ওপেনিং ডে
সেতুতো দূরের কথা, ঘাগর নদীর ঘাটে তখন ফেরিও চালু হয়নি। গোপালগঞ্জ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ মিনিবাসে চেপে ঘাটে গিয়ে নামতাম। নৌকায় নদী পার হয়ে ভ্যানগাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে কলেজে পৌঁছাতাম। থাকতাম যে ডরমেটরিতে, শুনেছি সে জায়গাটায় একসময় সতীদাহ চিতা ছিলো।
ডরমেটরিতে বিদ্যুত সংযোগ ছিলো কিন্তু বাতি জ্বলতো না, পর্যাপ্ত ভোল্টেজের অভাবে। সুতরাং রোজ বিকেলে হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করা ছিলো আমাদের নৈমিত্তিক কাজ। যখন আমি কোটালীপাড়া শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করতাম, তখনকার কথা বলছি। আমার চাকরির বয়স তখন মাত্র দেড় বছর।
ঈদের ছুটি শেষে ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছি। লঞ্চে পদ্মা পার হতে গিয়ে ঝড়ের তাণ্ডব দেখলাম। যাত্রীদের ত্রাহি দশা! গোপালগঞ্জ পৌঁছাতে সন্ধ্যা। ঝড় হচ্ছে। আজ আর কোটালীপাড়ার কোনো গাড়ি ছেড়ে যাবে না। কী করি। খুঁজেপেতে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় এসে হাজির হলাম। দুই সিটের একটি কক্ষে এক সিট খালি আছে। তাই সই। বিদ্যুত নেই। মেঝেতে কিছু রড আর সিমেন্টের ব্যাগ দেখতে পেলাম। কেয়ারটেকার কলা-রুটি এনে দিলো। তাই খেয়ে … না, শুয়ে পড়লাম না, বসে রইলাম- রুমমেট কখন আসেন।
রাত ১০টার পর তিনি এলেন। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার। মোমের আলোয় দুজন পরিচিত হলাম। কথা হলো অনেক। দুর্ঘটনায় হাত ভেঙেছে। ভাঙা হাড় জোড়া দিতে যে রড ব্যবহার করা হয়েছিলো, সে দুটি ব্যাগে বয়ে বেড়ান। বের করে আমাকে দেখালেন। বললেন, আমাদের রড এখন ডাক্তাররা দখল করেছে। বলেই হাসি, যাকে বলে ছাদফাটানো হাসি।
তখন, যখন খুব সকাল, বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কোটালীপাড়ার কোনো গাড়ি ছেড়ে যাবে না। কোথায় যেন স্লুইসগেট আর কালভার্ট ভেঙে গেছে। ঐ ভাঙন পর্যন্ত একটি টেম্পু যেতে রাজি হলো। যাত্রী আমরা তিন-চারজন। এলাম। দোকানপাটের ঘনত্ব দেখে মনে হলো এটি একটি হাট। লাল আটার রুটি আর কবরি কলা দিয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম।
রাস্তার পাশে সরু খাল। একমাত্র নৌকার মাঝিকে অনেকটা মিনতি করে রাজি করালাম আমাকে কোটালীপাড়া পৌঁছে দিতে। দিলো। একেবারে উপজেলার ঘাটে।
কলেজ শুরু ৯টায়। ১০টা বেজে গেছে। দুরু দুরু বক্ষে এসে কলেজে ঢুকলাম। অফিস সহায়ক বাকা মোল্লা ছাড়া আর কেউ নেই, আসেনি। এমন কি, যে অধ্যক্ষ মহোদয় বলেছিলেন, “ওপেনিং ডে’তে' সবাইকে হাজির থাকতে হবে। কোন ওজর-আপত্তি চলবে না”- তিনিও আসেন নি বা আসতে পারেন নি! ( মনে পড়লো, একবার বৃহস্পতিবারের ছুটি নিয়ে দুদিনের জন্য ঢাকা গিয়েছিলাম। শনিবারে ফিরে গেলে অধ্যক্ষ মহোদয়ের রুমে ডাক পড়লো। ‘আপনি নিজে ছুটি নিয়ে গেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু কলেজ ছুটি দিয়ে গেছেন কোন পাওয়ারে?’ পরে জানা গেল আমি নেই- বাংলার ক্লাস হবে না। তাই বৃহস্পতিবার আর কেউ কলেজে আসেনি! )
দুপুর পর্যন্ত ‘থ হয়ে বসে রইলাম। তারপর বাকা মোল্লাকে বলে ডরমেটরির পথ ধরলাম। ‘এমন বন্যা-তুফানে কেউ আহে?’- পেছন থেকে ভেসে এলো!
দীর্ঘ ছুটির পর খোলার দিনকে ‘ওপেনিং ডে’ বলা হয় বলেই জেনেছি।
পাদটীকা: করোনাকালীন বন্ধের পর আরেক আমেজে 'ওপেনিং ডে' এসেছিল। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে সেটিও ছিল অভূতপূর্ব 'ওপেনিং ডে'!