আলপনা ও দেয়ালচিত্রকে টিকিয়ে রাখতে রাবি অধ্যাপকের গবেষণা

  • রাবি করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আলপনা ও দেয়ালচিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে গবেষণা চালিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক অধ্যাপক ও তার গবেষক দল। বিগত দুই বছর যাবৎ রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলায় ‘রাজশাহী বিভাগের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের আলপনা ও দেয়ালচিত্র : বিষয় ও আঙ্গিক’ শীর্ষক এই গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেন তারা।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনুদানে পরিচালিত এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সোবাহান। এছাড়া প্রকল্পে সহযোগী গবেষক ছিলেন আসাদুল্লা সরকার ও সহকারী গবেষক ছিলেন চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষার্থী লাবু হক।

বিজ্ঞাপন

এই গবেষক দলের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আলপনা ও দেয়ালচিত্র অংকনের শিল্পটি গুটি কয়েক নৃগোষ্ঠী পরিবার ধরে রাখলেও অংকনশৈলীতে এসেছে নানা পরিবর্তন। প্রাকৃতিক রং থেকে দূরে সরে তারা ব্যবহার করছেন বাজারের কেনা রং। অনেকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় চিত্রপটে আর ফুটিয়ে তুলছেন না নিজেদের সংস্কৃতিকে। দ্রুত নগরায়নের ফলে দেশের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইতোমধ্যে বিলুপ্তির পথে।

জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলার গোদাগারী ও তানোরে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে, নওগাঁর নিয়ামতপুর ও সাপাহারে, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জে, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও শেরপুরে, পাবনার আতাইকুলায় এবং নাটোর সদর ও সিংড়া উপজেলাসহ আরও বেশকিছু উপজেলার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় এই গবেষক দল গবেষণা চালিয়েছেন। এসব এলাকায় বসবাসরত সাঁওতাল, ওঁরাও, শিং, রাজভোর, বেদীয়া, মুণ্ডা, তুরী, রবিদাস, মাহালী, মাহাতোসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীদের প্রাচীনকাল হতে বিভিন্ন উৎসব, বিয়ে কিংবা পূজা পার্বণ উপলক্ষে আঁকা আলপনা ও দেয়ালচিত্র ছিলো গবেষণার বিষয়বস্তু।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের পূর্বের আলপনা ও দেয়ালচিত্রের বিষয়বস্তু ও অংকনশৈলীর সঙ্গে বর্তমানের আলপনা ও দেয়ালচিত্রের বিষয়বস্তুতে বেশকিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করার পাশাপাশি রঙেরও ভিন্নতা লক্ষ্য করেছেন গবেষক দল। কিছু এলাকায় এখনও খুব জোরালোভাবে বিভিন্ন উৎসবে আলপনা ও দেয়ালচিত্র অংকনের প্রচলন থাকলেও কোনো এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা ভুলতে বসেছেন নিজেদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। এর কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কর্মব্যস্ততা, জীবিকার তাগিদ, মাটির ঘর ভেঙ্গে ইটের ঘর নির্মাণ এবং আধুনিকতার ছোঁয়া।

জানতে চাইলে এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সোবাহান বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আলপনা ও দেয়ালচিত্র নিয়ে দুই বছরের গবেষণায় আমি নৃগোষ্ঠীদের কয়েকটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণ করে তাদের আলপনা ও দেয়ালচিত্রগুলো দেখেছি এবং সেগুলো সম্পর্কে জেনেছি। এলাকাভেদে এগুলোর কর্ম পরিধি এবং কর্মকৌশলে অনেকটাই বৈচিত্র্য আছে। রাজশাহী অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীরা মাটির দেয়ালে আতপ চালের গুঁড়োতে পানি মিশিয়ে আলপনা করে। সেখানে ফুল, লতা-পাতা এবং এক রঙের বৈচিত্র্যটা বেশি ছিলো, তবে দুয়েক জায়গায় অন্যান্য রং ছিলো। নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলেও ফুল, লতা-পাতা বেশি ছিলো। এছাড়া এসব এলাকার নৃগোষ্ঠিরা মাটি কেটে উঁচু অংশ রঙ করে আলপনার ফুলের কলিতে কাঁচের টুকরো বসিয়ে দেয়, যেটাতে আলাদা এক নান্দনিকতা প্রকাশ পায়।

তিনি বলেন, দেয়ালচিত্রের মধ্যে আমরা দেখেছি নৃগোষ্ঠিদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাগুলোই তারা চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে তাদের বিভিন্ন উৎসব যেমন কারাম, সোহরাই, পৌষ সংক্রান্তি, নবান্ন, ভাই ফোঁটা দেয়ার দৃশ্য এবং এসব উৎসবে মাদল, বাঁশিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারের নৃত্য পরিবেশনের দৃশ্য আমরা তাদের চিত্রকর্মে দেখতে পেয়েছি। এছাড়া আমরা এসব স্বশিক্ষিত নৃগোষ্ঠী শিল্পীদের মাঝে নিজস্ব শৈলিতে শিশুসুলভ ড্রইংয়ের প্রয়োগ লক্ষ্য করেছি। তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নয় তবুও তাদের হাতের আলাদা এক মাধুর্য্যতা এসব চিত্রে ফুটে উঠে। যেটা আমাদের বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠিদের সংস্কৃতির আলাদা এক ঐতিহ্য।

তবে জীবন-জীবিকার তাগিদে এই ঐতিহ্য অনেকটাই বিলুপ্তির পথে জানিয়ে এই গবেষক বলেন, আমরা মূলত নৃগোষ্ঠী শিল্পীদের উৎসাহ প্রদানেই এই গবেষণার বিষয়টি বেছে নিয়েছিলাম। এবং এই গবেষণার ফলে তারা অনেকটাই উৎসাহিত হয়েছেন। আশা করি, তারা নিজেদের অংকিত আলপনা ও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিবে, যেটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত শিল্পীদের মাঝেও উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে। বর্তমানে অনেক নৃগোষ্ঠী নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন-জীবিকার সন্ধানে কর্মব্যস্থ থাকায় তাদের এই ঐতিহ্য অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আমরা আশা করবো, দেশ ও জাতির মাঝে তাদের সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসবে।