জাবির আবাসিক হলে ছাত্রলীগ নেত্রীর দাপটে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নবনির্মিত ফজিলাতুন্নেছা হলের এক ছাত্রলীগ নেত্রীর দাপটে অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ইন্টারনেট কোম্পানির নামে টাকা তোলা, ক্যান্টিনে বাকি খাওয়া, চাঁদা দাবি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার, নন-অ্যালোটেড শিক্ষার্থীদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়াসহ কোনো অপকর্মই বাদ রাখেননি তিনি। এসব নিয়ে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি হল প্রভোস্ট বরাবর একটি অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছেন।
দাপুটে সেই ছাত্রলীগ নেত্রী হলেন প্রাণিবিদ্যা ৪৭তম ব্যাচের আফরিন আলম রিমি। আফরিন আলম রিমি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদে রয়েছেন এবং সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনের অনুসারী।
হলের শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা যায়, আফরিন আলম রিমি হলের ৩য় তলার পলিটিক্যাল ব্লকের কক্ষ ও বিভিন্ন ফ্লোরের শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে ওয়াইফাই লাইনের নাম করে টাকা তোলেন। হলের শিক্ষার্থীদের কক্ষে সাধারণ ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিনামূল্যে তিনি নিজের কক্ষে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এমনকী তার রাজনৈতিক প্রভাবে অনুগামীরাও হলে ৪ জনের কক্ষ একাই দখল করে থাকা শুরু করেছেন। এদের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তার ছোট বোনকে নিয়ে চারজনের কক্ষে উঠেছেন, যিনি ফজিলাতুন্নেছা হলে অবস্থান করে কাছাকাছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
রাজনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করে রিমি অন্যান্য হলের নন-অ্যালোটেড শিক্ষার্থীকে ওঠানো এবং বরাদ্দকৃত (অ্যালোটেড) শিক্ষার্থীকে তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলেও শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্ষতি হবে এ ভয়ে কখনো মুখ খোলেননি।
সর্বশেষ, জুন মাসের শেষে ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান ‘মাস্টারনেট’ তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাইলে বিষয়গুলো জনসম্মুখে আসে। মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী, ‘মাস্টারনেট’ জুন মাসের ২৮ তারিখ পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ২৬ তারিখেই সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে করে শিক্ষা কার্যক্রমসহ নানামুখী সমস্যায় পড়েন হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে ছাত্রীরা জানতে পারেন, হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এমনকী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও ইন্টারনেট সংযোগের মেশিনগুলো আনতে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে ইন্টারনেট সংযোগকারী প্রতিষ্ঠানটি।
এতে করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হলের সাধারণ ছাত্রীরা। তাদের প্রশ্ন, কোনো ধরনোর সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও একটি ভালো প্রতিষ্ঠানকে কেন হল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো তা তাদের বোধগম্য নয়! হলের একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ের সত্যতা মিলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ছাত্রী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি ঈদের ছুটির পর এসে ২৩ তারিখে নেটের বিল ৫শ টাকা দিলাম। কিন্তু ২৭ তারিখ থেকেই নেট নেই। হল প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এতগুলো স্টুডেন্টের কাছ থেকে টাকা নিলো কিন্তু আমাদের মতামত ছাড়াই নতুন ইন্টারনেট প্রোভাইডার নিয়ে এলো এবং সেখানে আমাদের কোনো মতামতই নেওয়া হয়নি।
আরেক শিক্ষার্থী জানান, বর্তমানে ক্যান্টিনে খাবারের মান নিয়ে বারবার অভিযোগের পরেও খালাদের চেঞ্জ করা হচ্ছে না। এর কারণ একটাই, কারণ তারা ক্যান্টিনে মাগনা (ফ্রি) খায়। এভাবে কয়টা টাকা মাগনা খাওয়ার জন্য নিজের সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়রদের কষ্ট দিতে একটুও বিবেকে বাধে না তাদের!
আবাসিক হল থেকে চলে যাওয়ার বিষয়ে মাস্টারনেট-এর সহকারী ইঞ্জিনিয়ার সাইফ বলেন, মূলত কোম্পানি পলিসির কারণেই আমাদের ব্যবসা ওই হল থেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আমাদের লাভ হচ্ছিলো না। দুদিন পর পরই লাইন নষ্ট হয়ে যায়। সবশেষে, ব্যবসা গুটিয়ে আনার সময় আমাদের লাইনগুলো কেটে দেওয়া হয়। এমনকী মেশিনগুলোও আনতে দেওয়া হয়নি।
ফ্রি ওয়াইফাই ও চাঁদার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক হলেই ছাত্রলীগের কিছু রুমে ফ্রি লাইন দেওয়া লাগে। নয়তো ব্যবসা করা যায় না। এটা তো ওপেন সিক্রেট। ফজিলাতুন্নেসা হলের ‘এক্সাক্ট’ হিসাব এখন আমার কাছে নেই। তবে ১০টার বেশি রুমে ছিল।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে গত সপ্তাহে নিজেদের গ্রুপে একটি পোস্ট করেন চারুকলা বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অথি সরকার।
এতে করে হলের ইন্টারনেট সংযোগ থেকে শুরু করে সেই ছাত্রলীগ নেত্রীর নানা অপকর্ম-অসদাচরণ নিয়ে সোচ্চার হন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে সব শিক্ষার্থীদের পক্ষে হল প্রশাসনের কাছে মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ দেন কয়েকজন শিক্ষার্থী৷
হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে অথি সরকার বলেন, গত এক বছর ধরে হলে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল। এগুলো সম্প্রতি ওয়াইফাই লাইন চেঞ্জ করার মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমাদের আগে যে লাইন ছিল, সেই লাইন নিয়ে আমাদের তেমন কোনো সমস্যা ছিল না।
কিন্তু কয়েকমাস ধরে সেটা চেঞ্জ করার জন্য রিমি আপু উঠেপড়ে লাগেন। পরে চেঞ্জও করা হয়। কিন্তু নতুন লাইন আসার প্রথম এক সপ্তাহ খুবই সমস্যা হয়। এছাড়া ‘মাস্টারনেট’-এর ওরা ক্লেইম করেছে হলের পলিটিক্যালরা টাকা চেয়েছে। সেটা দিতে পারেনি বলে তাদের প্রেসার ক্রিয়েট করে চলে যেতে বাধ্য করেছে। তার নামে আরো অসংখ্য অভিযোগ আছে, যেগুলো হলের মেয়েরা জানিয়েছে এবং আমরা সমস্যাগুলো প্রভোস্ট স্যারের কাছে জানিয়েছি। আমরা অতিদ্রুত এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান চাই।
এসব অভিযোগের পাশাপাশি হলের ছাত্রীরা জানান, ফটোকপির দোকানদারের কাছে কাঙ্ক্ষিত চাঁদা না পেয়ে তাকে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়নি ছাত্রলীগের নেত্রীরা। ফটোকপি দোকানদার কুসুমের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষার্থীরা জানান, মেশিন এনে দুই মাস ফেলে রাখার পরেও অন্য সমস্যার অজুহাতে তাকে দায়িত্ব নিতে দেওয়া হয়নি। মূল বিষয়টি চাঁদা দাবি হলেও তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যার দোহাই দিয়ে কুসুমকে দোকান নিতে দেননি। এমনকী আলম নামের এক হলগার্ড শুরুতে ক্যান্টিন পরিচালনা করলেও চাঁদা না পেয়ে তাকে ক্যান্টিন থেকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে রিমির বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী আফরিন আলম রিমি বলেন, ‘আমি যেহেতু রাজনীতি করি, অনেকে অনেক কথাই বলে। ঢালাওভাবে অভিযোগ করে বসে। ফটোকপির দোকানদারের সঙ্গে হলের স্টুডেন্টদের ঝামেলা ছিল। উনি (দোকানদার) বলেছে, ওনার ওয়াইফ (কুসুম) ছাড়া দোকান চালাবে না। এজন্য উনাকে আর দেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয়ত, আমি আজ পর্যন্ত ক্যান্টিনে একটা টাকাও বাকি খাইনি। এখন পর্যন্ত পুরাতন হলসহ ৩টা ক্যান্টিনে খেয়েছি। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না, আমি বাকি খাই। আমার কোনো জুনিয়াররাও বাকি খায় না। আর নেট নিয়ে অনেকদিন ধরে ছাত্রীদের অভিযোগ। পরে আমরা পলিটিক্যালরা ভাবলাম সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেহেতু ওই নেট চায় না, তাই চেঞ্জ করি। পরে আমরা চেঞ্জ করেছি। তবে ওইভাবে হলের কোনো রুম থেকে ইন্টারনেটের টাকা নেইনি'।
ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রীদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফজিলাতুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমি এখনো অভিযোগ হাতে পাইনি। শিক্ষকদের চলমান কর্মবিরতির কারণে হল, অফিস বন্ধ। তাই, ছাত্রীরা এ ব্যাপারে আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে। রোববার ছাত্রীরা অভিযোগপত্র জমা দেবে বলে জানিয়েছে। এরপর আমরা হল প্রশাসন এ বিষয় নিয়ে বসবো এবং একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবো’!