নিথর ক্যাম্পাসে প্রকৃতির বর্ণিল উদ্ভাস
বাকৃবি ক্যাম্পাস ঘুরে: বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভূষিত অনন্য দ্বীপের মতো। এলোমেলো জনপদের পাশে সাজানো নন্দনকানন হয়ে মোহিত করে ক্যাম্পাসগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর বা ফুলার রোড, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক সরণীতে ছায়া সুনিবিড় বৃক্ষরাজির পরশে অনুভব করা যায় স্বপ্নীল অনুভূতি।
ব্রহ্মপুত্রের তীরে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটপী ছাওয়া ক্যাম্পাসও দোলা দেয় শিহরণ জাগানিয়া আবহে। ঘোরতর করোনাকালে কেমন আছে প্রাণের ক্যাম্পাস, দেখতে গিয়েছিলাম শুক্রবার (২ অক্টোবর) বিকেলে। সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে নারকীয় গণধর্ষণের ঘটনার পর দেশের ক্যাম্পাসগুলো রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রস্থলে। বার্তা২৪.কম'র অনুসন্ধানে নিথর ক্যাম্পাসে দেখা গেলো প্রকৃতির বহু বর্ণিল উদ্ভাস।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা ১২০০ একর আয়তনের এক সবুজ ক্যাম্পাস শুধু ময়মনসিংহের নয়, পুরো দেশের গর্বের বিষয়। যেখানে আছে সারি সারি গাছপালা, পাখির কলকাকলি আর পুষ্পের বাহার। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অবস্থিত ফুলে ফলে সাজানো এ ক্যাম্পাসটি বিমোহিত করে যে কাউকেই।
ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) হৃদয় জুড়ানো চিরসবুজ ক্যাম্পাসটি সবসময়ই শিক্ষার্থীদের পদচারণার পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের আগমণে মুখরিত থাকে। জমজমাট থাকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা আর আড্ডার মধ্য দিয়ে। কিন্তু গত প্রায় সাড়ে ৬ মাস ধরে একেবারেই উল্টোচিত্র এখানে। করোনার ভয়াল থাবায় থমকে গেছে সবকিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোণেও নেই কোন শিক্ষার্থীর ছায়া। হল বন্ধ। ক্লাস বন্ধ। প্রকৃতিকে বুকে আগলে যেন নিথর পড়ে আছে প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর প্রাণের বাকৃবি ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, যে ক্যাম্পাসটি সবসময় প্রাণচঞ্চল থাকতো, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও মিলনায়তনে ঝুলছে তালা। বন্ধ রয়েছে ৬০০ প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির সংগ্রহ নিয়ে ২৫ একর জায়গাজুড়ে থাকা সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন।
আর শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে যারা বাকৃবি এলাকায় ঘুরতে আসছেন তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তা প্রহরীরা। সড়কের কয়েকটি প্রবেশমুখে বাঁশের ব্যারিকেট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে নিঃসঙ্গ একাকীত্বে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘বিজয়-৭১’, গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ বদ্ধভূমি, শহীদ মিনার, নদের পাড়, বৈশাখী চত্বর, আম বাগান, লিচু বাগান, নারিকেল বাগান, কলা বাগানসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন স্থান।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে প্রাণহীন ছয়টি অনুষদ ভবন, দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী ভবন, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন ভবন, প্রকৌশল ভবন, অতিথি ভবন, ক্লাব ভবন, ৬৫৭টি আবাসিক ইউনিট, ১২টি ফার্ম, ফিল্ড ল্যাব, ক্লিনিক, ওর্য়াকশপ, মনোরম ১৩টি হল, স্টেডিয়াম, জিমনেসিয়াম, ঈশাঁ খা হল লেক, হেলথ কেয়ার সেন্টার, ফ্যাকাল্টি করিডোর, বঙ্গবন্ধু চত্বর, প্রেম বারান্দা, মারন সাগর, ডরমেটরিসহ পুরো ক্যাম্পাস। মনে হলো, নৈশব্দ চুপি চুপি কথা বলছে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে।
নিথর ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা মিলল কয়েকজন নিরাপত্তা প্রহরীর। ফাঁকা ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করতে কেমন লাগছে, জানতে চাওয়া হয় নিরাপত্তা প্রহরী রুহানুর রহমান মিঠুর কাছে। জবাবে তিনি বলেন, 'আমার ছয় বছরের চাকরি জীবনে এমন ক্যাম্পাস দেখেনি কখনো। ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রী না থাকলে ক্যাম্পাসে প্রাণ থাকে না। হৈ-হুল্লোর, খেলাধুলা, ক্যাম্পাসে ঘুরাফেরা কিংবা রাতে আড্ডা দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এখন মনে হয় ক্যাম্পাসটা থমকে গেছে। জনমানব শূন্য এমন ক্যাম্পাস দেখতে খুব খারাপই লাগে।'
ক্যাম্পাসে না থাকতে পেরে মন ভাল নেই শিক্ষার্থীদেরও। প্রাণের ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তাদের মন। মোবাইল ফোনে কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতি আবুল বাশার মিরাজের সঙ্গে। মিরাজ বলেন, ‘গত ২১ মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বন্ধ হলে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়। প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ, প্রিয় শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোলাগার জায়গাগুলো মিস করছি। মিস করছি হল লাইফ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের। পড়াশোনার ফাঁকে সময় পেলেই ক্যাম্পাসে, প্লাটফর্মে কিংবা ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদে আড্ডা দিতাম। একটু সময় পেলেই আমবাগান কিংবা বোটানিক্যালে ঘুরতে যেতাম। করোনাকালে আমার মতোই সবাই চিরসবুজের বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক মিস করছে। প্রত্যাশা করি দ্রুতই করোনাকাল শেষ হবে, ফের সবাই মিলে মিলিত হবো প্রাণের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।'
শেষে শরতের স্বর্ণালী আলো মেখে ফিরে আসার সময় মনে হলো বিরহী ক্যাম্পাস যেন হাহাকার করছে। বিরহী প্রহর গুনছে প্রিয় শিক্ষার্থীদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।