পরীক্ষায় ছাত্রলীগ নেতার প্রক্সি দিতে এসে আটক 'প্রক্সি ব্যবসায়ী'
জয়পুরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক রেজার জন্য ম্যানেজমেন্ট বিষয়ের ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী খুঁজে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) এসে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা পড়েন কাউছার আলী নামের এক 'প্রক্সি' ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তাকে আটক করেছে পুলিশ।
শুক্রবার (১২ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কাউছার আলীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে নিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে রাত ৩টার দিকে তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।
ঢাবি সাংবাদিক সমিতিতে কাউছার আলী জানিয়েছেন, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার কথা। প্রায় ১০ বছর ধরে সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার একটি ‘প্রক্সি’ চক্রের সাথে তিনি জড়িত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের তথ্যপ্রমাণ তার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন গ্রেডের সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রার্থীদের হয়ে ‘প্রক্সি’ দেন কাউছার আলী। কোনো চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রক্সি হিসেবে বিশেষ কোনো বিষয়ে দক্ষ কাউকে প্রয়োজন হলে তাদের খুঁজে দিতেও সহায়তা করেন। শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছাড়াও রেলওয়ের বিভিন্ন পদ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও পল্লি বিদ্যুৎ সমিতিসহ বিভিন্ন সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ও তার সহযোগীরা ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী সরবরাহ করেন।
কাউছার জানান, নিজে অন্তত তিনটি পরীক্ষায় ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী হয়েছেন। ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী খুঁজে দিতে সহায়তা করেছেন আরও ১৪-১৫টি পরীক্ষায়।
এবার জয়পুরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজার হয়ে যে প্রক্সি পরীক্ষার্থী খুঁজতে এসেছিলেন বলে দাবি করেছেন। সে দাবির সপক্ষে রেজার সঙ্গে এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আলাপচারিতার প্রমাণও দেখিয়েছেন কাউছার।
কাউছার তার প্রক্সি ব্যবসার ব্যাপারে জানান, মূলত পরীক্ষায় বসার জন্যই তিনি ২০ হাজার টাকা করে নেন। নিজে পরীক্ষা না দিতে পারলে ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী জোগাড় করে দেন। আর পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর পাস করলে চাকরিভেদে এক থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী জোগাড় করে দিলে তার সঙ্গেও এই টাকা ভাগাভাগি হয়।
ঢাবিতে ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী পেলে পরীক্ষায় বসার জন্য ২০ হাজার টাকা এবং পাস করলে এক-দেড় লাখ টাকার ‘চুক্তি’ আবু বকর সিদ্দিক রেজার সঙ্গেও হয়েছিল বলে দাবি করেছেন তিনি।
জানা যায়, পরীক্ষায় প্রক্সি প্রার্থীর খোঁজে ‘রবিন’ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা করতে শুক্রবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন কাউছার আলী। ঢাবির এক শিক্ষার্থী ছদ্মনাম ‘রবিন’ নামটি ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন কাউছার আলীকে। পরে তিনি ক্যাম্পাসে এলে তাকে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে নিয়ে যান।
কাউছার আলী জানান, শনিবার (১৩ জুলাই) অনুষ্ঠেয় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পরীক্ষায় প্রক্সি যোগাড় করতে এসে ‘রবিন’ ছদ্মনামে পরিচয় দিয়ে জয়পুরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক রেজার সঙ্গে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘প্রক্সি’ প্রার্থী ঠিক করে দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি হয় তার। এ তথ্যের প্রমাণ হিসেবে তিনি আবু বকর সিদ্দিক রেজার সঙ্গে তার হোয়াটসঅ্যাপ কথপোকথন দেখান। সেখানে কাউছার আলীকে প্রবেশপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য আবু বকর সিদ্দিক রেজা দিয়েছেন বলে দেখা যায়।
কাউছার আলী আরও জানান, শনিবার অনুষ্ঠেয় এনটিআরটিসির লিখিত পরীক্ষায় ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে দক্ষ, এমন প্রার্থীর খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তিনি। প্রার্থী পেলে রাজশাহী লোকনাথ হাই স্কুলে রাতের মধ্যে পাঠিয়ে সকালে পরীক্ষায় বসতে সহায়তা করার কথা ছিল তার।
কাউছার আলী চক্রের সাথে জড়িত আরও বেশ কয়েকজনের নাম জানিয়েছেন, যারা এই প্রক্সি চক্রের সদস্য হিসেবে তাকে সহায়তা করেন। এর মধ্যে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের আজিজুল, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রায়হান, ভুগোল বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শিমুল, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আবু জর গিফারির নাম উঠে এসেছে। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রাকিব হাসান নামের একজনের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
এই চক্রের অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থীর নাম জানিয়েছেন কাউছার আলী। এদের মধ্যে বিজয় একাত্তর হলের ইকবাল হোসেন, মুহসীন হলের ইফরাত ও আব্বাসের নাম বলেছেন তিনি। তবে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য নেই তার কাছে।
তিনি জানান, রেলওয়ের পয়েন্টসম্যান, খালাসি ও ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ২-এর মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার পদে ভিন্ন তিনজনের পরীক্ষায় ‘প্রক্সি’ প্রার্থী হিসেবে নিজেই অংশ নিয়েছেন তিনি। গত ২৮ জুন রেলওয়ের পয়েন্টসম্যান পদের পরীক্ষা ছিল। ওই পরীক্ষায় সাগর কুমার দেবনাথ নামের একজন প্রার্থীর হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।’ ১৭০২৬২৭১ রোল নম্বরধারী ওই প্রার্থীর পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ঢাকার তেজগাঁও আদর্শ কলেজ। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য সাগরের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন তিনি। গত নভেম্বরে রেলওয়ের খালাসি পদে পরীক্ষা একজন প্রার্থীর হয়ে পরীক্ষায় বসার কথাও জানান কাউছার।
এ ছাড়াও বগুড়া আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আমিনুলের মাধ্যমে মুহাম্মদ বুলবুল ইসলাম নামের একজন প্রার্থীর পরীক্ষায় বসেছিলেন কাউছার আলী। গত ৪ মে অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২-এর মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। সে পরীক্ষায় প্রিলিতে পাসও করেন বলে জানান কাউছার আলী।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক রেজার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, কাউছার আলীর বাড়ি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবির কুয়াতপুরে। তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ সেশনে ফলিত পুষ্টি ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে পরিচয় দেন। ২০১৪ সালে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন।