ইবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের সমর্থন, একাত্মতা প্রকাশ

  • ইবি করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং সকল চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে মেধা ভিত্তিক নিয়োগের দাবিতে দেশব্যাপী সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলমান রয়েছে। তার অংশ হিসেবে গত তিনদিন ধরে মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা।

এদিকে শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশক'জন শিক্ষক তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। এর আগে শনিবার (৬ জুলাই) আন্দোলন সূচনার আগেই একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ এবং ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল।

বিজ্ঞাপন

শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মা বলেন, “১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোন ধরণের কোটা থাকা উচিত নয়, এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মেধার অধিকার থাকা উচিত। কোটা একধরনের সুবিধা, সুবিধারও মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে। জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত পদের (সকল শ্রেণির চাকরিতে) অতিরিক্ত ১০% বা যুক্তিসঙ্গত পদ সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে। অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ প্রতিবন্ধীদের জন্য ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণির চাকরির কোটা রাখা যায়। কারণ ১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরি মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য উন্মুক্ত।”

ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক মিঠুন বৈরাগী নিজের ভুক্তভোগীর কথা শেয়ার করে বলেন, “মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে কোটা পদ্ধতি বাতিল অথবা কোটা সংস্কার (সর্বোচ্চ ১০%) করা অতীব জরুরি। ব্যক্তিগত অভিমত- শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতির জন্য আমি নিজেও ভুক্তভোগী ছিলাম!”

বিজ্ঞাপন

পোস্টে মন্তব্য করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “এখন যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান চাকরির পরীক্ষায় প্রায় পাওয়ায় যায় না। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ১০% কোটা থাকাই শ্রেয়।”

এতে মন্তব্য করে সহমত পোষন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শেলীনা নাসরিন।

এদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের প্রভাষক রেহেনুমা তানজিম ফেসবুক পোস্টে বলেন, “স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর চাকুরিতে মেধার পরিবর্তে কোটা ব্যবহার সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। যারা ভবিষ্যতে দেশের কাণ্ডারি হবে তাদের যথাযথ যোগ্যতা ও আত্মসম্মান না থাকলে দেশ কিভাবে চলবে তা সহজেই অনুমেয়। ২০১৮ সালে সরাসরি কোটা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। তখন দাবি আদায় হলেও আবার একই কারণে ছেলেমেয়েদের রাস্তায় নামতে দেখা সত্যি দুঃখজনক!”

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক মোঃ ইয়ামিন মাসুম বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলব, আপনারা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নিয়ে কটুক্তি করবেন না। আশা করি, মহামান্য আদালত এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ আপনাদের মতামতকে বিবেচনা করবেন। আমি ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে কোটা প্রথা বাতিল নয় তবে কোটা সংস্কারের পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে ১০% এবং অন্যান্য কোটা ৫% রাখা যেতে পারে। হোক পরিবর্তন।”

ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি ড. আবু শিবলী মোঃ ফতেহ তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “গণতান্ত্রিক দেশের যেকোনো ধরনের আন্দোলন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে যায় না। আমিও গণমানুষের চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার মতে, কোটা যদি সরকার রাখতেই চায়, তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ সব ধরনের কোটা মিলে তা অবশ্যই মোট পদের ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। এ আমার একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত। এরসাথে সবাইকেই একমত পোষণ করতে হবে এমন নয়। সতত শুভ কামনা সকলের জন্য!”

বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা বিশ্লেষণী মন্তব্য করে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় সমুহ ২ টি কারণে অচল এক কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন আর অন্যটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন স্কিম নিয়ে। এই ২টিই হচ্ছে অপরিকল্পিত ও তাড়াহুড়ো করে নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে। প্রথমত সংক্ষেপে আলোচনা করি কোটা পদ্ধতি নিয়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের মুখে সরকার ১ম শ্রেণির চাকুরিতে কোটা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। এটা একটু সময় নিয়ে জনজরিপ করে সকলের অধিকার বা সংবিধানের আলোকে করা উচিত ছিল। আর এই কোটা ত্রুটিপূর্ণ এই কারণে যে মোট পদের বড় অংশ চলে যায় কোটায়, কারো কারো হিসেবে সেটা ৭০%। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা আগে ঠিক করতে হবে। মোট চাকুরির সর্বোচ্চ ১৫% কোটা হতে পারে আমার মতে সেটা ১০% হওয়া উচিত। এই ১০% এর মধ্যে যারা কোটা পাবার যোগ্য তাদের মধ্যে দিতে হবে। যেমন ধরুন মোট আসন ১০০টি, এর মধ্যে ১০টি থাকবে কোটায়, এই ১০টির ৩০%। মানে ৩টি এক কোটায়, ২০% মানে ২টি আর এক কোটায় থকতে পারে। আর একটি বিষয় একজন মুক্তিযোদ্ধার মেধাবী, প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য সন্তান হিসেবে বলতে চাই, কোনভাবেই এই কোটা আন্দোলনে জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যেন অসম্মান করা না হয়।”

ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: হাফিজুল ইসলাম দাবি করেন, “স্মার্ট রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে প্রশাসনিক সংস্কারের মতো কোটা ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অতীব জরুরী।”

ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন জাহিদ বলেন, “চাকুরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, নারী ইত্যাদি মিলিয়ে চাকুরিতে সর্বোচ্চ ১০% কোটা থাকতে পারে, এর বেশি না।”

ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হক বলেন, “লক্ষ কোটি বেকার যুবকের স্বপ্নকে বাঁচতে দিন। মেধাবীরাই দেশকে সবচেয়ে ভালো সেবা দিতে পারবে। এদেরকে বঞ্চিত করে কি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব? আপনার কি মনে হয়?”

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রস্তাবিত ৪ দাবিতেই অচল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দাবি-সমুহ:

১. ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকুরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে।

২. ১৮' এর পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকুরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

৩. সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।

৪. দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।