জবিতে নিজস্ব উপাচার্য নিয়োগের দাবি, এগিয়ে আছেন যারা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তার সঙ্গে আরও পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, পরিবহন পুলের প্রধান, হল প্রভোস্টসহ অন্যান্য সহকারী প্রক্টররা। ফলে অভিভাবাক শূন্য হয়ে পড়েছে জবি ক্যাম্পাস।
এমতবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগের দাবি তুলেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, জবিতে নতুন উপচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অধ্যাপকদের প্রধান্য দিতে হবে। একই সঙ্গে উপাচার্য হতে হবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও একাডেমিক যোগ্যতাসম্পন্ন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, আমাদের উপাচার্য হিসেবে যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক তাকে অবশ্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে তাদের মধ্য কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক।
আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান সাদী বলেন, ‘এতদিনে শিক্ষকদের শুধু বেতন দেয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়নি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলেছে। তারা কিছু নিয়ম কানুন দিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এখন আমরা নিজেরা নিজেদের বিশ্বিবদ্যালয়ের উন্নয়ন করতে চাই। আমাদের বিশ্বিবদ্যালয়ের একটা কালচার আছে, সেই কালচার ও নিয়মকানুনই চলবে। ঢাবির কালচার ও নিয়মকানুন দিয়ে জগন্নাথ আর চলবে না।’
জবি থেকে উপাচার্যে হওয়ার আলোচনায় আছেন যারা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন সমাজকর্ম বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। তিনি ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জগন্নাথে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রুলস রেগুলেশন তৈরিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
এরপর আলোচনায় আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের অধ্যাপক ড. পেয়ার আহমেদ। ২০১২ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৮ সালে বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ সালে গ্রেড -১ অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস এন্ড রেগুলেশন প্রণয়ন সদস্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ড. পেয়ার আহমেদ এর আগে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা ক্যাম্পাস), আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়ামাগাটা বিশ্ববিদ্যালয় (জাপান) সহ দেশ ও দেশের বাইরে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ক্যাম্পাসে তিনি একজন সুবক্তা, স্পষ্টবাদী, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। দেশী -বিদেশী জার্নালে তাঁর ৪০ টির বেশি গবেষণা পত্র রয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তার লেখা কয়েকটি পাঠ্য-পুস্তক রয়েছে।
এছাড়া উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আরও আলোচনায় আছেন ফিন্যান্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু মিছির। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্পোরেট ফাইন্যান্সিয়াল পলিসিস-এ পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এর আগে তিনি ঢাবি থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এছাড়া তার দেশও দেশের বাইরের বিভিন্ন জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিকট সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও উদার হিসেবে পরিচিত তিনি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সরব থাকায় উপাচার্য হিসেবে অনেকের পছন্দের তালিকায় আছেন অধ্যাপক ড. শাহ নিস্তার জাহান কবির। তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারপার্সন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা নিস্তার জাহান কবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল সম্পন্ন করেন তিনি। এছাড়া দেশি বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তার লেখা শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক শাহ নিস্তার। তাই শিক্ষার্থীরা বলছেন, যে শিক্ষক সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকে তিনিই সবচেয়ে যোগ্য।
এ বিষয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শারমির আক্তার বলেন, ‘নিস্তার স্যার অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে পারেন না। তার মতো সৎ শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই।’
অন্যদিকে উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে রাজনৈতিক তদবিরে এগিয়ে আছেন জবি বিএনপিপন্থী সাদা দলের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন। এছাড়াও তিনি সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ইউট্যাব)- এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্বিবদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রইছ উদ্দিনের সাথে রয়েছে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতে হলে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। দুটি চেয়ারের (উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ) একজন যদি একাডেমিশিয়ান হয়, অন্যজনের পলিটিক্যাল জ্ঞান থাকতে হবে। এতে একদিকে গবেষণা, শিক্ষা ও শিক্ষকের মান ঠিক থাকবে, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে সবাইকে একত্রিত রাখা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আনা সহজ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জবির ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। তবে আওয়ামী সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ১১ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ফলে বর্তমানে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির চৌধুরী