ডিবি অফিসে মিম, যা জানালেন অভিযুক্ত জবি শিক্ষকরা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিমকে যৌন হয়রানি ও হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগে বুধবার (২০ মার্চ) সকালে অভিযুক্ত দুজন শিক্ষককে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয় ।
এর আগে, সোমবার (১৮ মার্চ) নিজ বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও হত্যার হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম। নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ডিবি কার্যালয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে কাজী ফারজানা মিম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। তাই ডিবি কার্যালয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছি। ডিবি কার্যালয়ে তারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। আমি উপযুক্ত প্রমাণসহ আমার বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। অভিযুক্তরাও তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। তবে ডিবি স্যারের আমার প্রমাণাদি সঠিক বলে মনে হয়েছে বিধায় তারা আমার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযুক্তদের থেকে লিখিত অঙ্গীকারনামা নিয়েছেন কি না, জানি না। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে অবশ্যই লিখিত অঙ্গীকারনামা থাকা উচিত।’
বুধবার (২০ মার্চ) ডিবি কার্যালয়ে অভিযুক্ত দুই শিক্ষক ও অভিযোগকারী মীমকে মুখোমুখি করে উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।
মিমের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত দুজন শিক্ষককে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা।
অভিযোগের বিষয়ে দীর্ঘ ফোনালাপে অভিযুক্ত শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘২০১৯ সালে একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমার ক্লাসে তাকে একদিন আমি বকা দিয়েছিলাম। সেই ক্ষোভ থেকেই সে প্রতিশোধ-প্রবণ হয়ে উঠে। কিন্তু মিম ২০১৯ সালে অভিযোগ না দিয়ে ২০২২ সালে এসে কাল্পনিক অভিযোগ দেয়; যার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।
তিনি আরো বলেন, মিমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে যখন তদন্ত কমিটি গঠন হয়, সেখানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির শিকার হই। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে আমাকে বার বার দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর ফলে আমি সুষ্ঠু বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে যাই। উচ্চ আদালতে আমার বিপক্ষে কোনো যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সে মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। নিষ্পত্তি হয়নি এমন কোনো বিষয় নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলা ইমম্যাচিউর ব্যক্তির কাজ; যেটা মিম করেছে।
নিজের সম্মানহানির বিষয় উল্লেখ করে বলেন, কাল্পনিক একটি অভিযোগের মাধ্যমে আমার সম্মানহানি করা হচ্ছে, আমাকে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। মেয়েটি এতদিন চুপ থাকলো। এখন যখন নতুন একটি ইস্যু সামনে এসেছে সেটার এডভান্টেজ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। অবন্তিকার মৃত্যুতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন শক্ত অবস্থানে আছে, তখন সে এই পরিস্থিতিতে সুযোগে সৎ ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
যৌন নিপীড়ন একটি জঘন্য অপরাধ উল্লেখ করে শাহেদ ইমন বলেন, যৌন নিপীড়ন একটি জঘন্য ও ঘৃণিত অপরাধ। আমিও চাই যারা এই ঘৃণিত অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বিচার হোক। আমি যদি আদালতের বিচারে দোষী প্রমাণিত হই তবে আমারও শাস্তি হোক।
ডিবি অফিসে তলবের বিষয়ে বলেন, মিমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিবি প্রধান আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমরা যথা সময়ে উপস্থিত হই। সেখানে মিমের বাবাও ছিলেন। ডিবির দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা আমাদের থেকে যা যা তথ্য চেয়েছেন আমরা সবকিছুই দিয়েছি। বাকিটা তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন।
অভিযোগের বিষয়ে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমদ হালিম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, মেয়েটি ক্লাস-পরিক্ষায় অনিয়মিত ছিল। সে আমার একটি কোর্সের ৩ ঘণ্টা করে ১০ টা ক্লাসের মধ্যে ৩ টা ক্লাসে উপস্থিত ছিল। ফলে সেখানে সে ৩ মার্ক পেয়েছে। এরপর ২ টি মিড সেমিস্টার ও একটি এসাইনমেন্টে ৩০ এর মধ্যে ২০.৫ পেয়েছে। মোট হিসাব করলে কন্টিনিউয়াস এসেসমেন্টে ৪০ এর মধ্যে ২৩.৫ পেয়েছে। আর ৬০ মার্কের লিখিত পরিক্ষায় সে অংশগ্রহণই করে নি। ফলে সেখানে সে শুন্য পেয়েছে। যেহেতু ১০০ তে ৪০ মার্ক পেলে পাশ হয়ে সেখানে সে পেয়েছে ২৩.৫ যা ফেল হিসেবে গণনা হয়েছে। আর এগুলো তো সফটওয়্যারের কাজ। আমরা তো শুধু মার্ক পাঠিয়ে দেই। বাকি কাজ তো পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী একটা কোর্সের পরিক্ষা ২ জন শিক্ষক থাকেন পরিক্ষার খাতা পর্যবেক্ষণের জন্য। একজন ফেল দিলেও অন্য শিক্ষক তো আর ফেইল দিবেন না। আবার মার্কের ব্যবধান যদি ২৫ শতাংশের বেশি হয় তখন খাতা চলে যায় ৩য় শিক্ষকের হাতে। ফলে এখানে ইচ্ছা করে ফেল করানোর কোনো সুযোগ নেই।
ভাইবা তে মিমের ফেল করার বিষয়ে তিনি বলেন, ভাইবা বোর্ডে আমিসহ ৩ জন শিক্ষক ছিলাম। আমরা যা মার্কিং করি তার এভারেজ করে মার্ক দেওয়া হয়। সেখানে সে একটি প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেনি। ফলে সকল শিক্ষকদের মার্ক এভারেজ করেও তাকে পাশ করানো যায়নি। ফলে সে ফেল করেছে।
ফাতিমা আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ফাতিম আমিনের কোর্সে মিম নিয়মিত ক্লাস করেনি। আবার তাকে ৩ বার সুযোগ দেওয়া হলেও সে মিড সেমিস্টার পরিক্ষা দেয়নি। এবং সে ফাইনাল এক্সামেও বসেনি। তাই সে ফেল করেছে। নিজের দোষে ফেইল করে সে ফাতিমা আমিনকে যৌন নিপীড়নের সাহায্যকারী বানিয়ে দিয়েছেন, যার কোনো সত্যতা নেই।
দুই শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, দু'পক্ষকে আমরা ডেকেছি, তাদের বক্তব্য শুনেছি। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফারজানা মীম আমাদের কাছে আবদার করেছেন যে তিনি যেন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারেন। আমরা তার আবদারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিষয়টি শিক্ষকদের বলেছি।
তিনি আরও বলেন, এরপরও যদি কেউ হুমকি বা ভয়-ভীতি করে, তাহলে মিমকে বলা হয়েছে তিনি যেন আমাদের ডিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তৎক্ষনাৎ জানান। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।
যৌন হয়রানির বিষয়ে ডিবি প্রধান বলেন, এটি আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ হলে পরে জানাতে পারব।
ডিবি প্রধান আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিষয় সমাধান করা আমাদের কাজ নয়। মিমকে ফেল করানোর বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখবে। তবে তাকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশ দেখবে। আইনশৃংখলা বা ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিষয়ে সমাধানের এখতিয়ার পুলিশের নেই।