জাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, হল প্রভোস্টের পদত্যাগ
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জেরে স্লোগান দেয়ায় আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের জেরা ও মোবাইল ফোন চেক করার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের জন্য অবমাননাকর এমন অভিযোগে আন্দোলনকারীদের করা বিক্ষোভ-মিছিলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধা প্রদান ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছেন হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার।
সোমবার (১৫ জুলাই) দিবাগত রাত ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল প্রদক্ষিণ শেষে বিক্ষোভ-মিছিলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংলগ্ন সড়কে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধার সম্মুখীন হন তারা। ঘটনার এক পর্যায়ে হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে বসে। ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের ৪ জন সহ অন্তত ৫ জন আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে।
হামলার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬ ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন। এছাড়া এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আর রাফি চৌধুরী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল্লাহর সম্পৃক্ততার বিষয়েও জানা গিয়েছে। হামলার ঘটনায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে আহসান লাবিব, সোহাগী সামিয়া, তৌহিদ সিয়াম ও মেহরাব সিফাতসহ একজন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে আহসান লাবিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে সোহাগি সামিয়াকে এনাম মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গতকাল রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য আন্দোলনকারীদের জন্য অবমাননাকর এমন অভিযোগ তুলে রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে 'তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার', 'চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার' প্রভৃতি স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থীরাও স্লোগান দিয়েছে৷
পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা জমায়েত হতে শুরু করে। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৪ জন আন্দোলনকারীকে আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে ঐ হলের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এরই প্রেক্ষিতে হল প্রাধ্যক্ষকে এ ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য রাত পৌনে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ওই হলের সম্মুখে অবস্থান নেন। এসময় আন্দোলনকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
পরে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হোসেন তালুকদারকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে আলোচনায় বসতে দেখা যায়। এর কিছুক্ষণ পর রাত আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে পুনরায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে আসলে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করতে রাস্তা আটকে স্লোগান দিতে থাকে। পরে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী আহসান লাবিব এবং একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আহত হন।
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক উভয়ই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। তবে প্রক্টর ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টার তোয়াক্কা না করেই ছাত্রলীগের কর্মীরা বাধা প্রদান করতেই থাকে৷ তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের 'জামায়াত-শিবির' আখ্যা দেন এবং উপস্থিত নারী শিক্ষার্থীদের অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনকারীরা হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চেয়ার দিয়ে হামলা চালান।
এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হলের সকল লাইট বন্ধ করে দিয়ে ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন৷ এসময় হলের সামনে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে৷ এসময় উপর (ছাদ) থেকে ঢিল ছোড়ার অভিযোগ-ও করেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হল প্রাধ্যক্ষ আন্দোলনকারীদের দমাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উস্কে দিয়ে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেন এমন অভিযোগ করলে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে শিক্ষার্থীরা এসময় তাকে ঘিরে এ ঘটনার জবাবদিহিতা চান। একপর্যায়ে 'আমি পদত্যাগ করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপকার হবে' এমন মন্তব্য করে মৌখিকভাবে তিনি পদত্যাগ করেন।
ঘটনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোস্তফা ফিরোজসহ প্রশাসনের পক্ষে কয়েকজন শিক্ষক ঘটনস্থল পরিদর্শনে আসেন। এসময় উপ-উপাচার্য তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং সকাল ১১টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বসবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরে ভোর পৌনে ৫টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।