বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ১)
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বনেতা, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাংলাদেশের আর দশটি সাধারণ গ্রামের মতো গাছপালা, জঙ্গলঘেরা, নদীমাতৃক, গ্রামবাংলার এক নিভৃত কোণে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছোট শাখা নদী বাইগার। কিছু দূরে মধুমতি।
১৭ মার্চ ১৯২০ মঙ্গলবার দিবাগত রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুন। বাবা-মা ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। খেলার সাথীরা ডাকতেন ‘মুজিব’ বলে। বন্ধুরা ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’। মা-বাবার দেওয়া প্রকৃত নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
শৈশবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন হালকা পাতলা, ছিপছিপে ধরনের সুদর্শন বালক। তাঁর চেহারায় এক ধরনের বৈশিষ্ট্য অনেকেরই চোখে পড়ত। স্বল্পভাষী বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। মাছমাংস খেতে চাইতেন না । নিরামিষ বা শাকসবজিই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। বাল্যকালে তাঁর প্রিয় খাবার ছিল কলা ও ডুমুর। এছাড়া তিনি কৈ, শিং, মাগুর ও কাচকি মাছ পছন্দ করতেন। তিনি সারাজীবন দেশি ফলমূল খেয়েছেন। গোলাপ ফুল ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী। সেই সঙ্গে তিনি কোমল হৃদয়েরও অধিকারী ছিলেন।
বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর ১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে ১৯২৯ সালে নয় বছর বয়সে তাঁকে গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমিতে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। আরো পরে তাঁকে বাবার কর্মস্থল মাদারীপুরে ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করানো হয়।
মাদারীপুরে অবস্থানকালে ১৯৩৪ সালে কিশোর বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগে তাঁর চোখে ছানি পড়ে এবং প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মাদারীপুর ও আশেপাশের নামকরা ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করিয়েও যখন কোনো ফল হলো না, তখন তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তৎকালীন উপমহাদেশের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি. আহমদের তত্ত্বাবধানে তাঁর চোখের অপারেশন করা হয়। ঐ ডাক্তারের সফল চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধুর চোখ মোটামুটি ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শে সেই যে তিনি চশমা পরতে শুরু করেন, আজীবন তা অব্যাহত থাকে।
চোখের অসুখের জন্য বঙ্গবন্ধুর পড়ালেখা প্রায় চার বছর বন্ধ ছিল। কলকাতায় চোখের চিকিৎসা করিয়ে বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর ফিরে যান। এসময় তিনি স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে তিনি যোগদান করতে থাকেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্বদেশি আন্দোলনের সভায় যোগদানের জন্য তিনি এসময় প্রায়ই গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর যাতায়াত করতেন এবং স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের সাথে মেলামেশা করতেন।
তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, খোকা বড় হয়ে জননন্দিত রাজনীতিবিদ হবেন, বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত হবেন সারা বাংলাদেশে, এমনকি সারা বিশ্বে! যখন গ্রামে-গঞ্জে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তাঁর নামে শ্লোগান উঠত—“তোমার ভাই আমার ভাই, মুজিব ভাই মুজিব ভাই” অথবা “তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”—তখন কেউ কি বুঝতে পেরেছিল তাঁর নেতৃত্বেই ধাপে ধাপে একদিন স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে; তিনিই হবেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বচ্ছলতা ছিল। নিজেদের জমির যে পরিমাণ ফসল গোলাঘরে উঠত তা দিয়ে সারাবছর স্বচ্ছন্দে চলে যেত। বাবা-মার আদর স্নেহের মাত্রাও বঙ্গবন্ধুর ওপর একটু বেশি ছিল। ইংরেজ রাজত্বের গোলামীর শৃঙ্খল ভাঙার দায়িত্ব খোকার ওপর বর্তাক তা বাবা চাননি। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে বাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল, বড় হয়ে তাঁর ছেলে স্বাধীন আইনজীবীর পেশা গ্রহণ করবে এবং এ পেশা গ্রহণ করলে দেশ ও দেশের জনগণের সেবাও করতে পারবে। তিনি আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন, নিজে যা পারেননি, তা যেন বঙ্গবন্ধু পক্ষে সম্ভব হয়, তাঁর অন্তরের সব আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই যেন পূর্ণতা পায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন চলাফেরায় বা কাজকর্মে বাধা দেননি অথবা জোর করে তাঁর ওপর কিছু চাপিয়েও দেননি।
১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু। ততদিনে তাঁর বাবা মাদারীপুর থেকে বদলি হয়ে গোপালগঞ্জ ফিরে এসেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবদুল হামিদ মাস্টারকে বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সচেতন হওয়ার পেছনে গৃহশিক্ষক হামিদ মাস্টারের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
শিশুকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের ছিলেন বলে তাঁর ভয়-ভীতি আদৌ ছিল না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার অভ্যাস থাকায় কারো সামনেই তিনি কথা বলতে ভয় পেতেন না—তা সে খেলার সাথী, সহপাঠী অথবা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ডাক সাঁইটে হেডমাস্টার গিরিশ বাবু বা নিজের বাবা যিনিই হোন না কেন। প্রধান শিক্ষক গিরিশ বাবু কিশোর বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা আর দৃপ্ত বলিষ্ঠতার গুণেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে শুধু প্রধান শিক্ষককে নয়, বঙ্গবন্ধু সবাইকেই জয় করে নেন। সহপাঠীদের মুজিব ভাই হয়ে উঠলেন।
বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল খেলায় তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন, ভলিবলেও তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিষ্টি কথা, অন্তরঙ্গ ব্যবহার এবং খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের কারণে অল্পদিনেই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবারই প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। স্কুলের যে কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানে তাঁর থাকত সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি অনেক সামাজিক কাজেও তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। যে কোনো ধরনের কাজেই বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেই অন্য ছাত্ররা তাঁর সাথে এগিয়ে যেত সেই কাজে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে কোনো দাবি বা আবদার অথবা কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুই এগিয়ে যেতেন। শৈশব-কৈশোরেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি দেখা গিয়েছিল। [চলবে]