বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যাভাবনা
বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি একই সঙ্গে সুগভীর ও সুবিস্তৃত। যাকে বিশ্ববিদ্যা বলা হয় তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা-সরহদ্দ নেই। জ্ঞান অথবা বিদ্যা যা-ই বলি না কেন তা প্রথমত স্থানীয় এবং পরে স্থানোত্তর এবং তারও পরে আন্তর্জাতিক। জ্ঞান এবং বিদ্যা নিত্য সঞ্চরণশীল এবং পারস্পরিকতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সে অর্থে বিশ্ববিদ্যা ধারণাটাও সীমান্ত ও সীমানাবিহীন ধারণা। একদিন আমরা পাঠ করেছিলাম গ্যারিবল্ডি, গান্ধি, নেতাজি সুভাষ বোস কিংবা ক্ষুদিরামের জীবনী। আজকের প্রজন্মের সামনে রয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক একটি ভূখণ্ড স্বাধীন হলে তার প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যার জগতেও। ভারতবর্ষের একেবারে পূর্ব প্রান্তের এক চিরপরাধীন জনগোষ্ঠির স্বাধীন-সার্বভৌম হওয়ার বিপ্লব অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দেয় বৈশ্বিক মানচিত্রে। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী আইরিশ জাতির লোকেদের শিক্ষায়তনে পাঠ্য হয়ে উঠলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম।
বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের কাহিনির অধ্যয়ন চললো সেই সুদূরে। বিশ্ববিদ্যার দিগন্ত প্রতিমুহূর্তে সম্প্রসারিত হচ্ছে। নতুন-নতুন উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে তার ভুবন। কালগত বিচারে বলা যায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে আজও চলমান বিশ্ববিদ্যার অভিযাত্রা। বিশ্ববিদ্যাকে অত্যন্ত সফল ও সুচারুভাবে ধারণ ও প্রসারণের কর্তব্যকর্মটি যুগ-যুগ ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে বিশ^বিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান।
এ প্রতিষ্ঠানটিকে যদি একটি বিশাল কারখানার সঙ্গে তুলনা করি তাহলে বলতে হবে এর মধ্যে নিয়ত ঘটে চলেছে বৈপ্লবিক প্রবাহ। সে প্রবাহ সৃষ্টির এবং সে সৃষ্টিকর্ম কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত আর সে কল্যাণ ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের এবং বিশ্বের।
জ্ঞান, বিদ্যা, শিক্ষা ও গবেষণার জন্যে ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো এথেন্সে অ্যাকাডেমিয়া নামক যে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন সেটির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক পৌরাণিক বীরের নাম। গ্রিক পুরাণের বীর এ্যাকাডেমুস স্পার্টার আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন এথেন্সকে। জ্ঞান ও বিদ্যাকে দেশ ও জাতির মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ রূপে গণ্য করবার মানসিকতা এতে স্পষ্ট।
পারস্পরিক আলোচনা, অধ্যয়ন এবং গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন প্লেটো। সবকিছুর লক্ষ্য ও গন্তব্য ছিল কল্যাণ। যে-জ্ঞান ও বিদ্যা রাষ্ট্রকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে তার চর্চা কাম্য ছিল তাঁর নিকটে। গণিত, দর্শন, জ্যামিতির মত সূত্র বিষয়কে মস্তিষ্কে ধারণ করবার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে লেখা থাকতো যাদের জ্যামিতি সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের প্রবেশ নিষেধ।
কারা পড়তেন তাঁর শিক্ষালয়ে: যাঁরা ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হবেন, যাঁরা রাষ্ট্র ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন তাঁরা। অর্থাৎ আড়াই হাজার বছর আগেই জ্ঞান, বিদ্যা, শিক্ষা ও গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানতে পারা যাচ্ছে। প্লেটো অবশ্য মনে করতেন লেখাপড়া ও জ্ঞানচর্চা সকলের জন্য নয়, গরিব মানুষেরা বা দাসশ্রেণির লোকেরা বিদ্যাচর্চা করে সমাজ-রাষ্ট্রকে চালাবে সেটা তিনি ভাবেন নি।
তিনি মনে করতেন, অভিজাত শ্রেণির লোকেরাই বিদ্যা, জ্ঞান, গবেষণা এসব করবে। প্লেটো’র চিন্তায় সামাজিক মঙ্গলের ধারণা থাকলেও তিনি ব্যক্তির বিকাশকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ‘নোমোস’ নামক গ্রন্থে প্লেটো বলেন, যদি তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা হয় তবেই আমাদের রাষ্ট্র-জাহাজটির পক্ষে সফল পরিভ্রমণ সম্ভব হবে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে তার পরিণতি কী হবে সেটা না বলাই ভাল।
প্লেটোর চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে আমরা এখন স্পার্টার দৃষ্টান্তটি স্মরণ করতে চাই। খ্রিস্টপূর্ব ৭২০ থেকে ৫৭৬ সালের কালপরিধিতে একটি শ্রেষ্ঠ নগররাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল স্পার্টা। গ্রিসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, কবি, সঙ্গীতশিল্পী এবং ক্রীড়াবিদেরা ছিল নগরটির সম্পদ। সমগ্র গ্রিসের তারুণ্যশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি অলিম্পিক-ক্রীড়াকে মানদণ্ড ধরলে দেখা যায়, এ সময়পরিধির ৮১ জন চ্যম্পিয়নের মধ্যে ৪৬ জন ছিল স্পার্টার।
বস্তুত প্লেটোর উদ্দিষ্ট জ্ঞানচর্চা ও কলাবিদ্যার অবলম্বনে স্পার্টা ছাড়িয়ে যায় অন্যদের। কিন্তু সেই স্পার্টাই ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসে ক্রমিক অধোগতির মুখোমুখি। তার কারণ হলো প্রথমত ব্যক্তির মেধা-প্রতিভা ও শ্রেষ্ঠত্বকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে স্পার্টা জনমণ্ডলীর বিষয়াদির প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠে। কলা ও মানববিদ্যা এবং বিচিত্র বিষয়ের জ্ঞানের পরিবর্তে তারা চাইলো একমুখী লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে সেটা হলো সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন।
মস্তিষ্কের সূত্র তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে না লাগিয়ে মোটা দাগের যুদ্ধবিদ্যাকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্পার্টা শেষ পর্যন্ত তার মর্যাদার আসনটি হারিয়ে বসে। কিন্তু গ্রিসের রাজধানি এথেন্স ধারাবাহিক সফলতার মধ্য দিয়ে জ্ঞান-বিদ্যা ও গবেষণার আশ্রয়ে যে মাত্রিকতা স্পর্শ করে পৃথিবীময় পরিস্ফুট হতে থাকে তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া।
আজও তাই বিশ্ববিদ্যা বলতে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সেখানেই, যেখানে জ্ঞানকে মনে করা হতো বহুমুখী এবং যেখানে বৈচিত্রকেই গ্রহণ করা হতো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম বলে। প্লেটোর পরবর্তীকালে এরিস্টটল এবং তারও পরে গ্রিসের প্রভাবে গড়ে ওঠা রোমের উদাহরণ থেকেও সেটি অনুধাবন করা যেতে পারে।
একা এরিস্টটল একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা ছিল তুলনা রহিত। কেবল তাই নয় জ্ঞানার্জন ও গবেষণার ক্ষেত্রে সৃজনশীল ভাবনার প্রয়োগ এবং তাতে সাংগঠনিক বিন্যাসের সংযোজন তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। ‘লাইসিয়ামে’ তিনি লেকচার দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে। পাশাপাশি চলতো তাঁর গ্রন্থ রচনার কাজ।
একই সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন গ্রন্থের সংগ্রহ তথা লাইব্রেরি। বলা যায় লাইব্রেরিকে বিদ্যাচর্চার সমান্তরালে আবশ্যক উপাদান হিসেবে তিনি বিবেচনা করেছিলেন। ইউরোপের প্রথম লাইব্রেরি গঠনের কৃতিত্ব এরিস্টটলের। তাঁর ছাত্র দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডারের দৃষ্টিতে তাঁর গুরুর জ্ঞান-শিক্ষা-গবেষণার কাজটি ছিল অত্যন্ত পবিত্র একটি সামাজিক কর্মের মতন।
আলেক্সান্ডার এক বিশাল গ্রন্থভান্ডার উপহার হিসেবে পাঠান এরিস্টটলকে তাঁর সেই লাইব্রেরিটিকে সমৃদ্ধ করে তুলবার জন্যে। আবার এরিস্টটল সেখানে জাদুঘরও গড়ে তোলেন যেখানে গাছপালা ও প্রাণিজগতের নানা স্পেসিমেন সংগ্রহ করা হতো। শিক্ষার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত ছিল এসব সংগ্রহশালা। লাইসিয়ামের নিকটে চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলেন তিনি।
এর জন্যে চার লাখ ডলার অনুদান হিসেবে প্রদান করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র আলেক্সান্ডার। দূরদূরান্ত থেকে পণ্ডিতরা লাইসিয়ামে আসতেন বিদ্যা ও জ্ঞানের উন্মুখতায়। যাঁরা যোগ্য তাঁদেরকে নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে বেছে নিতেন এরিস্টটল। জাদুঘর, লাইব্রেরি এবং সংগ্রহশালার জন্যে ‘ক্যাটালগিং’ পদ্ধতি চালু করা হয় এবং ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করবার জন্যে দেওয়া হতো অনুপ্রেরণা।
বিদ্যাচর্চা ও শিক্ষাকে সম্পূর্ণাঙ্গ করে তুলবার এরিস্টটলিয় পদ্ধতিটি আজকের দিনেও যুগান্তকারী বলে বিবেচিত। তিনটি বিশেষ দিকের সমন্বয়ে বিন্যস্ত ছিল এরিস্টটলের জ্ঞানচর্চা গবেষণা, ফিল্ডওয়ার্ক এবং তুলনামূলক বিদ্যা। কোনো একটি বিষয়ের জ্ঞানকে পারস্পরিক তুলনার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করার সফল পদ্ধতির প্রবর্তনা তাঁরই কৃতিত্ব। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রতি দশদিন অন্তর একজন করে ছাত্র-প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো এবং তাঁর দায়িত্ব ছিল প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগসেতু রূপে কাজ করা।
বিদ্যা-জ্ঞানচর্চার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এরিস্টটলের অবদান বলে শেষ করবার নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের তথা সহশিক্ষার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তিনি। ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত প্রথম পর্ব এবং ১৫ থেকে ১৮ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব: এভাবে বয়সভিত্তিক শিক্ষা চালু ছিল সেখানে। ভাষা, সংগীত, ব্যাকরণ, অংক, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য, অলংকার, দর্শন, বিজ্ঞান মোটকথা বহুমুখী শিক্ষণপদ্ধতির দ্বারা তরুণ মন ও মননকে সুসমন্বিত করবার এরিস্টটলিয় পদ্ধতিই পরবর্তীকালে বৃহত্তর গ্রিসিয় পদ্ধতি হিসেবে পরিগৃহীত হয়।
এথেন্সে সার্বিক শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চাকে বায়বীয় ও বিমূর্ত নয় বরং শরীর ও মনের সুসমন্বিত বিদ্যারূপে গড়ে তোলা হয়েছিল। যেজন্যে জিমন্যাস্টিক্স, সংগীত ও সাহিত্য গৃহীত হয় অনিবার্য বাধ্যবাধকতায়। শরীরকে সুস্থ-সতেজ রাখবার জন্যে জিমন্যাস্টিক্স, আবেগকে পরিশুদ্ধ করবার জন্যে সংগীত এবং সত্তাকে সুন্দরের প্রতি মনোযোগী করবার জন্যে ছিল সাহিত্যের অপরিহার্য অবলম্বন। এ-প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য স্মরণযোগ্য: the creation of a sound mind in a sound body-ই পারে the welfare of the individuals so as to bring happiness in their lives এমন সুপরিণতি নিশ্চিত করতে।
এরিস্টটলের বিদ্যাচর্চাকে প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববীক্ষামূলক বলা যাবে এমনকি আজকের দৃষ্টিতেও। সমগ্র জ্ঞানচর্চাকে চারটি মাত্রায় বিন্যস্ত করেছিলেন তিনি (ক) জ্ঞানের সততা ও নির্ভেজালতা (খ) জ্ঞানের সূচনায় আশ্চর্যবোধকতা (গ) জ্ঞানসৃজনের অন্যতম পদ্ধতি হিসেবে ভাষিক যোগাযোগ এবং (ঘ) জীবনপ্রণালীর আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে জ্ঞানকে চিহ্নিত করা।
আড়াই হাজার বছর আগেকার এরিস্টটলিয় বিদ্যাচর্চার পদ্ধতিকে এখনকার দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখবো, যেটা নোয়াম চমস্কিও বলেছেন তাঁর এক রচনায়, বর্তমানে তথ্য অত্যন্ত সুলভ এবং তথ্যকে আজ আর জ্ঞান বলবার উপায় নেই।
কেননা, প্রতিমুহূর্তে তথ্য তথ্যেরই চাপে মূল্যহীন হয়ে উঠছে। এমনকি যে-শিক্ষার্থী চমৎকারভাবে পরীক্ষাপর্ব উত্তীর্ণ হচ্ছে সে-ও অল্পদিনের মধ্যেই তার অধীত বিদ্যাকে বিস্মৃত হচ্ছে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যাসচেতন শিক্ষাবিদগণ তাই পুনরায় ধ্রুপদী সামগ্রিকতার ধারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তাঁরা বলছেন যে-জ্ঞানচর্চা গণিত, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস ও সাহিত্যকে একসঙ্গে এক মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারবে সেই হবে প্রকৃত বিদ্যার্থী। হয়তো এরিস্টটলিয় পদ্ধতির অনসৃতিই আমরা দেখবো যখন মার্কিন দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ পাঠ্যসূচিতে কঠিন গণিত ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি রয়েছে শেক্সপিয়র ও বার্নাডশ কিংবা হুইটম্যান ও হেমিংওয়ের অবস্থান।
এ-লেখাটার শুরুতে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যা প্রথমত স্থানীয় এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক। বলাবাহুল্য বিদ্যা এমন কোনো স্বয়ংচল কিংবা চলিষ্ণু বস্তু নয় যে তা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পর্যটন করে বেড়াবে।
সমস্ত স্থানীয় বিদ্যাই এর স্বকীয় অন্তর্নিহিত শক্তিতে এর উৎসস্থলের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে সমকালে কিংবা কালোত্তরে পরিণত হয় বিশ্বজনীন বিদ্যায়। এর সবচেয়ে অনুপম দৃষ্টান্তটি আমরা লক্ষ করতে পারি ৮ম/৯ম শতাব্দীর বাগদাদে। খলিফা আল মনসুর (৭৫৪ থেকে ৭৭৫) সেখানে স্থাপন করেছিলেন এক অনন্য অনুবাদকেন্দ্র।
অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের নানা স্থান থেকে বিশেষ করে গ্রিস থেকে বিশ্ববিদ্যা আহরণ করে তার আলোয় নিজেদের উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে খলিফা মামুন (৮১৩ থেকে ৮৩০) বাগদাদে প্রতিষ্ঠা করেন গবেষণাকেন্দ্র। সেখানে চিকিৎসা ও শরীরবিদ্যার ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয়।
গ্রিসের গ্যালেন এবং এরিস্টটলের মতবাদ ও ধারণাগুলোকে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছিল বাগদাদে। দেখুন, প্রায় ১৫০-এর অধিক দ্বীপের দেশ গ্রিসের প্রত্যন্ত দ্বীপ থেকে বিশ্ববিদ্যা পরিভ্রমণ করে এসে উপস্থিত হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম সুমেরিয় সভ্যতার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। বাগদাদে একনাগাড়ে ৩০০ বছর ধরে চলেছিল মনসুর ও মামুনের নবদিগন্ত উন্মোচনকারী উদ্যোগ।
গ্রিস থেকে আসা বিদ্যা গ্রহণে কোনো কার্পণ্য লক্ষ করা যায়নি পারস্যবাসী আল-খাওয়ারিজমি’র। আবার, ভারত, গ্রিস এবং ব্যবিলনিয় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত তাঁর নিকট থেকে পৌঁছে যায় স্পেনে, পর্তুগালে এবং সারা বিশ্বে।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাফাতিহ্ আল-উলুম’ বা ‘বিজ্ঞানের চাবিকাঠি’-তে তিনি গ্রিসের বিদ্যার প্রতি ঋণ স্বীকারে কোনো প্রকারের কার্পণ্য করেন নি। লিখেছেন তিনি, ফালসাফা এসেছে গ্রিক শব্দ ফিলসফি থেকে, যার অর্থ জ্ঞানের প্রেমিক। একই সঙ্গে প্রকৃত বিদ্যা জিনিসটা কী হতে পারে তারও সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন আল-খাওয়ারিজমি: ফিলসফির অর্থ হলো বস্তুর সত্যের বিজ্ঞান এবং যা কিছু ভাল তার বিজ্ঞান।
অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যার কেন্দ্রে মূলত শ্রেয়ত্ব ও সত্যের অধিষ্ঠান। কেবল আল-খাওয়ারিজমিই নয় ইরাকি দার্শনিক আল-কিন্দিও গ্রিস-আগত বিদ্যা ও জ্ঞানকে আরব জাতির জন্যে গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা ও সংকোচ করেন নি। একটি বারের জন্যেও ভাবেন নি তিনি, মুসলমান ধর্মাবলম্বী আরব দেশের লোকেরা কেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ধারণাকে এতটা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে এবং গ্রহণ করে সমৃদ্ধ করবে নিজেদের। তাই আব্বাসিয় খলিফাকে দেখা যায় তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে। তাঁর দায়িত্ব ছিল গ্রিস থেকে আরবি ভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শনের বিচিত্র সব অনুবাদের নির্ভুল সংরক্ষণ করা।
গ্রিস ও ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র বিদ্যাকে সমগ্র আরব অঞ্চলের মননরাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন আল-কিন্দি। আব্বাসিয় খিলাফতের সময়কার আল-ইয়াকুবির (মৃত্যু ৮৯৭ খ্রি) কথা বলা যেতে পারে। তাঁকে বলা হয় আরব গোলার্ধে বিশ্বসংস্কৃতির প্রথম প্রচারক। তাঁর মৃত্যুর ১২০০ বছর পরে হল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর গ্রন্থের অনুবাদ।
সমস্ত ভাল বা সমস্ত সুন্দর যে কেবল আরব দেশেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা অত্যন্ত মনোজ্ঞ ভাষায় উপস্থাপন করেছিলেন আল-ইয়াকুবি। ‘কিতাবুল মুতাব্বার’-এর লেখক আবুল বারাকাত আল-বাগদাদির নাম আমাদের জানা। ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত বারাকাত এরিস্টটল, ইবন সিনা এবং তাঁর নিজের ধারণা ও ব্যাখ্যাকে সমন্বিত করে দেখান যে যুগে-যুগে প্রচলিত বিশ্ববিদ্যাকে সমকালের উপযোগী করে রূপ দিতে হয়।
মজার কথা হচ্ছে তাঁর ধারণাকে গ্রহণ করেছিলেন মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞানীরা। এতেই বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যার ধারণার কেন্দ্রেই রয়েছে সংকীর্ণতার বিপরীতে বৃহত্ব এবং কৃপণতার বিপরীতে উদারতার অবস্থান। এর সূত্রের ব্যঞ্জনা হলো, বিশ্ববিদ্যাকে বর্ণ, গোত্র, ধর্ম ইত্যাকার বিভাজন বা মানদণ্ডের উর্ধ্বে উঠতে হয়। সর্বমানবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত না হলে সে বিদ্যা বদ্ধ জলাশয়ের বিদ্যায় পরিণত হয়।
যে স্রোত ক্ষুদ্রতার মধ্যে ঘুরপাক না খেয়ে ক্রমশ বৃহতের উদ্দেশে যাত্রা করে আর সে-যাত্রায় পরিপাশ্বের যাবতীয় প্রতিকূলতা ও ঝুঁকিকে অতিক্রম করে সমুদ্রের বিশালতায় মিশে যেতে পারে সে স্রোতকেই আমরা বলি গতিশীল। বিশ্ববিদ্যাও তেমনিভাবে গতিশীল হয় বিবিধ প্রতিপক্ষতা ও ঝুঁকিকে মোকাবেলা করে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যার বিকাশের পথটি মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না এবং এখনও নেই।
বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবন সিনা’র দৃষ্টান্ত থেকে আমরা দেখবো আজীবন অত্যন্ত প্রতিকূল ও বৈরি পরিস্থিতিতে তিনি বিস্ময়করভাবে অসংখ্য বিষয়ে জ্ঞানচর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একা তিনি করে গেছেন বহুজনের কাজ। ইবন সিনা যেন অতীত ও ভবিতব্যের সেতুবন্ধের এক অসাধারণ উদাহরণ। হিপোক্রেটিস, এরিস্টটল, গ্যালেন, আল-ফারাবি প্রমুখের ধারণাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে প্রয়োজনে সেগুলোকে পরিমার্জিত রূপ দিয়েছিলেন তিনি।
আল-বিরুণি, ওমর খৈয়াম, ইবনে রুশদ, রেনে দেকার্তে, একুইনাস, উইলিয়ম অব ওকহ্যাম, আবু আল-জুজানি প্রমুখ প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর চিন্তা ও দর্শনের দ্বারা। একজন ব্যক্তিও যে কী করে এক মহাবিস্ময়ের ধারক হতে পারে তার প্রমাণ ইবন সিনা। তাঁর গ্রন্থ ‘কিতাব আল শিফা’ প্রসঙ্গে তাঁর প্রিয় শিষ্য জুজানি লিখেছেন, আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম শিফা গ্রন্থ রচনা শেষ করবার জন্যে।
তিনি আবু গালিবকে বললেন কাগজ-কলম আনতে। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম এবং ছিল তাঁর প্রতিকূলে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই দিনে ৫০ পৃষ্ঠা করে কেবল স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, প্রাণি ও উদ্ভিদবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখেন ইবন সিনা।
তাঁকে বন্দি করা হলো। কিন্তু জেলখানায় বসে তিনি লিখলেন আরও তিনখানা গ্রন্থ। পরে অবশ্য কারামুক্ত ইবন সিনাকে সম্রাট ইস্পাহানে উপদেষ্টা পদে বৃত করেন। প্রতিকূল-বৈরি অবস্থায় যদি না লিখে ইবন সিনা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতেন তাহলে তিনি নিজে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকতেন কিন্তু মানবকল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত জ্ঞান-বিদ্যা ও গবেষণাকে অতল অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকতেন মহাকালের প্রেক্ষাপটে।
একসময়ে বিদ্যা বলতে কেবল ঈশ্বরসংক্রান্ত বিদ্যা ও জ্ঞানকেই বোঝাতো। আড়াই হাজার বছর আগেকার গ্রিস দেশের জ্ঞানসাম্রাজ্যের বাস্তবতা সত্ত্বেও ধর্মই জ্ঞানজগতে রাজত্ব করে দীর্ঘকাল। সেই রাজত্বকে যখন বিজ্ঞান চ্যালেঞ্জ করে তখন কেবল নতুন ইতিহাসই রচিত হয় না বিদ্যা-জ্ঞান-গবেষণার ধারণাতেও আসে আমূল পরিবর্তন। বিজ্ঞান নিয়ে আসে নতুন জ্ঞান যে-জ্ঞান দীর্ঘকালের প্রচলন ও অভ্যেসের দেয়ালকে ফেলে সমূলে উপড়ে। বিজ্ঞানের চেতনা এমনকি প্রবলভাবে ধার্মিক খ্রিস্টবিশ্বাসীদের ভাবজগতেও জাগায় আলোড়ন।
আপনারা নিশ্চয়ই ইংরেজ পাদ্রী-দার্শনিক জন উইক্লিফের (১৩২০-১৩৮৪) কথা জানেন। তিনিই প্রথম বলেছিলেন যে-ল্যাটিন ভাষায় বাইবেল লেখা সে-ভাষা সাধারণ মানুষ বোঝে না। সেই বাইবেল ঘরে রেখে ফায়দা কী! কাজেই উইক্লিফ বললেন, প্রত্যেকে যাঁর-যাঁর মাতৃভাষায় বাইবেল অনুবাদ করুক, পুরোহিত নয় মানুষ নিজেই নিজের ভাষায় পাঠ করে জানুক ঈশ্বর তার জন্যে বাইবেলে কী সম্পদ রেখেছেন।
তাঁর অনূদিত (ম্যাথু, মার্ক, ল্যুক, জন সংবলিত) বাইবেল ‘উইক্লিফ বাইবেল’ নামে পরিচিত। বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে গেলে কথা ছিল না। কিন্তু উইক্লিফের অনুবাদ পরিণত হলো বিশ্ববিদ্যায় এবং তিনি স্বয়ং রূপ পরিগ্রহ করলেন বিশ^ব্যক্তিত্বে। ইংল্যান্ড থেকে বিদ্যা-জ্ঞান-গবেষণা পৌঁছে গেল চেকোস্লোভাকিয়ায়।
উইক্লিফের অনুবাদ কর্ম দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করলো জন হাস’কে (১৩৬৯-১৪১৫)। জন হাস মানুষকে বোঝালেন, আমরা সবাই খ্রিস্টান তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু আমরা কী কেবল ভ্যাটিক্যানের গলায় গলা মিলিয়ে গান গাইবো! হাস বোঝাতে চাইলেন, চেক জাতির স্বাতন্ত্র্যকে রোমান চার্চের ইচ্ছে-অনিচ্ছের মধ্যে সঁপে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি দায়বোধ থেকে তিনি বৃহত্তর চেক জাতীয়তার প্রয়োজনে ভ্যাটিক্যানের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার আহ্বান জানালেন চেকদের। কিন্তু এর পরিণাম হলো ভয়াবহ। হাসকে হত্যা করা হলো চক্রান্ত করে এবং এর পরিণতি হলো আরও ভয়ংকর। ১৫ বছর ধরে (১৪১৯-১৪৩৪) চললো রক্তক্ষয়ী হসাইট যুদ্ধ: হাসপন্থী ও হাসবিরোধীদের মধ্যে। বস্তুত এর শুরু হয়েছিল উইক্লিফের বাইবেল-অনুবাদ দিয়ে।
আর সে বাইবেল অনুবাদ ছেপে প্রকাশ করা হয়েছিল প্রেস থেকে এবং যদি না বিজ্ঞান প্রিন্টিং মেশিনের ধারণাকে বাস্তব করতে সম্ভবপর হতো তাহলে এসবের কিছুই হতো না। পরবর্তীকালে খিস্টধর্ম ভেঙে রোমান ক্যাথলিক থেকে প্রোটেস্ট্যান্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক-সমাজতাত্ত্বিকগণ উইক্লিফ ও হাসের জ্ঞানভাবনার ভূমিকাকেই পূর্বসূরীত্বের মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
উইক্লিফ-হাস হয়ে আমরা যদি সরাসরি রোমান দুনিয়ার রেনেসাঁ-ভুবনে প্রবেশ করি তাহলে আমরা দেখবো সেগুলোর ধারাবাহিকতায় মানবমনের ভাবনার সাগরে জাগিয়ে তুলছে প্রবল আলোড়ন। ১৪০০ থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত সময়টাকে ইতিহাস বৈজ্ঞানিক মানবতার কাল বলে অভিহিত করেছে। এই কালপরিধিতে স্বর্গবিদ্যা ও ঈশ্বরপ্রাধান্যকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গাটা দখল করে নেয় মানববিদ্যা এবং ইহজাগতিকতা।
মানুষের জ্ঞান ও বিদ্যা মানুষকে এমন ধারণায় উদ্দীপ্ত করলো, ঈশ্বর ও স্বর্গ সম্পর্কিত ধারণা গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই কিন্তু একটা বিপুল সময় মানুষকে কাটাতে হবে পৃথিবীর মধ্যে। কাজেই পৃথিবীতে বসবাসের কালটাকে অর্থপূর্ণ করে তোলা দরকার। রেনেসাঁ-যুগের মানুষের এমন ধারণার ফলে বিদ্যা-জ্ঞান ও গবেষণার জগতে সৃষ্টি হলো বিপ্লব।
রেনেসাঁ-কালের দু’জন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি পেত্রার্কে (১৩০৪-১৩৭৪) এবং বোক্কাচিও (১৩১৩-১৩৭৫) প্রতিনিধিত্ব করলেন নতুন ভাবনার। তাঁদের সেই ভাবনার পেছনে সবচাইতে বড় শক্তির উৎস হয়ে দেখা দিল সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞান। স্বর্গ ও ঈশ্বরবিদ্যার সমান্তরালে রেনেসাঁ-মানব বাছাই করে নিল মানববিদ্যার উপাদান।
মজার বিষয় এরও হাজার খানেক বছর আগে গ্রিস দেশে সেইসব বিদ্যারই চর্চা হয়েছিল এবং সে-কারণেই গ্রিস রেনেসাঁ বা পুনর্জন্ম লাভ করলো রোমে আর বিশ্ববিদ্যা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে প্রবলভাবে ধর্মভাবাপন্ন রোমান ক্যাথলিক রোম-সাম্রাজ্যে জাগিয়ে চললো একের পর এক ঢেউ। আপনারা ভাবতে পারেন, বিশ্ববিদ্যা জিনিসটা হয়তোবা বিমূর্ত কোনো বিষয় যেটিকে ঠিক আক্ষরিকভাবে ধরা মুশকিল। তা কিন্তু নয়। ১৫০৩ সালে গ্রেগরিয়াস রাইশ্ক্ (১৪৬৭-১৫২৫) এ-সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ও সুবিন্যস্ত ধারণা নিয়ে এলেন।
প্রাচীন গ্রিসে যেসব বিদ্যাচর্চাকে এককালে নাগরিক, সমাজ ও রাষ্ট্রের পারস্পরিকতায় বিবেচনা করা হতো রেনেসাঁ-মানব সেগুলোকেই উপস্থাপন করলো নির্দিষ্ট পরিকাঠামোয়। এ-বিদ্যার একটা নতুন শিরোনামও পাওয়া গেল ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ এবং জার্মানির ‘মার্গারিটা ফিলসফিকা’ নামের রাইশ্ক্-এর এ-গ্রন্থ সমগ্র ইউরোপে জ্ঞানচর্চাকে পৌঁছে দিল বহু দূর।
বইটি লেখা হয়েছিল ছাত্র এবং শিক্ষকের প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে। এবারে দেখা যাক কী কী বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল সে-গ্রন্থে ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা, অলংকার, গণিত, সংগীত (তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক), জ্যামিতি (তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক), জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, জীববিজ্ঞান এবং নৈতিক দর্শন।
আবার মৌলিক দু’টো মানদণ্ড দাঁড়ালো জ্ঞানচর্চার দিগন্তে ট্রিভিয়াম (ব্যাকরণ, অলংকার ও যুক্তিবিদ্যা) এবং কোয়াড্রিভিয়াম (গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সংগীত)। অর্থাৎ এতকাল স্বর্গ ও ঈশ্বরবিদ্যাকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো দেখা গেল মানুষের বিদ্যা তার তুলনায় অনেক বিশাল ও ব্যাপ্ত।
স্বর্গ ও ঈশ্বরের গুরুত্ব-ভাবনার চাইতেও এত বিচিত্র ও সূত্র বিষয় নিয়ে ভাবনার অবকাশ এসে গেল যে-সুযোগকে ধারণ ও অগ্রসরণ করবার কঠিন কাজটিকে কাঁধে নিল বিজ্ঞান। কিন্তু প্রথাগত মন এবং রক্ষণশীল কূপমণ্ডূক মস্তিষ্ক বিশ্ববিদ্যার ধারণাকে সহজেই জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। ফলে অনিবার্য হয়ে উঠলো দ্বন্দ্ব এবং বিবাদ। সেই দ্বন্দ্ব গড়ালো সংঘাত ও সংঘর্ষের দিকে। এমনকি এর পরিণামে বিশ্বের ইতিহাসে ঘটতে থাকলো একের পর এক তোলপাড়ের ঘটনা।
১৫৪৩ সাল বিশ্বের বিদ্যা ও জ্ঞানরাজ্যের জন্যে এক অনন্যসাধারণ উপলক্ষের নিয়ামক। দু’জন বিজ্ঞানীর দু’টো গ্রন্থ প্রচলিত ধ্যানধারণার জগতে নিয়ে এলো নতুন বার্তা। আন্দ্রিয়াস ভেসালিয়াস (১৫১৪-১৫৬৪) লিখলেন ‘দে হিউমানি কর্পোরিস ফ্যাবরিকা’ এবং নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) ‘দে রিভল্যুমনিবাস অরবিয়াম কোলেস্টিয়াম’।
যে-মানবদেহকে মনে করা হতো বিস্ময়করভাবে দুর্জ্ঞেয় এবং ব্যাখ্যার অতীত, যা কিনা একমাত্র ঈশ্বরের ইশারার নিয়ন্ত্রণাধীন ভেসালিয়াস সেই মানবদেহকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, প্রয়োজনে রেখা ও চিত্র এঁকে দেখালেন কীভাবে মানুষের শরীর এর কোষ, পেশি, রক্ত প্রভৃতি উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে কী কী নিয়মে চালু থাকে এবং কোথায় কীভাবে তার সমস্যা ঘটতে পারে।
আর পৃথিবী নামক গ্রহ এবং এর পরিপাশ্বক সম্পর্কে কোপার্নিকাস যে-জ্ঞানের সংবাদ দিলেন তাকে গ্রহণ করবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না বিশ্ব। কেননা, তাঁর একজনের মাথা থেকে নিষ্কাষিত চিন্তা-ভাবনা এক বিপুল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দিল কাঁপিয়ে ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের সত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো কোপার্নিকাসের ধারণা।
পরোক্ষভাবে যা দাঁড়ায়, শক্তিমান ঈশ্বর এবং তাঁর সৃষ্টির বিষয়ে যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত ভ্রান্তিকে উপস্থাপন করলেন তিনি। একদিকে ভেসালিয়াস এবং কোপার্নিকাস নামক দু’জন ব্যক্তির মস্তিষ্কজাত বিদ্যা ও জ্ঞান এবং অন্যদিকে প্রবল ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষ।
এ-প্রসঙ্গে আমরা সপ্তদশ শতকের একটি মজার ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। ১৫৯৮ সালে ইংরেজ ব্যবসায়ী স্যার থমাস গ্রেশাম প্রতিষ্ঠা করেন গ্রেশাম কলেজ। এখানে যেসব বিজ্ঞানী জ্ঞানচর্চা করতেন তাঁদের ‘গ্রেশাম ফিলসফার’ নামে ডাকা হতো। ১৬৬৭ সালে জনৈক ইংরেজের একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতার সন্ধান পাওয়া যায় যেটির চারটে লাইন ছিল এরকম:
Oxford and Cambridge are our laughter,
Their learning is but pedantry:
These collegiate do assure us,
Aristotle’s an ass to Epicurus.
হ্যাঁ, এটাকে হয়তো বিশ্ববিদ্যা ও বিজ্ঞানকে মেনে নিতে না পারা একজন ব্যক্তির মনোজগতের বিরাগ ও ক্রোধের বহিপ্রকাশ বলে মনে করা যেতে পারে কিন্তু তা যদি হয় বহুসংখ্যক ক্রুদ্ধ লোক কিংবা কোনো স্বেচ্ছাচারি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া তাহলে তার ফলাফলটিও হয় মারাত্মক। তেমন ঘটনা ঘটেছিল রোমান সাম্রাজ্যে যেখানে অন্ধকারকে হঠিয়ে আলোকের ব্যবস্থা করছিল রেনেসাঁ।
১৬৩২ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর গ্রন্থ ‘ডায়ালগ্স অন দ্য টু চিফ সিস্টেম্স্ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হলে বিশ্ব জানলো পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপার্নিকাস যা বলে গিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে চার্চ কিংবা রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষ যা-ই অপপ্রচার চালাক না কেন আসলে তিনি নির্ভুল ছিলেন।
সেটাই ইতালির গ্যালিলিও আরও সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করলেন। এর ফল কি হয়েছিল তা আপনাদের জানা। ‘ব্লাসফেমি’র অপরাধে কারাবন্দি করা হয়েছিল গ্যালিলিও গ্যালিলেইকে। তাঁকে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড এবং চার্চ তাঁকে বাধ্য করেছিল প্রকৃত সত্যের সন্ধানে মানবজাতিকে তিনি যে-জ্ঞানের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন সেটিকে মিথ্যে বলে স্বীকৃতি দেবার জন্যে। এ-ঘটনা ১৬৩৩ সালের। আপনারা দেখুন ১৯৯২ সালের ৩১ অক্টোবর- ঠিক ৩৫৯ বছর পরেকার ঘটনা।
ভ্যাটিক্যান চার্চের সর্বময় প্রধান পোপ জন পল স্বীকার করলেন যে হ্যাঁ, গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর প্রতি তাঁর পূর্বসূরীরা খানিকটা রূঢ় আচরণ করেছিলেন। এর সরল মানে হলো অনেক অনেক বছর পওে হলেও বিশ্ববিদ্যা ও জ্ঞানের নিকটে, বিজ্ঞানের প্রকৃত অবস্থানের নিকটে পরাভব মেনে নিলেন বিশাল কর্তৃপক্ষের বিরাট প্রতাপশালী শক্তিধর।
জর্ডানো ব্রুনো’র (১৫৪৮-১৬০০) পরিণতির ঘটনাটিও এখানে উত্থাপনযোগ্য। তাঁর মনন ঋদ্ধ হয়েছিল ধর্ম, দর্শন, গণিত, কাব্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের আলোকনে। পৃথিবীর অবস্থান, গতি প্রভৃতি বিষয়ে নতুন জ্ঞানের সন্ধান দেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই জ্ঞানের আলোকে সহ্য করতে পারে নি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। ১৫৯৩ সালে তাঁকে ‘ব্লাসফেমি’র দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
বেচারা ব্রুনো পালিয়ে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশে। শেষে এক শত্রুর বন্ধুছদ্মবেশের ফাঁদে পা দেন তিনি এবং তাঁকে বন্দি করা হয়। ১৬০০ সালে বিদ্যা-জ্ঞান-বিজ্ঞান এইসবের অসাধারণ অবদানের জন্যে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হলো আগুনে। তবে পৃথিবী আজ ব্রুনোকে স্মরণ করে ‘বিজ্ঞানের শহিদ’ হিসেবে। তাঁর নামে গড়ে তোলা হয়েছে মনুমেন্ট।
১৬৪৪ সালে মহাকবি মিলটন তাঁর ‘এ্যারিওপ্যাজিটিকা: এ স্পিচ ফর দ্য লিবার্টি অব আনলাইসেন্সড্ প্রিন্টিং, টু দ্য পার্লামেন্ট অব ইংল্যান্ড’-এ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে যে-বাণী প্রচার করে যান সেটি বিশ্ববিদ্যা ও বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে আজও প্রাসঙ্গিক। কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, জার্মানির মার্টিন লুথার এঁদের মত সকলের জন্যেই প্রাসঙ্গিক। একটা অসাধারণ কথা বেরিয়ে এসেছিল মিলটনের কণ্ঠ থেকে: Constructive criticism is better than false flattery
যাঁরা বিশ্ববিদ্যা ও বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক তাঁরা এই কাজটাই করতে চেয়েছিলেন। মিলটন বলেছিলেন, বিদ্যা এবং জ্ঞানকে মোকাবেলা করতে হবে একমাত্র বিদ্যা এবং জ্ঞান দিয়েই। তা নাহলে বিদ্যা এবং জ্ঞানের স্রোত সমুদ্রে না গিয়ে বদ্ধ ডোবায় পরিণত হবে। ইবন সিনা তাঁর ‘শিফা’ গ্রন্থে এরিস্টটলের যৌক্তিক সমালোচনা করে, তাঁকে বাতিল করে না দিয়ে সন্ধান দেন নতুন জ্ঞানের। আল রাজী (৮৫০-৯২৪) তাঁর ‘কিতাব’ গ্রন্থে গ্রিক গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞানকে দেন নতুন মাত্রিকতা। এবং এভাবেই ব্রুনো, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও হয়ে এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যা।
মিলটন তাই বলেছিলেন, আপনাকে সবকিছুই পড়তে হবে, এমনকি যাকে খারাপ বই বলছেন তা-ও পড়ে দেখতে হবে। তা নাহলে তার চাইতে কোন্টি ভাল সেটা তুলনা করে বের করা যাবে না। বস্তুত এরও এক হাজার বছর আগে এমন কথাই বলেছিলেন এরিস্টটল।
এ-বিশ্ববিদ্যাই ঔপনিবেশিক কালে এসে পৌঁছায় ভারতবর্ষে।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা দখলের সময় থেকে ১৮৫৭ সাল তথা সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত এই একশত বছর গ্রেট বৃটেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয় পড়ানো হতো সেগুলো একনজর দেখা যাক: গণিত, ক্ল্যাসিক্স, নীতিবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, আইন, ইতিহাস, ধর্মবিদ্যা, সেমিটিক ভাষা, ভারতীয় ভাষা, মধ্যযুগীয় ভাষা, আধুনিক ভাষা, প্রাচ্যভাষা, অর্থনীতি, ধাতুবিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, রাসায়নিক প্রকৌশল, স্থাপত্য, চারুকলা, বিদ্যুৎবিজ্ঞান, কৃষি, দর্শন, চারুকলার ইতিহাস, কম্প্যুটার সায়েন্স, শিক্ষা, যোগাযোগ, ব্যবসাপ্রশাসন প্রভৃতি। পরবর্তী আরও একশত বছরের ব্যবধানে এসব বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় পাবলিক হেল্থ্ (১৮৭৫), ফরেস্ট্রি (১৯১২), পুষ্টিবিজ্ঞান (১৯৬৮), ল্যাটিন আমেরিক্যান স্টাডিজ (১৯৭২), জেনেটিক্স (১৯৭৫) এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (১৯৮২) ইত্যাদি। কোম্পানি শাসনামলে ভারতবর্ষে কোম্পানি স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হতো সে-বিষয়ে লক্ষ করা যাক।
১৮৪০-৫০ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অনুসারে সেটা বলা যায়। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, জ্যামিতি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার সাহিত্য, নীতিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ক্যালকুলাস, মেকানিক্স, অর্থনীতি, দর্শন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, উর্দু সাহিত্য, হিন্দি সাহিত্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, পদার্থ, রসায়ন, জীব-প্রাণিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়। মোটকথা বৃটেন ও ভারতবর্ষে প্রায় একইরকমের বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত ছিল পাঠ্যসূচিতে।
তবে ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত কোম্পানি আমলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মিশনারিদের খ্রিস্টধর্মসম্পর্কিত তৎপরতা ছিল স্পষ্ট। অন্যদিকে ১৮৫৮ সাল থেকে অর্থাৎ কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে যাওয়ার পরবর্তীকাল থেকে মিশনারি নয় বরং ধর্মীয় নিরপেক্ষতার ভূমিকায় অনড় ছিল ব্রিটিশ সরকার। এসব বিষয়ে লেখাপড়া করেছিলেন উনিশ শতকের রেনেসাঁপরিপুষ্ট ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের প্রায় সকলেই।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, চিত্তরঞ্চন দাস, নেতাজী সুভাষ বসু এরা সকলেই মোটামুটি এসব বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন ব্রিটিশশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
কিন্তু যেসব বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না সেগুলো হলো স্বদেশপ্রেম, স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা, সামাজিক বৈষম্যের প্রতি ক্ষোভ-প্রতিবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রোহ প্রভৃতি। একই বিদ্যা ও জ্ঞানের চর্চা হয়েছিল বৃটেন ও ভারতবর্ষের শিক্ষায়তনে কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভিন্ন চারিত্রে অনূদিত হয়ে বেরোয় দুই বিভিন্ন গোলার্ধে।
মধুসূদনের রাবণ-বিভীষণে আমরা দেখলাম স্বদেশের করুণ বন্দিদশার কাহিনি, বঙ্কিমের ‘সাম্য’ প্রভৃতি প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসনের নেতিবাচকতা বিষয়ে দর্শন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এমনকি বিলাতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে আসা চিত্তরঞ্জন দাশ আইন লড়াইয়ে নামছেন ব্রিটিশদেরই বিরুদ্ধে।
নেতাজি সুভাষ বসুসহ কারারুদ্ধ বহু বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বের পক্ষে লড়েছিলেন তিনি। আর স্বয়ং নেতাজি ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই তিনি জ্বালিয়ে দিলেন আগুন। তাই বলা যায় বিশ্ববিদ্যার বিকাশ যেখানেই ঘটুক না কেন একে কোনো স্থানীয়তার পরিসীমায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না।
১৮২৭ সালে ফ্রান্সিস প্লেস ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’-এর জার্নালে লেখা এক প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কয়লাখনির শ্রমিকেরাও কী তাদের পিতা-পিতামহদের মত শ্রমিক হবে? পরবর্তীকালে সেই প্রশ্ন গভীর-গভীরতর বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে জাগরণ ঘটায় উদার মানবিক চিন্তাধারার।
মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রকেই বাধ্য হতে হয়েছিল তার চরিত্র পরিবর্তন করবার জন্যে। গোটা জার্মানিকে অনূদিত বাইবেলের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করে নতুন প্রেরণার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন মার্টিন লুথার। রাণি হয়েও অষ্টম হেনরির কন্যা এলিজাবেথ ভ্যাটিক্যানের দর্পিত ভূমিকার বিপরীতে হাল ধরেছিলেন প্রোটেস্ট্যান্টানিজমের।
বিশ্ববিদ্যার উদ্ভব যেখানেই হোক না কেন তা বিশ্বজনের সম্পদে পরিণত হয়। মানুষ তার জন্মসূত্রের সীমাবদ্ধতায় একটি ক্ষুদ্র কেন্দ্র ও পরিধির সীমানায় পরিবেষ্টিত থাকলেও তার মন ও মননের চারপাশে থাকে না কোনো ঘেরাটোপ বা পরিবেষ্টনী।
সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই হয়ে উঠতে পারে তার চেতনার অন্তর্গত। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই শুরু হরো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বাংলায় তখন ঘোর বর্ষাকাল। কোথায় কলকাতার জোড়াসাঁকো আর কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ইউরোপ।
এক সপ্তাহের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতাটি যেখানে তিনি বলছেন প্রচণ্ড প্রতিকূলতা আর গাঢ় অন্ধকার সরিয়ে তীরে তরি ভেড়াবেন তাঁর মাঝি। যদি প্রশ্ন করা হয় তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক কবি নজরুলের কে যে তাঁকে নিয়ে ‘কামাল পাশা’ কবিতা রচনা করতে হবে বিদ্রোহী কবিকে।
কিংবা ধরা যাক দক্ষিণ আফ্রিকায় বেঞ্জামিন মলয়ঁসি নামের কোনো এক কবিকে ফাঁসি দেওয়া হলে বাংলা ভাষায় সেই অচেনা কবির জন্যে রচিত হতে থাকে শত-শত পংক্তি। কারারুদ্ধ নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে ওঠেন ভিন্ন দেশ ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠিরও নেতা।
বিশ্ববিদ্যার অনুশীলন মানবচেতনার জগতে এভাবেই ঘটায় পরিশীলন এবং তার উত্তরাধিকারও তাই প্রবহমান থাকে প্রজন্ম-পরম্পরায়। ‘পিউনিক ওয়্যার’ সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রোমানদের সঙ্গে কার্থেজিয়দের। কিন্তু তার ইতিহাস অধ্যয়ন করছে সারা বিশ্ব।
একসময়ে গ্রিস দেশের লোকেরা তাদের নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে লেখাপড়া করতো শিক্ষায়তনে। তারপর তাদের সঙ্গে পারস্য দেশের যুদ্ধ বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো সারা বিশ্বের পাঠ্য বিষয়।
সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি আমরাও। বর্তমানে বিশ্বকে আমরা বলছি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। রোমের রেনেসাঁ ইউরোপবাহিত হয়ে দূর থেকে আরও দূরে পৌঁছাতে সময় লেগে যেতো বহু-বহু যুগ। কিন্তু এখন সারা বিশ্ব বলতে গেলে সমধর্মী বিদ্যা-জ্ঞান-গবেষণার অনুবর্তী। এখন এক দেশের বিদ্যা খুব কম সময়েই পরিণত হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশের মনন-সম্পদে। প্রাচ্যের জ্ঞান মুহূর্তে পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রতীচ্যে।
ধরা যাক আমাদের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি’র কথা যা বিশ্ববিদ্যার অন্তর্গত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে এবং বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের সূত্রে তা সঞ্চার ঘটাচ্ছে নতুনতর চেতনার। রোমানদের পিউনিক যুদ্ধের কথা বলা গেল।
রাশিয়ার ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয় সারা বিশ্বের বিদ্যা-জ্ঞান ও গবেষণার সাম্রাজ্যের মূল্যবান উপাদান। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করা যায়, বিশ্ববিদ্যার আয়তনে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান কোথায়। সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিসত্তার উত্থানের এমন ট্র্যাজিক এবং বীরোচিত, রক্তাক্ত এবং গৌরবময় কাহিনি সুদুর্লভ।
আমাদের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘকাল আমাদের প্রকৃত ইতিহাসকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। যেখানে গ্রিস-রোমের মানুষেরা তাদের স্থানীয় যুদ্ধের ইতিহাসকে বিদ্যাজগতের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছিল নিজেদের ভবিষ্যতের প্রগতির ভাবনার নিরিখেই সেখানে আমরা কেন আমাদের এমন অহংদৃপ্ত যুদ্ধ-ইতিহাসকে স্থানীয় বিদ্যা-জ্ঞান-গবেষণার বিষয়ে পরিণত করতে পারি নি।
আসলে এর উত্তর কারও অজানা নয়। যে-সময়টাতে আমাদের জাতীয় ইতিহাস কলঙ্কতিলককে মুকুটে পরিণত করেছিল তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা মানে বাঙালির বীরত্ব ও গৌরবের গাঁথার স্মরণ, তখন ইতিহাসচর্চা মানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও সংগ্রামের অধ্যয়ন, তখন ইতিহাসচর্চা মানে বঙ্গবন্ধুর দর্শনে সমুখে চলার নির্দেশনা। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাইরের মানুষ নয় এ-দেশের এক শ্রেণির মানুষই এমন ভয়ংকর অপরাধ সংঘটনকারী।
এর ফলে আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ও অবলম্বন। আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মহাকাব্যিক উপাখ্যানের বহু সাক্ষী ও কথককে যাঁদের অবদানে আমরা সমৃদ্ধ করতে পারতাম আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশত বছর এবং জাতির জনকের শতবছর পূর্তি অতিক্রান্ত বাঙালি জাতি তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিদ্যা-জ্ঞান এবং গবেষণাকে নিঃসন্দেহে পরিণত করতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বিষয়বস্তুতে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত-এত নতুন বিষয়ের বিভাগ খোলা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো বিভাগ আজও কোথাও উদ্বোধিত হলো না। দেখুন একদিন বাংলাদেশ স্টাডিজ সম্পর্কিত চর্চা শুরু হয়েছিল সুদূর নেদারল্যান্ডে। আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবি নি, এটা ছিল আমাদেরই মনোযোগের বিষয়।
আমরা ভুগেছি হীনমন্যে এবং আমরা কাল কাটিয়েছি ষড়যন্ত্রে। সুখের বিষয় আজ ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামক বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নের বিষয়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। আমরা যতই ভাবি না কেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরই নিজস্ব বিষয় তা কিন্তু নয়, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এবং সারা বিশ্বের বিষয়, তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আজ বিশ্ববিদ্যার অন্তর্গত।
আমরা নিশ্চয়ই একথা মনে রাখি, বাঙালি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখন্ডের সৃষ্টি করেছিল পরাধীন জাতিকে স্বাধীন করবার জন্যেই শুধু নয়, অনন্ত ভবিতব্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের বাঙালিকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত রাখতে। বাঙালি চিরকাল এই বোধে সদাজাগ্রত থাকবে, একটি জাতির জীবনে এমন মুক্তিযুদ্ধ বার-বার আসে না, আসে একবারই।
**চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের (১৮ অক্টোবর) অনুষ্ঠানে পঠিত প্রবন্ধ।
ড. মহীবুল আজিজ, প্রফেসর বাংলা বিভাগ, ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, কবি-কথাশিল্পী