প্রক্টর পদে যোগ্য কাউকেই চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ উল হাসান। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা কর্মকাণ্ডে হয়েছেন আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত। এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার পদত্যাগের দাবি তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ধর্ষণকাণ্ডে এই দাবি আরও প্রগাঢ় রুপ নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের পুনর্মিলনীতে অ্যাম্বুলেন্সে করে মদ আনা ও ওই অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় এক নারীর গর্ভপাত এবং এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত যৌন নিপীড়নের অভিযুক্ত শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে করা অভিযোগের ঘটনায় ভুক্তভোগীকে দিয়ে জোরপূর্বক দায়মুক্তিপত্র লেখানো, প্রক্টরের দায়িত্বকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মাদকের অবাধ সিন্ডিকেট তৈরি এবং সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বহিরাগত নারী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা অভিযোগ এনে গত ১ মাস ধরে ফিরোজ উল হাসানকে প্রক্টরের পদ থেকে অব্যাহতির দাবি জানিয়ে আসছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
প্রক্টরের অপসারনের দাবি যে শুধু আন্দোলনকারীরাই করে আসছে এমনটা নয়। বর্তমান প্রশাসনপন্থী অনেক শিক্ষকও এই পদে নতুন মুখ দেখতে আগ্রহী। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় গত সপ্তাহে টানা ৩ কর্মদিবস প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিনব্যাপী অবরোধ করে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। টানা অবরোধে স্তিমিত হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম, একপর্যায়ে প্রক্টরের পদে নতুন কাউকে আসীন করার আশ্বাস দেন উপাচার্য।
আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা যায়, উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম আশ্বাস দিয়েছেন ১৮ মার্চ দুপুরের মধ্যে বর্তমান প্রক্টর হয় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে অব্যাহতি দিবেন।
এদিকে নতুন প্রক্টর নিয়োগের বিষয়টি সামনে আসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-জল্পনা-কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রক্টর কে হচ্ছেন এমন প্রশ্ন এখন সকলের মুখে? ইতোমধ্যে এই পদে নতুন নিয়োগের সম্ভাব্য তালিকায় উঠে এসেছে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নাম। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই পদে আসীন হওয়ার আশায় জোর প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন অনেক শিক্ষক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান। তিনি নিকট অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও পরিবহণ অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া সম্প্রতি সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
তালিকায় আরও রয়েছেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আওলাদ হোসেন। তিনি ইতঃপূর্বে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে পরিবহণ অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন। এই অধ্যাপককে প্রক্টর পদে নিয়োগের জন্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামূল কবির জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে কয়েকজন শিক্ষক নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া তালিকায় এগিয়ে আছেন স্ট্যাটিস্টিকস এন্ড ডাটা সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর কবির। তিনি ইতোমধ্যে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া রেজিস্ট্রার অফিস ও উপাচার্য কার্যালয়ের কয়েকটি সূত্র থেলে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগ পেতে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন সিকদার, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সিকদার জুলকারনাইন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রৌফ শৈবালসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধান রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এই পদটিতে সৎ, যোগ্য, গতিশীল ও সাহসী কাউকেই প্রত্যাশা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে গঠিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজুল ইসলাম মেঘ বলেন, ‘আমরা প্রক্টর হিসেবে ক্লিন ইমেজের একজনকে চাই। ফিরোজ স্যারের মতো জেল খাটা ও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের অভিযুক্ত কাউকে নয়। যিনি সৎ, সাহসী এবং যেকোনো চাপে ভয় পায় না এরকম প্রক্টর আমরা চাই।’
কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘প্রথমত এই পদে ছাত্র-বান্ধব ব্যক্তি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত ক্যাম্পাস মাদকে ভরে গেছে। প্রক্টর নানাভাবে মাদকমুক্ত করতে পারেন। এমন ব্যক্তি প্রয়োজন যিনি ক্যাম্পাসটাকে ভালো রাখবেন। ক্যাম্পাসে যা কিছুই ঘটে তা প্রক্টরের নজরে আসে। যারা ইয়াং, অনেস্ট, ডায়নামিক ও ক্যাম্পাসটাকে ভালোবাসে এমন ব্যক্তিকে পদে আসীন করা হোক। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও তাকে সহযোগিতা করার মনোভাব থাকতে হবে।’
জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নুহু আলম বলেন, ‘পুরোপুরি শিক্ষার্থী বান্ধব একজন শিক্ষক প্রক্টর হবেন এটাই আমার চাওয়া। যিনি দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করবে এবং যার প্রতি সকলের সহমর্মিতা, সহানুভূতি থাকবে এমন ব্যক্তি ও প্রশাসন আমার চাওয়া।’
নতুন প্রক্টর নিয়োগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে উপাচার্যের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।