রাবিতে প্রক্সির টাকার জন্য ভর্তিচ্ছুকে ছাত্রলীগের অপহরণ
ভর্তি পরীক্ষায় চুক্তি অনুযায়ী প্রক্সির পুরো টাকা না দেওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে আসা আহসান হাবীব নামে এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগের সেই নেতাকর্মীরা আহসান হাবীবকে অপহরণ করে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলে নেয়ার পর সে শিক্ষার্থীর মায়ের অভিযোগের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে শেরে বাংলা হল প্রাধ্যক্ষের সহযোগিতায় অপহরণকৃত ওই শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির কথা স্বীকার করায় তাকে নগরীর মতিহার থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর।
এদিন রাতেই নগরীর মতিহার থানায় ছেলেকে অপহরণ ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করে আহসান হাবীবের মা রেহেনা বেগম বাদী হয়ে একটি এবং ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলায় দায়ের করেন।
মামলার এজাহার অনুযায়ী রেহেনা বেগমের দায়ের করা মামলায় আসামিরা হলেন- মুশফিক তাহমিদ তন্ময় (২৪), প্রাঙ্গন (২২,) সাকিব (২৪) এবং রাজুসহ (২৩) অজ্ঞাত আরও দুই-তিনজন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মামলায় এরাসহ জালিয়াতির করে ভর্তি হওয়া আসামি আহসান হাবীব (১৯) কে আসামি করা হয়। এই মামলায় আহসান হাবীবকে আটকের পর গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াতির করে ভর্তি হওয়া আসামি আহসান হাবীবের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার খষ্টি গ্রামে। তিনি 'সি' ইউনিটের গ্রুপ-৩-তে জালিয়াতি করে পরীক্ষা দিয়ে ৯৯৪ তম হয়েছিলেন। অন্যদিকে আসামি মুশফিক তাহমিদ তন্ময় রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এর আগেও, প্রক্সিকাণ্ডের মূলহোতা হিসেবে তন্ময়ের নাম উঠে এসেছিল গণমাধ্যমে। এর প্রেক্ষীতে গতবছরের ৪ আগস্ট দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তন্ময়কে বহিষ্কার করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তিনমাস পরে অবশ্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছিল। বর্তমানে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি করছেন তিনি। আরেক আসামি রাজু আহমেদ শেরে বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী, এছাড়া শাকোয়ান সিদ্দিক ওরফে প্রাঙ্গণ শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তবে, আসামি সাকিবের বিস্তারিত পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
পৃথক দুই মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটার দিকে আহসান হাবিব সংশ্লিষ্ট বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য তার মা মোছা. রেহেনা বেগমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান ভবনে আসে। ভর্তি হওয়ার পর ভবনের বাইরে আসলে দুপুর পৌনে তিনটার দিকে অজ্ঞাতনামা ৪ থেকে ৫ জন ব্যক্তি তাকে কৌশলে অপহরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের ৩য় তলায় নিয়ে আটক করে রাখে।
সেখানে অপহরণ কারীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আহসান হাবীবের বাবার নিকট ফোন করে তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এদিকে আহসান হাবিবের মা দীর্ঘক্ষণ যাবৎ তার ছেলের কোন সংবাদ না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। পরে প্রক্টরিয়াল বডির লোকজনের সহায়তায় আহসান বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে শের-ই-বাংলা হল থেকে উদ্ধার করে প্রক্টর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে তারা আহসান হাবিব'কে গোয়েন্দা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করে।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, পুলিশের সহায়তায় আহসান হাবীবকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে যে, সে নিজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে পলাতক আসামিদের সহায়তায় অপরের দ্বারা প্রক্সি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এজন্য পলাতক আসামি প্রাঙ্গন এর সাথে চার লক্ষ আশি হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় তার। বৃহস্পতিবার সকাল দশটার দিকে রাজশাহী রেল স্টেশনের সামনের রাস্তায় চুক্তির নগদ ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ও ৬০ হাজার টাকার চেক প্রদান করে। ভর্তি হওয়ার পর বাকী টাকা প্রদান করবে বলে অঙ্গীকার করে ভর্তি হয়। ভর্তি হওয়ার পর বাকি টাকা না দেওয়ায়, অপহরণকারীগণ তাকে অপহরণ করে শেওে বাংলা হলে নিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং বাকী টাকা না দিলে ধারালো ছুরি দেখিয়ে খুন করার ভয় দেখায়।
এ বিষয়ে জানতে শাখা ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময় এবং শাকোয়ান সিদ্দিক ওরফে প্রাঙ্গণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ঘটনাস্থলে থাকা শেরে বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, প্রাঙ্গণ ও সনেট ওই ছাত্রকে নিয়ে আমার হলে আসেন। তারা জানায় এই ছেলে প্রক্সি দিয়ে ভর্তি হয়েছে। এর নিকট চুক্তির টাকা পাব। সেটা তোলা লাগবে। তখন তারা ওই শিক্ষার্থীর বাড়িতে ফোন দিয়ে তিন লাখ টাকা দাবি করে। এব্যাপার প্রক্সি কিংবা চাঁদার ব্যাপারে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই।
জালিয়াতি করে মেধাক্রমে আসার পর কিভাবে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রমও সম্পন্ন করতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম মোল্লা বলেন, আমি এ বিষয়ে অবগত নই। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে তথ্যটি জানলাম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিট থেকে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। এজন্য আমি কিছু বলতে পারব না।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সি’ ইউনিটের সমন্বয়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক শাহেদ জামান বলেন, এ বিষয়ে আসলে আমাদের আইটি সেক্টরে যারা কাজ করছেন, তারা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাছাকাছি চেহারা হওয়ার জন্য হয়ত তারা ধরতে পারেনি। এরকম আরও বেশকিছু জালিয়াতির বিষয় তারা কিন্তু শনাক্ত করেছে। এটা কিভাবে মিস হয়ে গেল আমার জানা নেই। তবে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তার ভর্তিও অবশ্যই বাতিল হবে।
এদিকে মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, এ ঘটনায় গতকাল আটককৃত আহসান হাবীবকে প্রক্সি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বাকি আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলাগুলো ডিডি তদন্ত করছে। তারা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা যখন হয়ে যায় তখন আমরা সেই মামলার সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সে পর্যন্ত আমরা তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে রাখি। এই মামলায় তদন্তের পর জড়িত সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। আর আমরা এবারে এমন ঘটনাগুলোতে সরাসরি মামলা করেছি। যেটা এর আগে করা হত না। ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকা হত। ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করত, আর তারা ছাড়া পেয়ে যেত। কিন্তু আমরা একদম শেকড়ে হাত দিতে চাই। এজন্য আমরা গোটা জিনিসটাকে বের করার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে গেছি।