/files/stLTfC3zHkziFZzpuBKLiubW4q1rWeKAQeyy8ze5.jpeg
ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের আন্তর্জাতিক অংশে নিউজিল্যান্ডের ফার্ম হাউজ

ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের ভেতরে প্রবেশ করার মুখেই রাস্তার দুপাশে সারি সারি সুসজ্জিত ফুলের গাছ। পুরো গার্ডেন এলাকায় পঁয়ত্রিশ হাজারেরও অধিক ধরনের ফুলের গাছ আছে। ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হয়। তাই সারা বছরই রং-বেরঙের ফুল ফোটে। এছাড়া আছে ডোয়ার্ফ ম্যাপেল গাছ, কনিফার এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় গাছগাছালি। অনেক দর্শনার্থী থেমে প্রস্ফুটিত ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তুলে ভ্রমণকে সাক্ষী হিসাবে ধরে রাখে। অনেকে হয়তো কোনো অলস মুহূর্তে স্মৃতির ঝাপি খুলে ছবিগুলো বের করবে এবং নস্টালজিয়ার ধূসর জগতে কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকবে।

/uploads/files/GMswf1aqXS2gvRcWXTbPtBwvAcNeCw6kh1yMQvTp.jpeg
ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের প্রস্ফুটিত পুষ্পরাজির একাংশ

আগেই উল্লেখ করেছি, ককিংটন গ্রিন গার্ডেন থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তের ‘রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশন’, যা শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। এখানে রয়েছে দুটি ‘ডল হাউজ’ (বা পুতুল বাড়ি)। বাড়ি দুটির বিশেষ তাৎপর্য হলো নিঁখুত কারিগরি দক্ষতায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি অংশ নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রেগরিয়ান স্টাইলে নির্মিত ওয়েভার্লি ডল হাউজের অভ্যন্তরে চৌত্রিশটি কক্ষ রয়েছে এবং প্রতিটি কক্ষই সুসজ্জিত। অন্যদিকে ‘মিসরুল’ বাড়িটি অস্ট্রেলিয়ার লেখিকা ইথেল টার্নার রচিত এবং ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত ‘সেভেন লিটল্ অস্ট্রেলিয়ানস্’ কিশোর উপন্যাসের কথিত বাড়ির আদলে নির্মিত। বহুল প্রশংসিত এই উপন্যাসের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে ১৯৩৯ সালে চলচ্চিত্র এবং ১৯৭৩ সালে টিভি সিরিজ তৈরি করা হয়।

/uploads/files/0ZICEPJpNNfru7Dzbmlwg0hvJ4unxVX6CkvinMgm.jpeg
ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশনে ওয়েভার্লি ডল হাউজ

হাঁটাহাঁটির ক্লান্তি কিছুটা নিরসন করার জন্য এবং শুকনো গলাটা ভিজানোর উদ্দেশ্যে ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ক্যাফেতে ঢোকা আমার পুরোনো অভ্যাস। ফেনায়িত কাপুচিনোর ভরা মগ সামনে নিয়ে ভাবতে থাকি। আসলে কারোর মধ্যে অদম্য উৎসাহ এবং ভালো কাজ করার নির্ভেজাল মন-মানসিকতা থাকলে তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। হয়তো অপ্রত্যাশিত বাধা-বিপত্তি এসে সাময়িকভাবে কাজের গতি শ্লথ করে দিতে পারে, কিন্তু চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে না। কয়েক প্রজন্ম ধরে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসা ককিংটন গ্রিন গার্ডেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

একসময় আমি ধূমায়িত কফির ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে জমা করে এবং জিহবায় কাপুচিনোর গাঢ় স্বাদ লাগিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসি। চোখের অদৃশ্য অ্যালবামে ডাকটিকেটের মতো সেঁটে রাখি নান্দনিক দৃশ্যাবলি এবং ডিসপ্লে আইটেমগুলো। প্রতিবার ককিংটন গ্রিন গার্ডেন থেকে বেরোনোর সময় আমার মনে হয় এখন যদি সুইফট্ সাহেব বেঁচে থাকতেন, তাহলে কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি দেখে তিনি নিশ্চয়ই যারপরনাই খুশি হতেন।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ছবি তুলেছেন ক্যানবেরা নিবাসী বন্ধু মোহাম্মদ কুদ্দুস। তবে ‘প্রস্ফুটিত পুষ্পরাজির একাংশ’ ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ।]

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;