কন্টাক্ট সাউথ এশিয়া



মারিয়া রিমা

  • Font increase
  • Font Decrease

‘কন্টাক্ট সাউথ এশিয়া প্রোগ্রাম’-এর মাঝামাঝি সময়ে একদিন একটা ফার্ম হাউসে বেড়াতে নিয়ে গেল। সেদিন আমরা একসাথে হয়েছিলাম ১২টি দেশের লোক। ওটা ছিল ইসাবেলার ফার্ম হাউস। সে ইউকে’র। তিব্বতিয়ান ও হিমালয়ের পিপলদের ওয়ার্ল্ড লার্নিং প্রোজেক্টের একাডেমিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছে। আমি নেপালি লোকাল মদ ‘চো’ খাইছিলাম। সন্ধ্যায় শুরু হলো লাইভ গান আর আমরা সবাই নাচতেছিলাম যার যার মতন।

একসময় আফগানের সাঈদ এসে বলল, আমি তোমার সাথে নাচতে পারি? বললাম, শিওর!

তার আগে আমরা একসাথে ক্লাস করেছি কিন্তু পরিচিত হইনি, কথা হয়নি। শেষের ক্লাসে সাঈদ আমার গ্রুপে ছিল তখন জিজ্ঞেস করছিল, বাংলাদেশ কি ইসলামিক রাষ্ট্র?

বললাম, না, তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু আমরা লিবারেল কান্ট্রি।

সে বলল, আমাদের দেশেও ওয়েস্ট প্রভিন্সের লোকজন লিবারাল, ইস্টের দিকে তারা কট্টরপন্থী। বলল, সে লিবারাল মানুষদের ভালোবাসে, বাংলাদেশ পছন্দ করে।  ইউএসএ-তে সে যখন পড়ত তখন বাংলাদেশের কেউ একজন তার বন্ধু ছিল।

আফগানের একজনের নাম ছিল হযরত। প্রথম এই নাম নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেলাম আমরা মুসলিম দুয়েকজন। নাঈম আমাদেরকে ব্যাপারটা খোলাসা করে দিলো যে,  হযরত মানে হচ্ছে স্যার। এবং ইসলামে নবীদের নামের প্রথমে হযরত শব্দটা যুক্ত করা হয় সম্মান দেখানোর নিমিত্তে। কিন্তু আফগানের হযরতকে আমি সম্মান দেখাতে পারিনি। আমাদের ভিজিটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা পুরনো টেম্পেলে। নেপালে টেম্পল ঘিরে তাদের মার্কেট প্লেইস। সবাই শপিংয়ে ব্যস্ত। আমি একা একা ঘোরাঘুরি করতেছিলাম। হযরত এসে আমাকে সঙ্গ দিতে চাইলে আমি খুশি হই। আমার মা বাবার জন্য উলের তৈরি মোজা কিনতে গেলাম তখন আমার হাতে রুপির শর্টেইজ।  হযরত নিজের পকেট থেকে বের করে দিলো রুপি এবং বলল, ‘তুমি আর কী কী নিতে চাও বলো, আমার অনেক টাকা। আমি বিদেশি এনজিওতে চাকরি করি।’ কিছুক্ষণ পর বলল, আমার রুম নাম্বার ৫১২, লাঞ্চব্রেকে তুমি আমার রুমে আসো। আমাকে এমন মিন করার জন্য আমি মনে মনে ক্ষেপতেছিলাম কিন্তু তাকে কোনো রেসপন্স না করে নিয়ে গেলাম ডলার এক্সচেঞ্জের দোকানে। ডলার এক্সচেঞ্জ করে তার রুপি তাকে ফিরিয়ে দিলাম। সে শুধু বলতেছিল তাদের কালচারে নেই এভাবে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া।

এ ট্রেনিং ছিল ইউএসএ’র একটি গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউটের প্রোজেক্ট। প্রোগ্রামটি অনুষ্ঠিত হয় নেপালে। এই কথাটা আমি আমাদের দেশের ব্যাংকারকে বুঝাইতে পারলাম না। তারা আমাকে মাত্র ১০০ ডলার ইউএসএ পাঠাইতে দেয় না।  বলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কড়াকড়ি আছে। ডাচবাংলা ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড ব্রাঞ্চে ফরেন এক্সেঞ্জ নেই তারা আমাকে ফরওয়ার্ডিং লেটার দিয়ে ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে পাঠাল। ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে দায়িত্বরত মিনা বেগমের আচরণে আমি খুবই মন খারাপ করে রাগ করে ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেলাম।

আমাদের ট্রেনিংয়ে পাকিস্তানি ছিলেন কজন। আমি তাদের সাথে কথা বলিনি একদিনও। কেমন যেন মানসিক দৈনতায় ভুগছিলাম। ক্লোজিং সেলিব্রেশান পার্টিতে আমরা সবাই ডান্স করছি। সেখানে পাকিস্তানি মীর জাফর আমাকে পার্টনার বানাল কয়েকবার।

পার্টি শেষে পাকিস্তানি নাঈম বলছিল, আপনার সাথে এতটা দিন গেল, একদিনও কথা হয়নি। আজকের পর আর দেখা হবে কিনা জানি না। আপনার সুন্দর জীবন কামনা করি।

কিন্তু পরের দিন ফ্লাইট না পাওয়ার কারণে আমরা শুধু পাকিস্তানি, (একজন কাশ্মীরি যিনি নিজেকে ভারতীয় নাগরিক বলে মেনে নিচ্ছিলেন না এবং মনে করতেন পাকিস্তান তাদের দেশ) আর আমাকে থেকে যেতে হলো। আমরা থামেলে গেলাম শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। একটা ক্যাবে গাদাগাদি করে চারজন পাকিস্তানিসহ আমি।

‘মে’ ছিল মিয়ানমারের বুদ্ধিস্ট মেয়েটার নাম। তার নাম উচ্চারণে বাংলা ‘মেয়ে’র মতো শোনায়। তাকে এই কথা বলাতে সে বলল, তার বংশে সে একমাত্র মেয়ে তাই হয়তো তার মা আদর করে এ নাম রেখেছে। মিয়ানমার থেকে তিনজন মেয়ে আমাদের সাথে ট্রেনিংয়ে ছিল। বাকি দুজনের একজন মুসলিম, একজন ক্রিশ্চান।

ক্লাসের দ্বিতীয় দিন মে সবাইকে তাদের দেশের আঁচার, চকলেট গিফট করল। এবং পরের সময়গুলোতে সে বেশ কজনের বন্ধু হয়ে গেল তার রুমে মদের আসর জমিয়ে। তিব্বতিয়ান মেয়েরা আর মিয়ানমারের মে মদে বুঁদ হতে পছন্দ করত। আফগান ছেলেরাও। আফগান ছেলেরা বারবার এলার্ট করছিল যে, তারা মেয়েদের সাথে নাচছে এ ছবি ফেসবুকে যেন না দেওয়া হয়। বলল, তাদের দেশে বিয়ে করা অনেক কঠিন। সহজে মেয়ের পরিবার যে কোনো ছেলের কাছে বিয়ে দেয় না। সাঈদ বলছিল, বিয়ে করার জন্য সে ৩৪ বার মেয়ের বাবার কাছে প্রপোজাল পাঠায়। তারপর তার বিয়ে হয়।

জাম্মুই ছিল মিয়ানমারের, ক্রিশ্চান। ক্লোজিং পার্টি শেষে আমরা দুজন যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম সে বলল, তুমি তো ভালো নাচতে পারো! তার প্রশংসায় আমার খুশি লাগতেছিল। কারণ এর আগে আমি এভাবে ডান্স করিইনি।

ড. হামিদা, হেড অফ ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট, কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি। আমাদের দুজনের ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টা আগ পিছ হওয়ার ফলে আমরা গাড়িতে একসাথে এয়ারপোর্ট থেকে ইন করেছিলাম। সেই থেকে উনার সাথে আমার ভাব হয়ে গেছিল। উনি কোনোভাবেই নিজেকে ইন্ডিয়ান বলতে রাজি না। ক্লাসে প্রসঙ্গ এলেই তিনি ইন্ডিয়ার গোষ্ঠী উদ্ধার করতেন। আর পাকিস্তানিদেরকে তার মনে হতো বেহেস্তের বাসিন্দা। তাদের সাথে সুন্দর মজার কথা বলতেন।

জার্মানির উয়ান আমাদের ক্লাস নিয়েছেন শেষের সপ্তাহ। আমাদের বলা হয়েছিল, জার্মানি টাইম ৯টা মানে ৮.৪৫। এবং ক্লাসে সে প্রতিটা পার্টিসিপেন্টকে মনোযোগী করতেও বাধ্য করেছিলেন।

মেয়েরা বলাবলি করছিল, উয়ানকে তাদের পছন্দ নয়। কিন্তু আমার তাকে অনেক ভালো লেগেছিল। আমার বাবাও এমন টাইম মেইন্টেইন করে চলে। ৯টা মানে ৮.৪৫-এ পৌঁছে যাওয়া। উয়ানের বলা আর তার কাজ করা যেন তীরের মতন। প্রতিটি কাজে তাকে আমার অনেস্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছিল। ক্লাসের একটা রোল প্লে করতে উয়ান আমাকে আর বেলুচি মেয়ে রায়লাকে চুজ করে।

রায়লাকে দেখে প্রথম প্রথম তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। তার আকর্ষণীয় পুরু ঠোঁট যেমনটি নায়িকা নার্গিস ফাখরির। মনে মনে এ সিদ্ধান্তে আসলাম যে, বেলুচি মেয়েদের ঠোঁট বোধহয় এমন সেক্সিই হয়। তবে শরীর বাঙালি মেয়েদের মতো ভারী। সাধারণত পাকিস্তানি মেয়েরা স্লিম হয় তাই জানতাম।/uploads/files/PUsUX0Q9W9HUf8CmrTroJsIFUmznRDFw3DV8QTvG.jpegরায়লার সাথে মিয়ানমারের সাই ছেলেটার ভাব ছিল। দুজনের শরীরের গঠনগত মিলও ছিল। চ্যাপ্টা এবং মাঝারি সাইজ। সাই যেদিন চলে যাচ্ছিল সে আমাকে হাগ করছিল আমি একটু ফেয়ারভাবে করতে গেছিলাম সেখানে সে আরো জোরে চেপে ধরল। বন্ধুত্বের প্রেমের শেষ প্রকাশটা বুঝিয়ে গেল।

বিদায়ের সময় আমরা সবাই সবাইকে হাগ করছি। কিন্তু সেটা আফগান, নেপাল, পাকিস্তানের ছেলেদের সাথে হয়নি। আমাদের নর্মস্ কোথায় যেন বাধা দিয়েছিল!

রুমে আমি ও দুজন তিব্বতিয়ান ছিলাম। একজন ইউএস’র সিটিজেন ছিল। তিব্বতিয়ানরা নিপীড়িত, এসাইলাম হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকাতে তাদের সিটিজেনশিপ সহজ। তাছাড়া সারা নেপালজুড়ে তিব্বতিদের বসতি। রিফিউজি হিসেবে থাকছে। কিছু ইন্ডিয়াতেও আছে। দালাই লামার অনুসারীরা কখনো কাউকে আঘাত করে না। উল্টো অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শেষ করে ফেলে। ক্লাসের সেশনে তারা বারবার এ কথাগুলোই বলে যাচ্ছিল। যেন, এখানে কেউ তাদের জাতিকে উদ্ধার করতে এসেছে! কেউ বুঝি মুক্তি দিতে এসেছে!

আমার রুমমেট ডোঙ্গা বলছিল, তাদের মা বাবা কিভাবে বরফের ওপর দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রতিনিয়ত কত লোক সেখানে সুইসাইড করে নিজেকে মুক্তি দিচ্ছে। আজ চায়না পরাশক্তি। ওয়ার্ল্ড তাদের সাথে খাতির রেখে চলে। তিব্বতিয়ানদের পাশে দাঁড়ায় না কেউ। নিজেদের ভাষাকেই রক্ষা করতে পারছে না তারা, পুরোই জিম্মি হয়ে আছে।

একজন আফগানি বিরক্ত হয়ে বলছিল, তোমরা যদি প্রতিবাদ না করো, দালাই লামা যদি বলে প্রতিবাদ করা যাবে না, কাউকে আঘাত করা যাবে না, শান্তির মাধ্যমে কিভাবে স্বাধীনতা চাও!

প্রয়োজন ছাড়া সেশনগুলোতে কম কম কথা বলছিলাম। এমনিতেই আমি কম কথা বলি। উয়ান সবাইকে নিজের সম্পর্কে এবং নিজের দেশ সম্পর্কে যখন বলতে বলছিল আমি বললাম, আমার মাতৃভাষা বাংলা, পৃথিবীতে এই একমাত্র দেশ যারা নিজের ভাষার জন্য লড়াই করেছিল। আই ফিল প্রাউড টু বি বাঙালি। এছাড়া আমি আসলে ব্যস্ত ছিলাম অন্যদের ধারণাগুলো বুঝে নেওয়াতে। সেশনে যে যার দেশের কনফ্লিক্ট নিয়ে আলোচনা করে যাচ্ছিল।

আমাদের ফ্যাকাল্টি উয়ান ইউএন মিশনে মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি আমাদের টাস্ক দিলেন নিজের দেখা বা শোনা বা মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করেছে এমন কিছু আমাদের শেয়ার করতে হবে। ফিলিপিনো দুজন মেয়ে ছিল। তারা গভমেন্টের সাথে খনির শ্রমিকদের কনফ্লিক্ট এবং তার নেগোসিয়েশন নিয়ে আলোচনা করেছিল।  

ওদের দুজনের বয়স বোঝা মুশকিল ছিল। আমার যদ্দূর মনে হলো কুইনি গভমেন্টের কোনো ডিপার্টমেন্টের অফিসার। তাদের উচ্চতা ৫ ফিটের চেয়ে কম, স্লিম। ঠান্ডা মাথায়  বুঝেশুনে সফটলি কথা বলে। আমার আর ড. হামিদার অবজারভেশন, এরা সবার চেয়ে ম্যাচিউরড্ ফিমেইল ছিল। তবে, শী মেয়েটা আমাকে অকারণে ছোট করার চেষ্টা করত। এশিয়ান মেয়েদের কমন প্রবলেম হতে পারে। পরে দেশে ফিরে তার কোনো রিয়েলাইজেশান হয়েছে হয়তো। আমার সাথে কন্টাক্ট করে কয়েকবার  খবরাখবর নিয়েছিল। ফিলিপিনস কৃষির অর্থনীতি দিয়ে এত এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে কৃষিবিদরা অনেকেই দেখা যায় ফিলিপিনসে পিএইচডি করতে যায়। দেশের ধান গবেষণার অনেককেই ফিলিপিনসে পাওয়া যাবে যে কোনো সময়।

প্রথম তিনদিন বাংলাদেশি হিসেবে আমি একা ছিলাম। পরে অরূপ এসে জয়েন করে। প্রেজেন্টেশানে আমাদের হিলট্রেক্স কনফ্লিক্ট নিয়ে সাজাতে হলো যেহেতু উপস্থাপনের মতো আমাদের আর কোনো কনফ্লিক্ট ছিল না এবং তা আসলেই নেই। আমি বিজনেস ব্যাগগ্রাউন্ডের লোক। অরূপের ওপর ভরসা করে ছেড়ে দিলাম। তার ডেভেলপম্যান্ট স্টাডিজ। তবে কথা হলো, হিলট্রেক্স নিয়ে আমাদের পিস একরড্ হয়ে যায় ১৯৯৭-এ। ক্লাসের অনেকে বিশেষ করে পাকিস্তানিরা খুব করে জানতে চায় বাংলাদেশে কি আর কোনো কনফ্লিক্ট নেই! নাঈম প্রশ্ন করছিল, সমাজে কোনো ক্রাইম হলে তার সমাধান কিভাবে করো? আমরা বলছিলাম, আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে তার সমাধান হয়। আফগানিরা জার্গা সিস্টেমে তাদের বিচার কাজ করে এবং পাকিস্তানেও এটা চালু  আছে। আমাদের গণতন্ত্রের ব্যাপারটাতে তারা একটু অবাক হলো। জার্গা আমাদের দেশে গ্রামে চালু থাকা পাঞ্চায়েত সভার মতো একটা ব্যাপার হলেও এটা খুব ভয়ানক ব্যাপার। দুই এলাকার দুই প্রধানরা প্রচুর খুনাখুনির কাজ করে সমাধানে না পৌঁছাতে পারলে। পাঞ্চায়েত সিস্টেমের ব্যাপারে আমি জেনেছিলাম কারণ আমার দাদা পাঞ্চায়েত সভাপতি ছিলেন। সে সময় গ্রামের লোকেরা অতো চৌকস ছিল না। নিরীহভাবে জীবন চালাত। সালিশের একটা ধমকেই কাবু হয়ে যেত।

আফগানিরা বলছিল, তাদের দেশে তালিবানদের উৎপাত এবং সবসময় যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে পাকিস্তানিরা এবং যেজন্যে ভৌগোলিক জায়গা থেকে আফগান অর্থনীতিতে অনেক সম্ভাবনাময় অবস্থানে থেকেও নিজেদের উন্নতি করতে পারছে না। পাকিস্তানিদের তারা খুব অপছন্দ করছিল।

আমাদের আরেকজন ফ্যাকাল্টি ছিলেন আজরা। প্রথম কদিন আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার পোশাক এতটাই সেক্স এপিল দেখাচ্ছিল। আজরা টার্কি ইউনিভার্সিটির টিচার।

আজরার পোশাক ছিল একটা ফ্রক, হাঁটুর উপরে। বেশ বড় গলার কাট। অবশ্য পায়ে স্কিনি কালো সক্স। ওটা পা বলে ঠাউর হবে কিন্তু কালো আবরণে ঢাকা।

আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই টার্কিশ এসে বাংলার মানুষকে মুসলমান বানিয়ে গেছে। কিন্তু তারা নিজেরা যথেষ্ট ওপেন চলছে। আজরা বলছিল, তাদের দেশ হান্ড্রেড পার্সেন্ট মুসলিম হলেও সেখানে মুসলিমদের মধ্যেও ভায়োলেশান আছে। যেমন, পশু জবাই নিয়ে মুসলিম-এন্ট্রি চিন্তার দল আছে যারা জীবহত্যাকে পাপ মনে করে।

পোশাক পরিধানে আমার ফিলিপিনো মেয়েদের আধুনিক মনে হয়েছে। তাদের  ট্রেডিশনাল পোশাকটিও অনেক সুন্দর। বিউটি বোনের নিচে থেকে হাঁটুর উপর তাদের পোশাক যেখানে স্লিভ নেই। শুধু শরীরটা মোড়ানো। পোশাকের দিক থেকে ইন্ডিয়া, নেপাল আর ফিলিপিনিরা পশ্চিমা পোশাকে অনুরক্ত আর নেপাল টুরিস্ট কান্ট্রি বলেই হয়তো পশ্চিমাদের ধাঁচ তাদের সাথে মিশে গেছে। সেখানে অল্প আধটু সবাই ইংলিশ বলতে জানে। রাস্তায় নেপালি নারীরা শাড়ি পরে স্কুটি চালাচ্ছে এমন দেখা যায়। অকেশানে নেপালি মেয়েরা শাড়ি পরে দেখলাম ইন্ডিয়ান নায়িকাদের স্টাইলে, খোলা পিঠ এবং পেট দেখিয়ে। প্রথমদিন যখন নেপালে ঢুকছিলাম রাস্তায় প্রচুর মেয়ে তারা সবাই মাঝারি সাইজের প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা, হয়তো গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়েছে কেউ কেউ। সবাইকে একরকম লাগছিল। শীতের সময় আমাদের গুলশানের কর্পোরেট মেয়েদের দেখতেই আমার বেশি স্মার্ট লাগে। থ্রি-পিসের সাথে সোয়েটার।

নেপালে আমি শুধু একটা ছুপ্পা কিনতে চেয়েছিলাম। ওটা তিব্বতিদের পোশাক। পরলে  প্রিন্সেস প্রিন্সেস মনে হতো।

নেপালি মেয়েরা যতটা সুন্দরী ছেলেরা ততটাই আনকালচারড্। সেখানে যাবার আগে আমাকে তাই বলছিল আমার এক কাজিন। রাজিব নামের এক নেপালি ছিল, দেখতে আমাদের দেশের ছেলেদের মতোই। আমাকে বলছিল সে ইউনিভার্সিটির টিচার। কিন্তু তার সাথে কথা বলে আমার ডাউট হলো। পরে জানতে পারলাম আসলে নেপালের সব কলেজগুলো ইউনিভার্সিটির আন্ডারে। আর সেখানে নৈশ ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। সেখানে সে টিচার। তার নাম উচ্চারণে আমাদের সতর্ক করে দিলো যেন ‘জ’ এর  ওপর বেশি মাত্রা আরোপ করে না ডাকি তাইলে সেটা আরব কান্ট্রির মুসলমানের নাম হয়ে যাবে। আমাদের সবার ধারণা নেপাল একটি বুদ্ধিস্ট কান্ট্রি। কিন্তু রাজিব আমাকে জানাল, নেপাল হিন্দুপ্রধান দেশ তবে ওদের দেশে খাঁটি হিন্দু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নেপালিরা হিন্দুইজম এবং বুদ্ধইজম দুটো মিলে একটা ধর্ম পালন করে থাকে।/uploads/files/9yMS0ydJPiPkQYDeGtAlTcZel31sYgSa8YcA3Ylz.jpegপ্রথমদিন লাঞ্চব্রেকে আমি রাজিবকে নিয়ে খাবার খেতে বের হই। ওই সময়টাতে তেমন খাবার পাওয়া যায় না রাজিব তাই বলল। কারণ, সকাল এগারোটার মধ্যে তারা ভারী খাবার খেয়ে থাকে। দুপুরবেলা হাল্কা খাবার খায়। আবার সন্ধ্যে ৮-৯টার মধ্যেই তাদের ডিনার শেষ করে থাকে। আমরা শহরের শেষ প্রান্তে ছিলাম বলে তেমন রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ লাঞ্চ হিসেবে বাঁশের নতুন শাখা দিয়ে তৈরি স্যুপ আর ডিমের ভাপে দেওয়া একটা পিঠা খেলাম যেটা নেপালি ট্রেডিশনাল খাবার ছিল। নেপালের মম আমি এত খেয়েছি যে আর কখনো মম খেতে ইচ্ছে জাগবে না। দেখলাম ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাইন ধরে লোকজন মম খায় ভেড়ার মাংস দিয়ে বানানোটা। পরবর্তী সময়গুলোতে আমি খেতাম রুটি আর রাজমা যেটা কিডনি বিনের কারি অথবা আলু মটর যেটাকে আমরা ইন্ডিয়ান খাবার ছোলাবাটুরা নামে জানি। কিডনি বিনের চাষ হচ্ছে এখন আমাদের গ্রামেও। আমাদের গ্রাম হিন্দুপ্রধান বলেই এটা জনপ্রিয় হচ্ছে বলে আমার মায়ের ধারণা। তবে ব্যাংকক শহরের মতো জোড়া সেদ্ধ ডিম, কলার ডজন বা হাফ ডজন ছাড়া বিক্রি করে না তারা। আমাদের দেশের মতো হালির চল নেই সেখানে।

২০১৫’র অক্টোবরে নেপালে নতুন সরকার আসে। ফিমেইল প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেন। আমাদের প্রোগ্রামের শিডিউল ছিল ডিসেম্বর মাসে যখন তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রিতে। নেপালিরা বলছিল, তাদের দেশে ঠান্ডা পড়লেও কুয়াশা পড়ে না। তারা কুয়াশাকে ঘৃণা করে আর এবং আমাদের দেশে কুয়াশা পড়ে। ঠান্ডার কারণে নেপালে  কুকুরের বংশবিস্তার প্রচুর। কুকুরকে অনেক সেবাও করে তারা। নেপালি ভাষার সাথে আমাদের ভাষার মিল পাওয়া যায়, যেমন হিন্দি ভাষার কিছু মিল। ওদের পত্রিকায় কিছু শব্দ দেখে কী লিখেছে শব্দগুলো বুঝতে পারতাম। তারা ধন্যবাদ শব্দটি উচ্চারণ করে খুব।

সে সময়ে নেপালে ডিজেস্টার  চলছিল। নেপালের কিছু এথনিক গ্রুপ নতুন সরকারের কন্সটিটিউশানের ব্যাপারে প্রটেস্ট করছিল আর সেই এথনিকদের ব্যাপারে কনসার্ন হওয়ার জন্য নেপালের সরকারকে বলে ইন্ডিয়া। বর্ডার দিয়ে ফুয়েল আসা প্রায় বন্ধ করে রেখেছিল ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া থেকে আসা  ফুয়েল দিয়ে চলতে হয় নেপালকে। নেপালে যানবাহনের ‘কস্ট’ বেড়ে গেল। বিদ্যুৎ থাকত না ঠিকমতো। রাস্তাঘাট অন্ধকার হয়ে থাকত। এরকম ট্রেনিং শেষে আমি একা সন্ধ্যায় রেস্টহাউসে ফিরছিলাম। অন্ধকারে অস্থির হয়ে পড়ি কিন্তু পরে এটুকু নিশ্চিত ছিলাম নেপালে এভাবে কোনো মেয়ে ফরেনার একা চললে লোকে হেল্প করবে কখনো ইনসিকিউরড হবে না। মোড়ে কিছু ইয়াং ছেলেপেলে টিজ করেনি যে তাও না। আমার লম্বা চুল ছিল আর চুল ছেড়ে চলাতে আমি অভ্যস্ত। ওরা হিন্দিতে বাল বাল বলে কিছু বলতেছিল আর হাসাহাসিও করছিল।

একটি দেশের অর্থনীতি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল ভাবতে অবাক লাগত! আর তাদের সহযোগিতা করছে বিদেশি এনজিওরা। আমি দেখলাম, তারা পশ্চিমাদের বেশ ভক্তি করছে, লবিংয়ের চেষ্টা করছে। এছাড়া তাদের উপায়ও নেই। আমাদের দেশ এখন বলতে গেলে বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজকাল কোনো এনজিও’র দরকার পড়ে না। পাকিস্তানে প্রচুর এনজিও কাজ করে। আফগানেও।

আমরা বারবার এই কথাই বলে যাচ্ছিলাম, আমাদের কোনো কনফ্লিক্ট নেই। আমরা আমাদের দেশে শান্তিতে বসবাস করছি। এক তিব্বতিয়ান জেলাস হয়ে বলছিল, তোমাদের দেশে তো ব্লগারদের মেরে ফেলে এথিজম নিয়ে কথা বললে। আফগানরা বলছিল, ইস! তোমাদের দেশে গিয়ে যদি থাকতে পারতাম। পাকিস্তানিরাও শ্লেষ গেয়ে যাচ্ছিল এ নিয়ে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;