খরগোশ ও মহামায়া



ফারাহ্ সাঈদ
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

মার্বেলের মতো চোখ। ঠিক জ্বলজ্বলে নয় তবে গাঢ়। খরগোশটা শাদা। পাখির পালকের মতন। আমাদের ফ্ল্যাটে ঘুরঘুর করছে সকাল থেকেই। চেনা চেনা লাগে। হয়তো লিফটে দেখেছি কারো সঙ্গে? আমি ধরতে গেলে আম্মা থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওরে ধরিস না খিদা লাগছে, কিছু খাইতে দে।’

মেঝেতে রাখা এই ঝুড়িটা আমারই কেনা। কিছু গাজর রাখা, আর হলুদমতো একটা সবজি। খরগোশটা ঝুড়ির কাছে গিয়ে থামে। কিছু একটা মুখে তুলে নিল। খাচ্ছে সে।

‘এটা কি সবজি রাখার ঝুড়ি আম্মা? আমি তো আনছি সাজায়া রাখার জন্য। আপনে কী করছেন!’ আমি হেসে বলি।
‘তো কী হইছে, ছেলে আমার, কত্তকিছুর শখ তোর, আমি না হয় খরগোশটারে আদর কইরা খাওয়াইলাম। কিছু খুঁইজা পাইলাম না আর, এই ঝুড়িটা কি আর অন্য কাজে লাগে?’
‘আমারেও কিছু খাইতে দেন, তারপর ছাদে যায়া বসি। ঘরে আর ভালো লাগে না মা।’

একটু পর আম্মা একবাটি মুড়ি দেয় আমার হাতে, কড়কড়ে ভাজা। পেঁয়াজ বেরেস্তা দেওয়া। আমি খাচ্ছিলাম জানালার পাশে বসে। খরগোশটা আসে যায় চেয়ারের পাশে। মিনিটখানেক দাঁড়ায় তারপর আবার চলে যায়। মুড়ি খেতে দিলাম কিছু ওকে। নাহ খেলো না খরগোশটা! আম্মা আমার ঘরে এসে বলে, ‘তুই কী দিলি খাইতে? ওইসব খায় না খরগোশ।’ হাসতে থাকে আম্মা।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে যাই। মিঠু ঘরে থাকলেও আম্মাই আমাকে এগিয়ে দেয়। ক্রাচে ভর করে হাঁটি বলে উনি ভাবেন আমি পড়ে যাব। তাই একা হাঁটতে দেন না।

ছাদে কেউ আছে বোধহয়। গুনগুন শব্দ পাই। কেউ গান গাইছে। আমি চেয়ারটাতে বসি। হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা।

এক নিঃশ্বাসে কী কী সব বলল মেয়েটা। আমি শুনে যাচ্ছি তবে খুব হাসি পাচ্ছে আমার। সত্যি সত্যি! আমার হাসি থামিয়ে দিয়ে মেয়েটা বলে, ‘এইভাবে সবগুলা দাঁত দেখিয়ে হাসছেন যে? এটা হাসির কিছু না! আপনার কোনো চিন্তা লাগতেছে না? আপনার ওয়াইফ এভাবে আমার বরের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে আর আমি মেনে নেব?’ কথাগুলো বলে নিজেই হাসে মেয়েটা! তবে এটা বাঁকা হাসি। বিদ্রূপ আছে বৈকি। নামটাও জানি না তার। কী আর বলব।

প্রতিবেশিনীর চোখের দিকেই তাকাই আমি। ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে এসে এ কী বলছে সে! ওর বরের সঙ্গে মিঠুর নাকি কী সব হচ্ছে আজকাল। আমার কি চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কথা ছিল? এখনই ব্লাডপ্রেসার হাই হবার কথা? কই তেমন কিছুই হচ্ছে না। জানতে চাইলাম, ‘আপনি আমাদের উল্টাদিকের ফ্ল্যাটের না? আপনার নামটা?’
‘আমার নাম কণা।’
শুনেও মনে হয় শুনিনি। আরেকবার জানতে চাইব। আরেকবার।

ছাদে কাপড় মেলে দিচ্ছে সে। আমি তাকে দেখি আর ভাবি লিফটে কতবার ভেবেছি অন্তত নামটা জিজ্ঞেস করব। করিনি।

টপ টপ করে পানি পড়ে ধোয়া কাপড় থেকে। ছাদ একটু একটু ভিজে যাচ্ছে, ওর পায়ের কাছেও ছিটকে পড়ছে পানি। কাপড়গুলো ঠিকমত নিঙরানো হয়নি।
‘আপনাদের কাজের মানুষ নাই, আপনি কেন ছাদে?’
‘আপনাকে দেখতে আসছি!’ আবারও সেই বিদ্রূপ হাসি।
আমি কিছু বলি না। তার পায়ের কাছে পানির ঝরে যাওয়া দেখি। একপায়ে নূপুর। কেমন কালচেমতো। রুপালি রঙ ছিল বোধহয়, অনেকদিনে হয়তো কালচে হয়ে গেছে।
‘কী ভাবছেন? ব্যাপারটা ভেবে দেখেন, আর একটু খোঁজ টোজ নিয়েন, কী করে, কোথায় যায় ওরা? আশরাফকে আজকাল কেমন কেমন যেন মনে হয় আমার!’
‘আপনি তো খোঁজ নিচ্ছেন নিয়মিত, আমি আর কী করব?’
‘এটা তো আমার হাজব্যান্ড নিয়ে কথা না শুধু, আপনার ওয়াইফও জড়িত! দুজন কী করছে, আপনি খোঁজ নিবেন না? বউয়ের জন্য ভালোবাসা নাই?’
‘না নাই! তো?’ আমার হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে!

কী বলে এই মেয়েটা! আমার বিশ্বাস হয় না, মিঠু আর ওর বরকে নিয়ে কী সব রটনা! সত্যি, আমার বিশ্বাস হয় না। বিয়ের পর থেকে মিঠুকে যতটা চিনি এমন একটা কিছু ওর দ্বারা অসম্ভব! অন্যরকম মেয়ে সে। কণা মেয়েটা সন্দেহপ্রবণ খুব। তবে বোকা। তাও ওকে আমার ভালো লেগে। এক ধরনের ইন্নোসেন্স আছে! আমি তাও হাসি। কণাও হাসে তবে বিদ্রূপ হাসি।

বালতি নিয়ে চলে যাচ্ছে সে। তারে দেওয়া কাপড়গুলো বাতাসে নড়ে উঠলেও, ভারী চাদরটা নড়ছে না। হালকা প্রিন্টের আকাশী চাদর। ছাদের দরজা খুলে একবার পেছন ফিরে তাকায় কণা।
‘আবার দেখা হবে, আমি আসি।’ চলে যাচ্ছে সে। ছাদের সিঁড়িঘরের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে কণা।
বলতে গিয়েও বলিনি, যেও না। আবার কী ভাবে! তুমি-টুমি করে বললে। আমি আসলে ওকে তুমি করে বলতেই পারি। বয়সে অনেক ছোট হবার কথা। দেখে তো তাই মনে হয়! নাকি শুকনো গড়নে বয়সটা ধরা যায় না। মুখটাও মিষ্টি। হাসলে গালে ছোট্ট একটা টোল পড়ে।

ঘরে ফিরে যাব তাই ছাদের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছি কেবল। কণা এসে আমার ক্র্যাচটা তুলে দিলো। আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি। লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এক্সিডেন্টে দুটো পাই ভেঙেছে যদিও, তাও বাঁ পায়ে কিছুটা জোর পাই। ডান পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে। এখনই পড়ে যাচ্ছিলাম আর ও এসে হাতটা ধরল। আরো এগিয়ে আসে কণা। মেয়েটার ভয় করে না? এভাবে অজানা কারো এত কাছাকাছি আসতে? আমি পেছনে যাই, লিফট ঘেঁষে দাঁড়াই। আরো কিছুক্ষণ থেমে ছিল লিফট, আমি দোতলার বাটনটায় ঠেঁসে ধরি, আমাকে ঘরে যেতে হবে। কণার চুলের গন্ধে মাতাল হয়ে যাচ্ছি যে আমি! আবার হাসে, টোল পড়া গাল, চুলগুলো সারা মুখ ঢেকে আছে। আমি সরিয়ে দিতে গেলে বলে, ‘থাক, পড়ে যাবেন তো!’
‘আপনি সামলে নেবেন’, আমিও হাসি, লিফটের দরজা খুলে যায়। খরগোশটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে কণার কোলে ওঠে। খালি বালতিটা ফেলে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কণা। হুম! ও তাহলে কণার পোষা খরগোশ! আহ বেশ ভালো লাগছে কণার কোলে।

ইতোমধ্যে কণা এসেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে দুবার, খরগোশটাকে নিয়ে যেতে, আম্মার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ হলো ওর। কিছু সুপারি গুঁড়ো করে দিয়ে গেল সে। আম্মা আজকাল দাঁতের জন্য পান-সুপারি খেতেই পারে না বললে চলে। কণাকে খুব পছন্দ হয়েছে আম্মার।
‘মেয়েটা খুব সরল, আর এই খরগোশটাই বুঝি ওর জীবন।’ আম্মা হাসে আর বলে।

মিঠু ঘরে ফিরতে এখনো তিনঘণ্টা বাকি। ঘড়ি দেখি। এটা ঠিক আমার অপেক্ষা নয়। কিছু জমে থাকা কথার অপেক্ষা। সারাদিন কী কী হয় আমি বলে যাই, মিঠু শোনে, কিছুই বলে না, কোনোদিন দু’একটা হ্যাঁ-হু, কিংবা অষুধ খেয়েছি কিনা তাই জানতে চাওয়া।

টিভির অ্যাডগুলো এই দুই মাসে মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। নেটেও থাকতে আর ভালো লাগে না। মানুষ কী সব বিষয় নিয়ে ক্যাচাল করে শুধু শুধু। ল্যাপটপে কিছু সিনেমা দেখি মাঝে মাঝে। বই-টই পড়ি না। তবে আমার অফিসের এক কলিগ তিন চারটা বই দিয়ে গেল সেদিন তাই উল্টে পাল্টে দেখছি আজকাল। গতকাল ডাক্তার বললেন, আরো দু’মাস হয়তো লাগবে ভালো হতে। এভাবে ঘরে বসে বসে আর ভালো লাগছে না। আমি পাগল হয়ে যাব। অফিসে বসকে বললাম বাড়িতে কিছু কাজ টাজ দেওয়া যায় কিনা। তিনি হেসে বলেন, ‘সাইফ বিশ্রাম নাও তুমি, দশ বছরে তোমাকে ছুটি নিতেও দেখিনি তেমন একটা। ফিরে এসে কাজ কোরো।’

আমি আর কী বলি। মন খারাপ করে বসে থাকি। ভাবছি নাহিদদের ওখানটায় যাবো। ওর চিটাগাংয়ের বাসায় যাওয়া হয়নি আমার।

নাহিদ আমার পিঠাপিঠি বোন। ছোট হলেও আমাকে বড়দের মতোই শাসন করে নাহিদ। এতবার যেতে বলছে বেড়াতে, হয়ে উঠেনি। ঘরে বসে আর ভালো লাগছে না। আম্মা যেতে রাজি হলেই হলো!

মিঠু অফিস থেকে ফিরেছে কেবল। চা খেতে খেতে আমি চিটাগাং যাওয়ার কথা বলি। আমাদের তিনজনের একসঙ্গে যাওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ‘না’ বলে চুপ করে থাকে মিঠু।
‘কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাও, মা একা তোমাকে সামলাতে পারবে না। আছে এমন কেউ?’
‘হুম আছে।’
‘কে সাইফ, তোমার অফিসের কোন স্টাফ? দুই তিনদিনের জন্য হলে তো যেতেই পারে।’
‘না অন্য কেউ।’
‘কে?’

আমি কণার কথা ভাবি। ও কি যাবে আমার সঙ্গে? মিঠুকে কিছুই বলি না যদিও। আবারও ভাবছি কণা যদি যেতে পারে। তাও কি হয়! ওর বর ওকে যেতে দেবে কি? কখনোই না!

খরগোশটা আবার কোথা থেকে যেন এলো। মিঠুর চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ায়। অনেকটা সময়।
‘ওকে দিয়ে আসি ওই ফ্ল্যাটে।’
‘তুমি জানো এটা কাদের খরগোশ?’
‘হ্যাঁ দেখেছি একটা মহিলার কাছে, মনে হয় উনি আমাদের উল্টো দিকেই থাকেন।’
‘তুমি চেনো ওদের মিঠু?’
‘না সেরকম না। আশারাফ সাহেবকে চিনো না? উনি তো আমাদের পাশের অফিসে কাজ করেন ‘
‘ওহ!’
আশারাফ মানে কণার বর! ওর থেকেই নামটা শোনা। আমি একবার ভাবি জিজ্ঞেস করব মিঠুকে। কিন্তু কী যে বলি!

মিঠু খরগোশটা কোলে তুলে নিয়ে যায়। আমিও যাই, তারপর কণাদের দরজার পাশে থেমে যাই। কণাকে ভাবছি এখন। ওর ফোন নম্বরটা জানা থাকলে চিটাগাং যাওয়ার কথা বলতাম। কী সব যে ভাবছি!

আজকাল ছাদে প্রায়ই দেখা হয় ওর সঙ্গে। টুকটাক গল্প করি। প্রতিবারই আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় কণা। আজ সিঁড়িঘরেই দেখা হলো কণার সঙ্গে। আমি চিটাগাং যাওয়ার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেল! ওর বর বা বাড়ির অন্যরা কে কী বলবে এ কথা বলতেই কণা বলে, ‘টিকিট কবে করবেন? আর ভাবতে হবে না ওর কথা, আমি ম্যানেজ করে নেব।’
‘বলেন কী! আমি তো এমনি এমনি বললাম আপনাকে। আমার বোনের বাড়িতে যাব, আম্মা বুড়ো মানুষ, কেউ সঙ্গে গেলে হেল্প হতো একটু। তাই ভাবলাম আপনি যদি যেতে চান!’
‘ভাবতে হবে না, আমি যাব বলেছি তো!’
‘আচ্ছা মিঠুকে কী বলব আমি, বলেন তো?’
‘সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?’ সে কি হাসি কণার!

আমি জানি না কণা কী চায়। আমি অস্থির হয়ে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না। আম্মাকে রাজি করালাম, ইনফেক্ট আমার ছোটবোন নাহিদই রাজি করাল আম্মাকে ফোনে। মিঠু তেমন কিছু বলল না। তবে কণার কথা কাউকে কিছু বলিনি।

‘নাহিদরা স্টেশন থেকেই নিয়ে যাবে আমাদের কথা চিন্তা করো না।’
‘তুমি কষ্ট করে যেতে পারলে আমার কী বলো? আমি তো যেতে পারব না তুমি জানো। অফিসে অনেক কাজ আমার।’

মিঠুর কথা শুনে এখন আর কষ্ট পাই না। নীরবতা বলি কিংবা নিষ্ঠুরতা এ আমার সয়ে গেছে! বিশেষ করে এই দু’মাসে আমার সবকিছুই কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে।

কণা সঙ্গে যেতে চায় এ কথাটা আম্মাকে বলব কিনা ভাবছি। না থাক। কী হয় দেখি। আমার তো বিশ্বাসই হয় না স্বামী সংসার রেখে ও আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে। তাছাড়া নাহিদের বাড়িতেই বা কী বলব, কণার কি পরিচয় দেবো সেখানে?

খরগোশটা আজ সকাল সকাল এসে হাজির। অনেকটা সময় ও চুপচাপ আম্মার পাশে বসে আছে, এটা আমার অদ্ভুত লাগে। আমি বসে থাকি। ছেলেটা আর কতটা সময় মায়ের পাশে থাকে, তবে এবার এই এক্সিডেন্টের পর মা আমাকে অনেকটা আগলে রেখেছেন।

মিঠু শুধু শুক্রবারে বাড়িতে থাকে, তাও কতটুকু আর দেখি আমি। সারাটা শুক্রবার ঘুমিয়ে কিংবা টিভি দেখেই কেটে যায় ওর।

ব্যাগ গুছিয়েছি। ফাইনালি কাল চিটাগাং যাচ্ছি আমি আর আম্মা। বিকালে কণার সঙ্গে ছাদে দেখা। ও আমাদের সঙ্গে যাবে তো? ভাবছি। কিন্তু আম্মাকে তখনও বলিনি কিছুই আমি কণাও বারণ করল।
‘কণা, আম্মাকে এখন না বললে, পরে যখন আসবেন, তখন?’
‘সে আমি তখন ম্যানেজ করে নেব, খালাম্মা আমাকে পছন্দ করেন, আপনি কি জানেন না?’
‘তা ঠিক আছে, কিন্তু কণা আপনি কোনো সমস্যায় পড়বেন না তো?’
‘নাহ, এটা আমার ব্যাপার।’

অজানা এক ভীতি কাজ করে আমার মাঝে সারারাত, মিঠু কিংবা কণার বরকে নিয়ে নয় বরং নিজেকে নিয়ে। আমার এইসব কী হচ্ছে আজকাল। কণাও আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। বুঝি না কিছুই, কণা তো এমনিতেই ওর বর আর মিঠুকে নিয়ে আমার কাছে নালিশ করে প্রায়। তাহলে ও কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে আমায়? জানি না, বুঝি না কিছুই।

সকালে গাড়ি আসে নয়টায়। আমি আর আম্মা লিফটে নিচে নেমে আসি। মিঠু বারান্দা থেকেই দাঁড়িয়ে দেখে। শুক্রবার আজ। অফিস নেই মিঠুর। গাড়িতে ব্যাগ তোলা হয়েছে। কিন্তু কণাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। গাড়িটা বেরিয়ে যেতে লাগল, আমি ছিলাম গেইটের দিকে তাকিয়ে। কণা যদি আসে। ড্রাইভারকে থামালাম একবার। দেরি হয়ে যাবে ভেবে আম্মা বলেন, ‘কিসের অপেক্ষা করোস?’
‘না কিছু না।’
গাড়িটা গলির মোড় ঘুরতেই কণাকে দেখতে পেলাম! সঙ্গে সুটকেস। আরে সে কি! ও এখানে। গাড়ি থামিয়ে বললাম, ‘এখানে যে?’
‘নিচে অপেক্ষাই করছিলাম আপনাদের। তারপর পানির বোতল কিনতে এই দোকানে এলাম, আপনি তো দেখি আমাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছিলেন।’
‘উঠে পড়েন গাড়িতে দেরি হয়ে যাবে।’

আমাকে আর কিছু বলতে হলো না। কণাই মাকে কী সব বোঝালো পেছনের সিটে বসে বসে। আম্মাকে শুধু বলতে শুনলাম, ‘ভালো করছো, আমি তো এত চিন্তায় ছিলাম, সাইফকে একা নিয়ে বাসে এভাবে যাব কী করে তাই ভাবতেছিলাম।

‘আমার এত খারাপ অবস্থা না তো আম্মা, একটু কষ্ট হয় কিন্তু আমি তো চলাফেরা করতে পারি!’
‘কণা আসাতে আরো ভালো হইছে না?’ আম্মার কথা শুনে মুচকি হাসে কণা, টোল পড়ে ওর গালে। রোদে মুখ ঢাকে শাড়ির আঁচলে।

বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। অফিসের ড্রাইভারকে বকশিস দিলো কণা। সিটগুলো ভালো পেয়েছি আমরা, তবে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বাস ছাড়বে। নাহিদের সঙ্গে একবার কথা হলো আম্মার, কণার কথা বলেছে কিনা আমি জানি না।

বাসে উঠতে অসুবিধা হলো। কণার কাঁধে ভর করে উঠতে গিয়ে ইতস্তত লাগে আমার। তবে চুলের মিষ্টি গন্ধটা এতটা কাছাকাছি কখনো পাইনি কণার। ধীরে ধীরে উঠি আমরা। আম্মার খুশি খুশি চেহারার কারণ আমি জানি না কিন্তু আমার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে!

আম্মা জানালার পাশে বসেন। তারপর কণা আর আমি বসেছি আইলের এপাশে। কণা আর আমার মাঝে এটুকু জায়গাও খালি থাকে না প্রায়। লোকজন চলাফেরা করছে একটু পরপর। মাঝামাঝিতে বসলে যা হয় আর কি।

পায়ের নুপুরটা খুঁজছি আমি। কী করে যে বলি কণাকে। একটু দেখতে পেলে ভালো লাগে। ডান পায়ে দেখতে পেলাম না তো।
‘পায়ের নুপুরটা পরেননি বুঝি আজকে?’
‘এই তো, কেন?’ বাঁ পা দেখিয়ে বলে কণা, ‘পছন্দ তাই, তোমাকে মানায়।’
কণা মুচকি হেসে জানালার দিকে ঘুরে তাকায়।

পথে থেমেছি আমরা। রেস্টুরেন্টে আমাদের জন্য খাবার অর্ডার দিচ্ছে কণা। আমার ফোন বেজে ওঠে। মিঠুর ফোন। আমি একটু দূরে সরে গিয়ে কথা বলি।
‘তোমরা কোথায়? কতদুর গিয়েছো?’
‘একটু দেরিতে বাস ছাড়ল, পৌঁছুতে দেরি হবে। থেমেছি একটা হোটেলে। খাচ্ছি আমরা।’
‘যা একটা ঘটনা হয়েছে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে সাইফ!’
‘কোথায়?’
‘যাদের ফ্ল্যাটে খরগোশ আছে।’
‘কী বলো!’
মিঠু এক নিঃশ্বাসে অনেক কিছু বলে ফেলল। কণার কথাই বলছিল আসলে। আমি শুধু কান পেতে শুনি। ‘আশরাফের সাহেবের এক কাজিন ছিল যে, ওই খরগোশটা যার। সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, একটা চিঠি লিখে। আর নাকি ফিরবে না কখনো!’
‘আশরাফের ওয়াইফ তো সে?’
‘আরে না তুমি কিছুই খবর রাখো না সাইফ, ওই মেয়েটা তো উনার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন, ওর বাবা মা নেই। এদের বাড়িতেই থাকে, আশরাফ সাহেব কি ম্যারিড নাকি? ওর বড়ভাইয়ের বউ আছে। ও বিয়ে করেনি এখনো। তুমি কিছুই জানো না!’
আরো বলতে থাকে, ‘ওরা মেয়েটার ফোন বন্ধ পাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে, এখন নাকি থানায় যাবে ডায়রি করতে, মেয়েটা নাকি কী সব পাগলামী করে মাঝে মাঝে। তবে জানো ওর খরগোশটা কিন্তু আমাদের বাসায় এখন। দেখি আমি খুঁজে কিছু একটা খেতে দিই। মায়া লাগছে খরগোশটার জন্য।’

আমাদের বাসটা ছেড়েছে এইমাত্র। আম্মার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে, চোখ বন্ধ করে আছেন তিনি। আমি কণার সিটের পাশে এসে দাঁড়াই।
‘বরকে কি বলেছো কণা?’
‘বলিনি কিছু আশরাফকে।’ রান্না করে এসেছি ওর পছন্দের রূপচাদা মাছ। কেউ ছিল না ঘরে, ওরা দু’ভাই বাজারে যায় শুক্রবার সকালে। আর বড় ভাবী তো ঘুমে ছিল, একটা চিঠি রেখে এসেছি ডাইনিং টেবিলে।
‘কী লিখলে?’
‘লিখেছি আর ফিরব না।’ আর হ্যাঁ খরগোশটাকে আপনাদের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে দিয়েছি সেই ভোরে। দরজা খোলাই ছিল।’
‘না ফিরে কই যাবে তুমি?’
‘আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি আমি, আমরা ফিরে আর আসব না ঢাকায়, তাই না?’
‘খরগোশটাকে মনে পড়ছে না তোমার?’
‘না , ও তো মহামায়া, যাকে ছেড়ে দিতে হয়। সারাজীবন কাছে রাখতে নেই।’
‘আশরাফ সাহেবও কি তাই?’
কণা কিছু বলে না, খুব কাছে এসে চুলটা ঠিক করে দেয় আমার।

মিঠুর ফোনের কথা বলিনি আমি কণাকে। আম্মাকেও না। আম্মার হাতে পান দিয়ে কণা উঠে দাঁড়ায়। আমার কাছাকাছি। ওর মোবাইল ফোনটা কোল থেকে মাটিতে পরে ব্যাটারি খুলে যায়। আমি তুলতে গেলে কণা আমার হাত ধরে বারণ করে। আমার পকেটে থাকা ফোনটাও আলগোছে বন্ধ করে দিই আমি।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। আকাশটা রক্তিম। অশান্ত। আমরা পৌঁছে গেছি। এগিয়ে যাচ্ছি, আমি আর কণা। আমার দুটো পায়েই শক্তি পাই। হেঁটে চলার শক্তি।

তবুও কণাকে ছুঁতে পারব বলে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো আরো কিছুকাল।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;