ব্রহ্মাণ্ডের গোধূলিকাল



ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা গ্যালিলেও’র হাত ধরে, তাঁর দুরবিনে চোখ রেখে, শুরু হয় ১৬১০ সালে। কিন্তু তার আগেই আধুনিক চিন্তাধারার বীজ রোপিত হয়। বলতে গেলে সেই বীজ রোপণের সালটা ১৫৪৩ অব্দ এবং কাজটা শুরু করেছিলেন প্রুশিয়ার পোলিশ বংশে জন্ম নেওয়া নিকোলাস কোপার্নিকাস। ‘অন দ্য রেভোল্যুশনস অব দ্য সেলেশ্চিয়াল স্ফিয়ার্স’ গ্রন্থে কোপার্নিকাস এক যুগান্তকারী ধারণা প্রদান করেন। দীর্ঘদিন থেকে জানা ছিল পৃথিবী স্থির এবং সূর্যসহ অন্য সব কিছু একে ঘিরেই ঘুরছে। পৃথিবীকেন্দ্রিক এই ধারণা সুপ্রাচীন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এই ধারণার এক গাণিতিক মডেল দেন ক্লডিয়াস টলেমি (৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। পূর্বসূরীরা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে যা কিছু জানতেন তার এক অনবদ্য সংশ্লেষণ টলেমি তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেন। তিনি এই পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণার একটি গাণিতিক মডেলও স্থাপন করেন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে টেলিস্কোপ ছিল না। খালি চোখে মনোযোগী পর্যবেক্ষকরা যা দেখেছেন তারই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাজেই তাঁদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু টলেমির বইটি একটানা চোদ্দশত বছর এই মডেলকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু টলেমির মডেলে সংশোধন প্রয়োজন ছিল। মুসলিম বিশ্বের অনেক জ্যোতির্বিদই সেটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু কোপার্নিকাস একটা চমৎকার সহজ গাণিতিক মডেল উপস্থাপনের মাধ্যমে দেখালেন যে, ‘পৃথিবী কেন্দ্রে আছে’ এটা না ভেবে সূর্যকে কেন্দ্রে ভেবে নিলে গ্রহ-তারাদের গতি ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। এই সহজ কল্পনাটি একদিকে যেমন যুগান্ত সৃষ্টি করে, অপরদিকে তেমনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়।

/uploads/files/BCbNa3lRvAKZgV7WC5fCxRuW2Sm0gra7QIFEvwYV.jpegনিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)

কোপার্নিকাসের এই কাজটি শুধু ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটা একটা নীতিতে পর্যবসিত হয়—কোপার্নিকাসের নীতি। এই নীতি অনুযায়ী পৃথিবী কোনো কিছুর কেন্দ্রে নেই, এমনকি কোনো বিশেষ অবস্থানেও নেই, কোনো বিশেষ গুণের অধিকারীও নয়। এই মাঝারিত্ব বা মিডিওক্রিটি বিজ্ঞানে অনেক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। এই নীতির সম্প্রসারণ মহাবিশ্বের সার্থক মডেল সৃষ্টিতেও কাজে লাগে। মহাবিশ্বকে দিকনিরপেক্ষ ও সমসত্ত্ব ধরে নেওয়া হয়। এভাবে ভাবা হয়— আমরা পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সিকে যেভাবে দেখছি, গ্যালাক্সির অন্য জায়গা থেকেও গ্যালাক্সিকে প্রায় অনুরূপ দেখা যাবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে মহাবিশ্বকে যেমন দেখায়, স্থানীয় পার্থক্য বাদ দিলে অন্য গ্যালাক্সি থেকেও মহাবিশ্বকে মোটের ওপর তেমনই দেখাবে। এটাই মহাজাগতিক নীতি বা কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপল। এই নীতির জন্যই আমরা পুরো মহাবিশ্ব নিয়ে মডেল তৈরি করতে পারি। কম্পিউটার সিমুলেশন করে মহাবিশ্বের নানান প্যারামিটার গণনা করতে পারি। পর্যবেক্ষণের সাথে মিলাতে পারি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি করতে না পারলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা পূর্ণাঙ্গ হতো না। আর এই কাজটির পেছেনে আছে ঐ নীতি—আমরা মাঝারি, অন্যরা যেমন আমরাও তেমন। অন্য যেকোনো জায়গায় গেলে, আমাদের মতো গ্রহ ও পরিবেশ ঠিক ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

কিন্তু ইদানীংকালের পর্যবেক্ষণ এটা ঠিক সমর্থন করছে না। আমরা জেনেছি, সূর্য বামন নক্ষত্র হলেও গ্যালাক্সির অধিকাংশ নক্ষত্র সূর্যের তুলনায় ছোট। গ্রহ পাথুরে হলেই তা প্রাণবান্ধব হয় না। বাহ্যগ্রহ (exoplanet) মানেই সেটাপ্রাণবান্ধব এবং পৃথিবীসদৃশ হবে, এমনটিও নয়। মূলত বেশিরভাগ বাহ্যগ্রহই ‘হট জুপিটার’। অর্থাৎ এইসব বাহ্যগ্রহের বেশিরভাগেরই ভর বৃহস্পতি গ্রহের মতো বিশাল (বা তারও বেশি) এবং এদের অবস্থিতি তাদের নক্ষত্রের অত্যন্ত কাছে (বুধগ্রহ যেমন সূর্যের খুব কাছে)। আগে মনে করা হতো, নক্ষত্রের অত্যন্ত নিকটে খুব বড় গ্রহ থাকতে পারে না। কিন্তু বাহ্যগ্রহদের ভর ও নক্ষত্র থেকে তাদের দূরত্ব পর্যালোচনা করে দেখা যায় ‘হট জুপিটার’দের সংখ্যাই বেশি। সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি বিষয়ক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্য ‘হট জুপিটার’দের এই আধিক্য সমস্যাজনক। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই কাজে আজকাল শক্তিশালী কমপিউটার সিমুলেশনের সাহায্য নিচ্ছেন। এমনকি আমাদের নিজেদের সৌরজগতের বিষয়েও এইসব সিমুলেশন বেশ চমকপ্রদ সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে। যেমন প্লুটোর কক্ষপথেরও বাইরে এক বা একাধিক বড় গ্রহ ঘুরপাক খাওয়ার একটা প্রকট সম্ভবনা আছে বলে গ্রহবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এমনকি আমাদের সৌরজগতের সুস্থিতি এবং সূর্যের নিঃসঙ্গতাও (সূর্য কোনো তারাস্তবকের সদস্য নয়, কেন নয়?) প্রণিধানযোগ্য।

এইসব বিষয়ে সতর্ক থেকেও এটুকু বলা যায়, আমরা কোনো কিছুর কেন্দ্রে না থেকেও যথেষ্ট বিরল। অনন্যসাধারণ না হয়েও সাধারণের ঊর্ধ্বে—যা সুলভ নয়। বিশ্বজগতে আমাদের অবস্থান সবদিক দিয়েই একদম ঠিক। আমরা বিশেষ কিছু নই, আমরা কোনোকিছুর কেন্দ্রেও নেই। এরকম গোল্ডিলক্স জগৎ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে সবকিছুই একদম ঠিক ঠিক।

বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যদি মহাজাগতিক ধ্রুবক শাসিত হয়, যদি এর স্থানিক জ্যামিতি সমতল হয়, যদি এর বস্তু-ঘনত্ব ২৫% এর কম হয়, তাহলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এর পরিণতি উন্মুক্ত হবে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। এই প্রসারণ ত্বরিৎ-হারে হতে পারে। যেটা ১৯৯৮ সালের গবেষণায় একাধিক জ্যোতির্বিদ দেখিয়েছেন। এই ত্বরণ ধ্রুব থাকতে পারে, কমে যেতে পারে, বেড়ে যেতে পারে। কোনটা হবে সেটা এখনই আমরা জানি না।

উন্মুক্ত এবং ত্বরিৎ প্রসারমাণ বিশ্বে পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল পর আর কোনো কাঠামোই থাকে না। গ্যালাক্সি বিলুপ্ত হয়ে যায়, সব তারা নিভে যায়, কৃষ্ণবিবরগুলি হকিং বিকিরণ দিয়ে উবে যায়। এ অবস্থায় মহাবিশ্বে থাকে শুধু কিছু ব্যাপ্ত গ্যাস আর মৌলিক কণার সমাহার। কোনো কাঠামো নেই, কোনো শক্তির উৎস নেই—শুধুই পরিব্যাপ্ত ও অত্যন্ত হাল্কা গ্যাস। এই অবস্থা গ্যাসের প্রচলিত গতিতত্ত্ব অনুযায়ী তাপীয় সুস্থিতির (থার্মাল ইকুইলিব্রিয়াম) সমতুল্য। তাপীয় সুস্থিতি বা ইকুইলিব্রিয়ামে থাকলে কোনো ব্যবস্থার আর কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়, কারণ ঐ অবস্থায় সিস্টেমের এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলার মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। ‘তাপীয় সুস্থিতির’ অন্য অর্থ ‘মৃতবৎ অবস্থা’। কোনো সিস্টেমের সকল উপাংশ যদি পরস্পরের সাথে একই তাপমাত্রায় থাকে, অর্থাৎ থার্মাল ইকুইলিব্রিয়ামে থাকে, তাহলে তাপের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই শক্তির রূপান্তরও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ভৌত পরিবর্তন থেমে যায়। একটি জীবন্ত কোষ সবসময়েই তার বাইরের পরিবেশের সাথে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই নন-ইকুইলিব্রিয়ামই প্রাণের লক্ষণ। কোষ যখন মারা যায় তখন বাইরের সাথে তার ইকুইলিব্রিয়াম ফিরে আসে।

মহাবিশ্বের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার একটু এদিকওদিক হলেই এখানে প্রাণই সৃষ্টি হতো না, বুদ্ধিমত্তা তো দূর কি বাত! মহাবিশ্বের ক্রমপরিণতির এমন এক পর্যায়ে আমরা বাস করছি যখন বিশ্বময় নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি কমে আসছে, মহাবিশ্বের ত্বরিৎ প্রসারণ হচ্ছে, ডার্ক এনার্জি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ১০০ বিলিয়ন বছর পর কোনো বুদ্ধিমান সত্তাই আর দূরাগত কোনো গ্যালাক্সির আলো দেখবে না। তার পক্ষে বিগ ব্যাং বোঝাটাই শক্ত হবে। মনে হচ্ছে, যেন আমরা মহাবিশ্বের এক গোধূলি সঙ্কটের একদম প্রারম্ভে অবস্থান করছি।

অনেক বিজ্ঞানীই বলছেন যে, আমরা মহাবিশ্বের সর্বোত্তম সময়ে বাস করছি। এটা এমন একটা সময় যখন মহাবিশ্ব একটা দীর্ঘ গোধূলিকালে প্রবেশ করছে। মহাবিশ্বের প্রায় সকল স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরক ক্রিয়াকলাপ থেমে গেছে। ডার্ক এনার্জির প্রভাব বাড়ছে। মহাবিশ্ব ত্বরিৎ হচ্ছে। এই ত্বরণের ফলে স্থানীয় সুপারক্লাস্টার বাদে আর সবকিছু দূরে সরে যাবে। স্থানীয় সুপারক্লাস্টারে যেসব গ্যালাক্সি আছে তারা নিজেদের মহাকর্ষীয় বাঁধনে বাঁধা। ফলে মহাজাগতিক ত্বরণ এদের ওপর ক্রিয়া করে না। কিন্তু অন্য গ্যালাকটিক সুপারক্লাস্টারেরা ক্রমশ দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। আগামী ১০০ বিলিয়ন বছরে আমাদের গ্যালাক্সি এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিলিত হয়ে এক সুপারগ্যালাক্সি তৈরি করবে। রাতের আকাশ তখনও তারা ঝলমলে থাকবে। কিন্তু দূরবর্তী জ্যোতিষ্ক আর দেখা যাবে না। এই সময়ের কোনো জ্যোতির্বিদের পক্ষে বিগ ব্যাং আদৌ হয়েছিল কিনা সেটা জানাই মুশকিল হবে।

এদিকে নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বিগ ব্যাঙের সময়ে যতটুকু হাইড্রোজেন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ফুরিয়ে যেতে থাকবে। আরো ১০০ ট্রিলিয়ন বছর পর থাকবে শুধু বাদামী ও ধূসর বামন তারা, কৃষ্ণ বিবর এবং পরিব্যাপ্ত গ্যাস।

ভলতেয়ারের ‘কাঁদিদ’ উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট কাঁদিদের প্রিয় দার্শনিক প্যানগ্লসের মতে আমরা সম্ভাব্য সকল বিশ্বের মধ্যে সর্বোত্তমটিতে বাস করছি। কিন্তু নিজের জীবনের ঘটনাবলি থেকে কাঁদিদ দেখতে পায় যে আসলে আমরা একটা ঘটমান জগতে বাস করি যেখানে যা কিছু ভালো সেটা নিজেদেরকেই তৈরি করে নিতে হয়। ‘সবকিছুই ভালোর জন্য’ এই লাইবনিৎসিয়ান আশাবাদ এক মরীচিকা মাত্র।

কিন্তু আজকের ব্রহ্মাণ্ডে কোপার্নিকাসের মিডিওক্রিটির নীতিকে ছুটি জানাতে হবে, পৃথিবীর বিরলত্ব স্বীকার করে নিতে হবে, এবং মনে রাখতে হবে প্যানগ্লসের মতো আমরা সম্ভাব্য সকল কালের মধ্যে সর্বোত্তম কালে বাস করছি। এটা এমন এক সময় যখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা তত্ত্ব নির্মাণ করতে পারি, এবং অতিদূর জ্যোতিষ্কের আলো পর্যবেক্ষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। দূর ভবিষ্যতে সেটা আর সম্ভব হবে না। তখন যদি কোনো ধীমান সত্তা বেঁচে থাকে তাহলে তাকে হয়তো দর্শন ও সাহিত্যের সাহায্যেই জগতের রহস্যভেদ করতে হবে। কসমোলজি বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা তখন আর সম্ভবপর হবে না।

অতএব, এখন যৌবন যার, কসমোলজি শেখার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়!

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;