নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র



রোজেন হাসান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভালো কবিতা অনেকেই লেখেন, যে কবিতাগুলো পড়ে পাঠকেরা আপ্লুত হন। এই কবিতাগুলো অনেকটাই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার সাথে মিলে যায়। পাঠকেরাও পূর্বকবিদের কবিতা পড়ার কারণে এই ভালো কবিতাগুলোর ভাষা-ভঙ্গিমাকে চিনতে পারেন। তাই যখনই ওইসব গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার মতো কবিতা কোনো কবি লেখেন, সেগুলো পাঠকদের পূর্বঅভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায় এবং তারা বাহ্ বাহ্ বলে ওঠেন এবং সেগুলো ভালো কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন কোনো কবি কথিত ভালো কবিতা লেখেন না, এর বিপরীতে নিজস্ব কাব্যভাষায় নিজের কবিতা লেখেন। এই কবির নিজস্ব কাব্যভাষা আসে তার নিজস্ব কাব্যজগত থেকে। যে জগত তিনি পৃথিবীর চির ইতিহাসের মাঝে বিরাজমান চিন্তা, প্রাণ এবং বস্তুর সাথে নিজের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে তৈরি করেন। ফলে তার কবিতা নতুন হয়ে ওঠে। আর তার কবিতার এই নতুনত্বের কারণেই অতীতের কবিতায় অভ্যস্ত এবং সাম্প্রতিক কালের ভালো কবিতার দৌরাত্ম্যের কবলে পড়ে পাঠকেরা এই কবিতাগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।

পাঠকদের মতো সমালোচকেরাও সমস্যায় পড়ে যান কেননা তারা এইরকম কবিতা আগে পড়েননি। আর যা আগে পড়েননি সেরকম কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু আশার কথা হলো একসময় এইরকম কবিরা গৃহীত হন পাঠক এবং সমালোচক মহলে। সময়ের সাথে সাথে এই কবিদের—যারা সংখ্যায় খুব নগন্য—কাব্যজগতটি ধীরে ধীরে ভাস্বর হয়ে ওঠাই এর মূল কারণ। যখনই তাদের জগতটি উন্মেচিত হতে শুরু করে, তাদের আসে গৃহীত হবার পালা, তখন পাঠক এবং সমালোচকরা উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। এই কবির অনুসারীতে কবিতা লেখকদের ছোট পরিধিটি দ্রুত ভরে যেতে থাকে। এই কবি নতুন কবিদের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন। অবশ্য তার অনুসারীরাও ভালো ভালো কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই ধারা চলতে পারে এমনকি যুগ থেকে যুগ পর্যন্ত। বিনয় মজুমদারও সেই নতুন কবিতা সৃষ্টিকারী কবি, যাঁর রয়েছে একটি স্বতন্ত্র কবিতাবিশ্ব, রয়েছে একটি নিজস্ব কাব্যভাষা। ভালো কবিতালেখকদের ভিড়ে তিনি তাই এক নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র। যার আলো বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে আসে। তাই তাঁকে বুঝতে পাঠকদের এবং সমালোচকদের একটু সময় লেগেছে, সময়টা একটু বেশিই।

কী রয়েছে তাঁর কবিতাবিশ্বে? তাঁর কবিতা বিশ্বের স্তম্ভগুলো হলো গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং দর্শন। এই সবকিছুকেই তিনি মিলিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার সাথে, আর অভিজ্ঞতার হীরক স্পর্শে এইসব উপাদান বিনয় মজুমদারের নিজস্বতায় চিহ্নিত হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাংলা কবিতাতেও খুলে দিয়েছে নতুন নতুন সব জানালা। তার কাব্যভাষাটিও তাই নতুন। তিনি কবিতায় আবেগকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করেন। কবিতাসহ শিল্পের যে কোনো শাখায় অতি আবেগ এবং আবেগহীনতা এই দুটি জিনিসই ক্ষতিকর, বিনয় মজুমদারের কবিতায় আবেগ সবসময় এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান করে; তিনি তাঁর কবিতার জন্য এমন একটি ভাষা নির্মাণ করেছিলেন যেটিতে অনায়াসে গভীর চিন্তাকে উপমা, চিত্রকল্পে ব্যক্ত করা যায়। তাঁর কবিতার ভাষায় গণিতের বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তিরও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেখানে। তবে একসময় তিনি ক্রমশই সহজ-সরলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই কবিতাগুলোতে চারপাশের মানুষ, উদ্ভিদ এবং বস্তু পারস্পরিক পারম্পর্য তৈরি করে ভিন্ন অর্থবোধকতা তৈরি করে। বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে কিছু পঙ্ক্তি পড়া যাক—

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না-ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল—
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
[ফিরে এসো, চাকা]

পৃথিবীর আকর্ষণে ফুলগুলি নুয়ে পড়ে, ঝ’রে পড়ে যায়।
কিন্তু দ্যাখো, পাখিগুলি স্বেচ্ছাধীন নেমে পুনরায় উড়ে যেতে পারে।
চেষ্টাকৃত পদ্ধতিতে অসময়ে জন্ম দিতে গেলে
শিশু মরে যেতে পারে, এ সত্যটি চিকিৎসক জানে।
[গায়ত্রীকে]

অমিল পয়ার ছন্দে রচিত বসন্তকাল শেষ হয়ে এলো।
পথের উপরে আজ দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম চারিপাশে মাঠ
কালো কালো ধানগাছ ঢাকা আছে, এই সুমুদ্রিত ধানগাছগুলি
আমার এ জীবনের বসন্তের অভিজ্ঞতা।
[বসন্তকাল]

তিনি অনেকটা সুফি কবি মনসুর আল-হাল্লাজ এবং মাহমুদ শাবিস্তারির মতো মেকি আবরণ ছেড়ে কবিতার অন্তঃসারটিকেই মুখ্য ভূমিকা দিতে চান। মিউজগণ এবং দুয়েন্দের বিপরীতে তাঁর ছিল গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন। বাস্তবেও তিনি গণিতচর্চায় মুখর থাকতেন। গণিতে তাঁর কিছু আবিষ্কারও আছে।

দুই.

বিনয় মজুমদার তাঁর কবিতায় উৎসর্গকৃত জীবন, গায়ত্রী চক্রবর্তীর প্রতি প্রেম এবং তাঁর বারবার পাগল হয়ে যাওয়া নিয়ে মিথে পরিণত হয়েছেন আজ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন, সেই নারীটি হলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্রীর সাথে তাঁর কথা হয়েছিল মাত্র তিন-চারবার। পরে বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু গায়ত্রীর প্রতি প্রেম এবং সেই প্রেমের অভিঘাত স্থায়ী হয়েছিল তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী। কৃতিত্বের সাথে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন এবং সেইকালের মোটা অংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র কবিতায় আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করার জন্য। তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’র সেই ৭৮টি শিল্পের উত্তুঙ্গ শিখরস্পর্শী কবিতা লেখা সম্ভব হয়েছিল মনে হয় কবিতায় এই বিশুদ্ধ আত্মনিবেদনের ফলেই। এই বইটির নাম গায়ত্রী চক্রবর্তীর নাম থেকেই নেওয়া, তিনি পরে বলেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তীকে তিনি রূপান্তরিত করেছিলেন ‘গায়ত্রী চাকা’তে। বইটি উৎসর্গও করেছিলেন তাঁকেই।

এই বইয়ের কবিতাগুলোতে আমরা যে বিনয় মজুমদারকে পাই তিনি একাধারে দার্শনিক, বিরহী প্রেমিক, জীবনের গহীন অতল সমস্যাগুলোর পর্যবেক্ষক, বৈশ্বিক বোধের অধিকারী, বিজ্ঞানে নিবেদিত এবং এমন এক কবিসত্তায় উত্তীর্ণ কবি যিনি বিশ্বের মাঝে মানবাত্মার দুরূহ জীবনের বহুবিস্তারী সুন্দরের অনেকগুলো জানালা খুলে দেন। বইটি থেকে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেল—এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল।

২.
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়—
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।

৩.
স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ-চূর্ণ লোহিত সূর্যাস্ত ভেসে আছে;
নিশ্চল, যদিও নিম্নে সংলগ্ন অস্থির স্রোত বয়।
এখন আহত মাছ কোথায় যে চ’লে গেছে দূরে,
তুমিও হতাশ হ’য়ে রয়েছো পিছন ফিরে, পাখি।
এখনো রয়েছে ওই বর্ণময়, সুস্থ পুষ্পোদ্যান;
তবুও বিশিষ্ট শোকে পার্শ্ববর্তী উদাত্ত সেগুন
নিহত, অপসারিত, আর নেই শ্যামল নিস্বন।
কেন ব্যথা পাও পৃথিবীর বিয়োগেবিয়োগে?

৪.
শুনেছি সবার মাঝে একটি কুসুম ঘ্রাণময়ী;
ব্যথিত আগ্রহে দেখি; এত ফুল, কোনটি বুঝি না।
যে-কোনো অপাপবিদ্ধ তারকারো জ্যোৎস্না আছে ভেবে
কারো কাছে যেতে চাও, হে চকোর, স্বপ্নচারী, বৃথা।

৫.
অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার
সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে; বাতাসের
নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

৬.
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রন্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হ’লে কী প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হ’য়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয়;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্ব’লে ওঠে।

৭.
শ্বাশ্বত মাছের মতো বিস্মরণশীলা যেন তুমি।

এই কবিতাগুলো শিল্পের সেই উর্ধ্বমেঘে ডানা মেলেছে, যেখানে একজন কবির যাবার প্রত্যাশা থাকে। পাঠকদের জন্যেও এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ-বইয়ে শিল্প সক্ষমতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন বিনয় মজুমদার।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত এর কবিতাগুলো জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অবশ্য বিনয় মজুমদারও একবার বলেছিলেন তিনি সারাজীবন জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময় প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আজ এটি প্রতিষ্ঠিত যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। এটি অনন্য, যদি প্রভাবিত হওয়ার বিষয় থাকেও, সেটি তিনি করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য, মানে জীবনানন্দকে তিনি একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এখানে। জীবনানন্দ দাশের কাব্যজগত এবং বিনয় মজুমদারের কাব্যজগত সম্পূর্ণ পৃথক।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার দীর্ঘকাল পর তিনি একটি আশ্চর্য কবিতার বিষয়বস্তু খুঁজে পান। সেই বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে একমাসে ছয়টি দীর্ঘ কবিতা লিখলেন। তিনি নিজে বলেছিলেন, “১৯৭৪ এক মাসের মধ্যে এ যেন একটা বিশাল যুগ পার হয়ে যাওয়া।” এই কবিতাগুলোই লিপিবদ্ধ হলো ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বইয়ে। বাংলা সাহিত্যে স্বার্থক দীর্ঘকবিতা হিসেবে এই কবিতাগুলো এক অনন্য উদাহরণ। কবিতাগুলোতে তিনি একজন দ্রষ্টার মতো বস্তুর, দৃশ্যের, সময়ের, অন্তর্নিহিত সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। এখানে দেখা যায় তিনি একটি বিষয় নির্বাচন করেছেন, এবং এরপর সেই বিষয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন, সিদ্ধান্ত টেনেছেন, এরপর এরকমভাবে আরেকটি বিষয়ে গেছেন। এগুলো স্বার্থক দীর্ঘকবিতা কারণ কবিতাগুলোকে দশ-বারো লাইনের লিরিক কবিতার মতো টেনে-টেনে বড় করেননি তিনি। এখানে কবিতায় উপস্থাপিত বিষয়বস্তুই প্রধান, একজন কথক তো আছেনই কিন্তু লিরিক কবিতার কবির মতো তিনিই মুখ্য নন, কবির নিজস্ব আবেগই মুখ্য নয় এখানে। কবিতায় আসা প্রতিটি বিষয় এবং ঘটনাই মূল ভূমিকা নিয়ে চিত্রকল্পে, উপমায়, বর্ণনায় হাজির হয়েছে। তাই পাঠকদের ক্লান্তিবোধ জাগে না, বারবার পড়ার পরেও। কবিতাগুলো মহাপয়ারে লেখা। তিনি অবশ্য তাঁর প্রায় সব কবিতাই পয়ার এবং মহাপয়ারে লিখেছেন। বইটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
যদি কাছাকাছি থাকি তবে আর অকারণে উদয়ের ভাবনায় কখনো পড়ি না।
থাকে না এমন ভিড়ে খুঁজে-খুঁজে সপ্তর্ষিকে বার ক’রে আনবার বিরাট ঝামেলা।
নিজেই উদিত হলে এ রকম অসুবিধা—অপরের উদয়ের ভরসা লাগে না।
সপ্তর্ষিকে পেতে হলে এইভাবে তার কাছে নিজেই উদিত হতে চিরকাল হয়।

২.
অনেক গভীর রাতে আমি রোজ বাজপাখি হয়ে যাই—বাজপাখি হই,
পাহাড়ের বাজপাখি... এবং আকাশে উঠে এসকল... উড়ে দেখি।

এর বিপরীতভাবে, পাখি যদি মরে যায় তবু সেই মৃতদেহ পাখি,
গাছ যদি মরে যায় তবে যা থাকে তা—তাও গাছ, মৃত বলে অন্য কিছু নয়।
সেইভাবে আমাদের মন ম’রে গেলে যা থাকে তা—তাও মন
মৃত্যুর নিয়মে।
[বিশাল দুপুরবেলা]

কবিতাগুলো মহাজাগতিকতাকে স্পর্শ করে বৈশ্বিকতার দিকে যাত্রা করেছে। এই কবিতাগুলোয় জীবনের বহুমাত্রিক বিস্তারকেও যেন স্পর্শযোগ্য করে তুলেছেন বিনয় মজুমদার।

তাঁর কাব্যকৃতির সর্বোচ্চ নিদর্শন ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বই দুটি। অবশ্য তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামক কবিতার বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই বিতর্কিত হয়ে আসছে। এতে তিনি মানব-মানবীর যৌনতার যে আড়ালবিহীন প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটিই এর বিতর্কিত হবার কারণ। কবিতা হিসেবেও সেগুলি বিশেষ উৎরে যায়নি। তাঁর ঠাকুরনগর বাসপর্বে লিখিত কবিতাগুলি ক্রমেই জটিলতামুক্ত হয়ে এসেছে, যেন এক অন্য সহজতার দিকে যাত্রা করেছিলেন তিনি।

বারবার পাগল হয়ে যাওয়া বিনয় মজুমদারের জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ২০০২ সালে আবার সেই রোগ ফিরে এলে তিনি বাঙ্গুর সাইকিয়াস্ট্রি ইনস্টিটিউটে দুইমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কবিতা লেখার তিন বছরের বিরতির পর কিছুটা সুস্থ হলে সেই হাসপাতালেই নতুন করে লিখতে শুরু করেন কবিতা। কবিতাগুলো অনবদ্য। এর সাথে লেখেন একটি ছোটগল্পও। এ বিষয়ে মনে পড়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গখের কথা, তিনিও মানসিক হাসপাতালে থাকার সময় বিস্ময়কর সব ছবি এঁকেছিলেন। ২০০৩ সালে বিনয় মজুমদারের এই পর্বে লেখা কবিতা নিয়ে বের হয় ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ শিরোনামে বই। এই বই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায় ২০০৫ সালে। বইয়ের ‘আমরা দুজনে মিলে’ কবিতাটা পুরোটাই পড়া যাক, কবিতাটিতে তিনি গায়ত্রী চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন—

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খ্রিস্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

অভিমান এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে কবিতাটি অনন্য হয়ে উঠেছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামের সাথে তখন স্পিভাক যুক্ত হয়েছে এবং তিনি বিশ্ববিখ্যাত একজন তাত্ত্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

কবিতার পাশাপাশি বিনয় মজুমদার কিছু গল্প, ছড়া, গান এবং প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ডায়রিও লিখতেন তিনি। যৌবনে তিনি রুশ ভাষা শিখেছিলেন, অনেক রুশ কবির কবিতা অনুবাদের সাথে সাথে আলেক্সান্দ্র পুশকিনের কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন তিনি। সেগুলিও অনন্য। তাঁর মৌলিক গল্পগুলি আকারে খুবই ছোট, অনেকগুলিই এক থেকে দেড় পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ হয়েছে। এর মাঝে একটি গল্পের শিরোনাম ‘বিশ্ববীক্ষা’, কল্পিত এক আমি’র সাথে কল্পমামার কথোপকথন দিয়ে এর শুরু এবং শেষ। এর একটি অংশ পড়া যেতে পারে—

আমি: ঐ যে চা বানাচ্ছে সুবোধ। সুবোধ পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। সুবোধ পৃথিবীর অংশ বিশ্বের অংশ।
আমি: তা হলে কল্পমামা, আপনিও পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। আমি পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।

গল্পগুলোতে সাধারণ কথোপকথনের মাঝে চমকপ্রদ সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তিনি। চারপাশের সব চেনা-জানা মানুষেরাই তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

বিনয় মজুমদারের কবিতার আবেদন ফুরোবার নয়। তিনি কালে-কালে নতুন-নতুনভাবে মূল্যয়িত হতে থাকবেন। পাঠকেরা প্রতিবারই নতুন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হবেন তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, অনুবাদে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;