জাবিতে মাস্টারপ্ল্যান না করে ভবন নির্মাণ বন্ধের দাবি
আসন্ন গ্রীষ্মকালীন ছুটি ও ঈদুল আজহার ছুটিতে গাছ কেটে নির্মাণ কাজ শুরু না করার আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ বন্ধের দাবিতে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ বিষয়ে স্মারকলিপি জমা দেন ৩ শিক্ষার্থী। এ সময় উপাচার্য তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন।
স্মারকলিপি জমাদানকারী শিক্ষার্থীরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম ইমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম ও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাস বন্ধকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ধরনের অফিশিয়াল কাজ বন্ধ থাকে এমনকি অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিন্ডিকেট সভা করার অনুমতিও নেই। তাই আমরা বন্ধে গাছ না কাটতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বন্ধে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আমরা সদা তৎপর। যদি প্রশাসন ভবন তৈরির নামে বন্ধ-ক্যাম্পাসে লুকোচুরি করে গাছ কাটার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা দেখায় তাহলে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতির দায় প্রশাসন তথা মাননীয় উপাচার্যকেই নিতে হবে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি সারা দেশে ‘হিট ওয়েভ’ এর মতো উচ্চ তাপমাত্রাগত পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গড় তাপমাত্রা রাজধানী ঢাকার গড় তাপমাত্রার তুলনায় তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস কম দেখা গেছে, যা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অস্তিত্বশীল বিশেষ প্রাণ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যেরই ইতিবাচক অবদান।
স্মারকলিপিতে তারা আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এমন একাধিক স্থানে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে যেখানে ভবন নির্মাণ করতে হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উদ্ভিদ কর্তন করা হবে, জলাশয় ভরাট ও লেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে যা প্রাণিকুলের বাস্তুসংস্থান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশগত বৈচিত্র্যের জন্যে অমোচনীয় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। আমরা সকলেই অবগত আছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে যা মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করেই হয়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিতি ও বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশকে সচেতন ও প্রস্তুত করার বিদ্যায়তনিক দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনস্বীকার্য ব্যর্থতা।
এছাড়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশগত ক্ষতি এড়িয়ে ভবন নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সকল অংশীজনদের অংশগ্রহণে বিশেষজ্ঞনির্ভর মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন এবং ও উন্নয়নকার্যে তার অনুসরণ অপরিহার্য। প্রশাসন এই প্রয়োজন উপলব্ধি করে ইতোমধ্যেই একটি ‘মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করায় আমরা সাধুবাদ জ্ঞাপন করছি। তবে, অংশীজনের মতামত ছাড়াই কমিটি প্ল্যান প্রনয়নরত অবস্থাতেই, অর্থাৎ মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বেই তড়িঘড়ি করে ভবন নির্মাণ শুরু হলে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা ব্যাপক আকারে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করছি। এমতাবস্থায় সব অংশীজনের মতামত ছাড়াই ভবন নির্মাণের জায়গা চূড়ান্ত না করে, মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া প্রণয়ন না করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা সমীচীন নয়।
স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের জন্যে প্রস্তাবিত ভবন নির্মাণস্থলে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম ও জীববৈচিত্র্যের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাশয় রয়েছে যা ভবন নির্মাণকার্যের অংশ হিসেবে ভরাট করতে হবে। এই জলাশয়টি ভরাট হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও আছে। চারুকলা অনুষদকে পুরোনো আলবেরুনী হল বর্ধিতাংশ সংলগ্ন স্থান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যাতে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম ও অতিথি পাখিদের বিচরণ স্থান হিসেবে পরিচিত একটি জলাশয় রয়েছে। এছাড়াও নানা জাতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যে এই স্থানটি সমৃদ্ধ। এখানে ছোটো বড় প্রায় পাঁচ শতাধিক গাছ রয়েছে। স্থানটি পরিযায়ী অতিথি পাখিদের ‘ফ্লাইং জোন’ হিসেবেও স্বীকৃত। ভবন নির্মাণার্থে উক্ত লেকে পরিযায়ী পাখির বিচরণ রুদ্ধ হবে ও উদ্ভিদসমূহ কর্তন করা হলে এই অঞ্চলটি ও সার্বিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। কলা ও মানবিকী অনুষদের অংশীজনদের মতামত ছাড়াই বর্তমান প্রশাসনিক ভবনের পেছনে তাঁদের বর্ধিতাংশ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা বর্তমান প্রশাসনিক ভবনকে পূর্নাঙ্গকরণের প্রয়োজনীয় কাজে জটিলতা সৃষ্টি করবে।
সবশেষে স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ও ভাবমূর্তিগত স্বার্থ আমলে নিয়ে দ্রুততম সময়ে যথাযথ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তার অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যেকোনো প্রয়োজনীয় ভবন কিংবা স্থাপনা নির্মিত হোক। আমরা বিনীতভাবে জানাতে চাই যে, মাস্টারপ্ল্যান ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ে জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য নষ্ট করে গৃহীত যেকোনো পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলছি এবং আমাদের যৌক্তিক আবেদনের পরেও প্রশাসন যদি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ অনুমোদন করে থাকে তবে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়ার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের৷