৭ মার্চের অমর কবিতা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য অবদান। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন-এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে তাঁর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিক-নির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’
মূলত এটাই ছিল স্বাধীনতার ডাক। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগে একাত্তরের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
এই ভাষণকে ধারণ করেই মরণপণ যুদ্ধ করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। যার যেভাবে সুযোগ হয়েছে সেভাবেই দেশমাতৃকার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে।
বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ন'মাস পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও সর্বক্ষণ বাংলার মানুষের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তাঁর বজ্রকণ্ঠের বক্তৃতায় রক্ত টগবগিয়ে উঠতো এ দেশের মানুষের। তাইতো শত কষ্টের মাঝেও জীবন দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন তারা।
আজ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।
ভাষণটিকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’কে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করছে সরকার। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দিবসটি উদযাপনে অনুষ্ঠানমালা কিছুটা সীমিত করলেও বিভিন্ন আঙ্গিকে তা উদযাপন করা হচ্ছে।
ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস ছিলো শোষণ-বঞ্চনার। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছিল বাঙালি বৈরী। মূলত এরপর থেকেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি অব্যাহতভাবে তার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। এভাবে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এরমাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১-এর জানুয়ারি। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি লাভ করে।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ছিল ৩১৩ আসনবিশিষ্ট। পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৩ আসন পেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ওই নির্বাচন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি জনগণের রায়।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ প্রভৃতি চক্র গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
সব মিলিয়ে তাদের আচরণে স্পষ্ট ছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। অন্যদিকে নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছিল আর বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল।
এদিকে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতিতে অবিচল থাকেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ পাঠ করান। এর মাঝেই ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ভুট্টো জানান, তিনি ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেন না। তিনি অধিবেশন ‘বয়কট’ করবেন।
এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হলে পাকিস্তানের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া ঢাকায় এলে তাঁর দলের সদস্যরা জিম্মি হয়ে পড়বেন। এসব ছিল তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি ও ষড়যন্ত্রের অংশ।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হঠাৎ তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন। পিপলস পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা দাবি করেন, তাঁদের দলের চাপেই প্রেসিডেন্ট তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেছেন। এসব আলামত দেখে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
এর মধ্যে ভুট্টো করাচিতে সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তা হবে ‘ডিকটেটরশিপ অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ম।
এ জাতীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি বলেন, ভুট্টোর বক্তব্য গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ভুট্টো সাহেবের ইচ্ছা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু দলের একনায়কত্ম প্রতিষ্ঠিত হোক, ডিকটেটরশিপ অব দ্য মাইনরিটি বাংলার মানুষ মেনে নেবে না।
তিনি বলেন, আমরা ৬ দফা কারও ওপরে চাপিয়ে দেব না। একজন সদস্যও যদি যুক্তিযুক্ত কোনো দাবি করেন, তা গ্রহণ করা হবে।
বঙ্গবন্ধু জানান, দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মাওলানা ভাসানী, নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, মোজাফ্ফর আহমদসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি হিসেবে পূর্বাণী হোটেলে ১ মার্চ আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়। ওই সময়ই রেডিওতে ঘোষিত হয়, প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন।
শাসকশ্রেণির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাংলাদেশের মানুষ আগেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রেডিও-তে ইয়াহিয়ার এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে দলমত-নির্বিশেষে জনগণ রাজপথে নেমে পড়ে।
তাদের ‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা—ঢাকা, ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ।
লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা শহর। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ছয়দিনের কর্মসূচি দেন। তা হচ্ছে- ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল।
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ভাষণ দেবেন। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু এও বলেন, ভুট্টোর দল ও কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ ছাড়াও আমরা শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারব।
একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, ৭ মার্চের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এমন প্রেক্ষাপটে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে তাঁর এই ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্য সব সেরা ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত।
তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মনের কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে।
বলেছিলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। তিনি জনতাকে তাঁর সহযাত্রী মনে করেছিলেন। সহযাত্রীর সব দুঃখ-বেদনা সম্পর্কে তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল। প্রকৃত নেতারা এমনই হয়, যেমনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু
তাঁর মনে প্রাণে ছিল শুধু বাংলার মানুষ। তাই তিনি সবার হয়ে তাদের দুঃখ-বেদনার কাব্য তুলে ধরেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে
ভাষণের একপর্যায়ে বাংলার আপামর জনসাধারণের অনুভূতিগুলোকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়ে কখন যে উপস্থিত জনতা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে পরিণত হয়ে গেছে তা বক্তা-শ্রোতা কেউ-ই খেয়াল করেননি।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘... তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্ ।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলাযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিলো ঢাকার পথঘাট। কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে-ই দিয়েছেন। এজন্য বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন জনতার নেতা শেখ মুজিব।
ষাটের দশকের শেষ দিকে পৃথিবীর অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল। নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার জন্য বায়াফ্রা সশস্ত্র সংগ্রাম করছিল। রক্তপাত হচ্ছিল কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছিল না বিদ্রোহীরা। আন্দোলন চলছিল ইন্দোনেশিয়াতেও। সেসব আন্দোলনের নেতিবাচক দিক ও দুর্বলতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল।
তিনি উপলব্ধি করেন হঠকারিতার পরিণতি শুভ হয় না এবং হঠকারী নেতা কখনো বিশ্ববাসীর সমর্থন পান না। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সংযত আচরণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন তাঁর দিকে এবং প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার ধিক্কৃত।
তিনি এতটা সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন যে এই কৌশলের কারণে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ এবং প্রস্ততি তাকা স্বত্বেও এই জনসভার ওপর হামলা করার সাহস করেনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে একজন কর্মকতা বলেন যে, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না (ডয়েচে ভেলে, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে সাবলীল বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রতিদিন যে মানুষ মারা যাচ্ছিল তাও তুলে ধরেন তিনি। ৬ মার্চ এ ইয়াহিয়া যে, ২৫ মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথাও উঠে আসে তাঁর ভাষণে। তুলে ধরেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতির পটভূমি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘... ২৫ তারিখ অ্যাসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না। ... আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।...আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না।’
তাঁর ঘোরতর প্রতিপক্ষ ও শত্রুকেও সৌজন্য রক্ষা করে সম্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, জনাব ভুট্টো সাহেব। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান এবং জাতীয় পরিষদে যোগদানের এমন চারটি শর্ত ঘোষণা করেন যা কারও পক্ষে অযৌক্তিক বলা সম্ভব ছিল না। সে জন্য পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা। জনগণনন্দিত ও গণতান্ত্রিক এই নেতা শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার অর্জনের পথ খোলা রাখতে। ৭ই মার্চের পরও তিনি ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন।
তারা চেয়েছেন অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বারণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, '... তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।'
কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র পশুশক্তি নিশ্চিহ্ন করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালি আর মেনে নেয়নি, তারা রুখে দেয়।
শোষিত ও নির্যাতিত বাঙালি জাতিতে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একাত্তরের মার্চ মাসের ৭ তারিখে তাঁর ভাষণেই যেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন এক দিগন্তের সূচনা করে।
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি, উদযাপন করেছি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। এবছর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেরও পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।
এমতাবস্থায় এই ভাষণটি আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তার দিকনির্দেশনা আজও রয়ে গেছে। সেই নির্দেশনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামনের দিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, জয় বাংলা।
লেখক-উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর। ই-মেইল: [email protected], [email protected]