গেস্ট-গণরুম মুক্ত ঢাবি ছাত্রাবাসে স্বস্তি

  • রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গেস্ট-গণরুম মুক্ত ঢাবি ছাত্রাবাসে স্বস্তি। ছবি- বার্তা২৪.কম

গেস্ট-গণরুম মুক্ত ঢাবি ছাত্রাবাসে স্বস্তি। ছবি- বার্তা২৪.কম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অন্যতম আধুনিক ও বড় ছাত্রাবাস বিজয় একাত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববৃহৎ গেস্টরুমটিও ছিল এই ছাত্রাবাসে, যেখানে গাদাগাদি করে এক রুমে থাকতে হতো প্রায় দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ শিক্ষার্থীকে। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পাল্টেছে সে অবস্থা।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপে থাকা ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরও। ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো ছাত্র সংগঠনটির নেতারা এখন নিখোঁজ। কেউ পালিয়েছে দেশের বাহিরে, আবার কেউ বা গা ঢাকা দিয়েছে দেশের মধ্যেই। দেশে যারা তারা প্রকাশ্যে আসার সাহস পাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে সোমবার (২৬ আগস্ট) বিজয় একাত্তর হলের মেঘনা ব্লকের তৃতীয় তলার গণরুমে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ শিক্ষার্থীর ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস ছিল যে রুমে, সে রুম আজ অনেকটাই ফাঁকা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিছানাপত্র। এখন সবমিলিয়ে ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী থাকছেন সেই রুমে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও হলে ছাত্রলীগের কেউ আসেনি। ফলে গণরুমে থাকা অনেকে এখন ছাত্রলীগের দখলে থাকা বিভিন্ন রুমে গিয়ে উঠছে। ফলে গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসছে। এখন কিছু শিক্ষার্থী আছে তারা সবাই ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের। হলটির প্রভোস্ট পদত্যাগ করায় নতুন হল প্রভোস্টের অপেক্ষায় তারা। তখন গণরুম থেকে মুক্তি মিলবে বলেই আশা তাদের। 

বিজ্ঞাপন

কথা হয় গণরুমে থাকা তিন বন্ধু শাহাদাত হোসেন, তানভির ও শাকিলের সঙ্গে। তারা তিনজনই ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। জুলাইয়ে রাজনৈতিকভাবে উঠেছিলেন হলে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন আশায় বুক বাঁধছেন গণরুম ও গেস্ট সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়।

এনিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তানভির বলেন, যখন উঠেছি তখন অনেক শিক্ষার্থী ছিল, তবে আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখনো অনেক শিক্ষার্থী আসেনি। আবার আমাদের সিনিয়র যারা ছিল তারাও এখান থেকে বের হয়ে অন্যরুমে চলে যাচ্ছেন। শুনতেছি, নতুন প্রভোস্ট আসলে নতুন করে সিট বরাদ্দ দেওয়া হবে। তখন হয়তো গণরুম থেকে মুক্তি মিলবে, নতুন রুমে সিট পাবো।

৫ আগস্টের পর খাবারের মানে পরিবর্তন এসেছে কিনা জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আগে তো আমাদের নিজেদের ক্যান্টিনে খাওয়াই নিষেধ ছিল। আমরা পাশের কবি জসিমউদ্দিন হল বা জিয়াউর রহমান হলের ক্যান্টিনে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতাম। এখন আগের চেয়ে খাবারের মান কিছুটা ভাল হয়েছে, তবে আরও ভাল হওয়া উচিত।

 হল ক্যান্টিনে খাবারের মানে এসেছে পরিবর্তন। ছবি: বার্তা২৪.কম

পাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে গিয়ে জানা যায়, হলটির ১১০, ১১১ ও ১১২ নম্বর রুমগুলো গণরুম হিসেবে ব্যবহার করতো ছাত্রলীগ। তবে এদিন এই রুমগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। ১৫ থেকে ২০ জন গাদাগাদি করে থাকা এই রুমগুলোতে এখন ৮ জন করে শিক্ষার্থীকে থাকার কথা বলে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা।

এসময় হলটির ১১০ রুমে কাউকে পাওয়া যায়নি।  ১১১ নাম্বার রুমে ৮ জন থাকার কথা থাকলেও শুধু একজনই ছিলেন রুমে। এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৮ জনের জন্য রুমটি বরাদ্দ করা হলেও এখনো সবাই বাসা থেকে আসেনি। বর্তমানে সে একাই রুমে থাকছে। অনেকে এসে কাপড়-চোপড় ও বিছানা রেখে যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হলেই সবাই আসবে।

হলটির বর্তমান অবস্থা কেমন জানতে চাইলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী  মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের এই হলে এখন আর গণরুম নেই। যেগুলো ছিল সেখানে ৮ জন, ৮ জন করে উঠিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এখন প্রভোস্ট আসলে হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক হবে।

এছাড়াও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গিয়েও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। কথিত বড় ভাইদের ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তারা। অলিখিত গেস্টরুমের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে মনোযোগী হতে পারছেন পড়াশোনায়। ছাত্রলীগ নেতাদের ভয়ে কুঁকড়ে থাকা ছেলেটাও এখন সাহস পাচ্ছে সহজাত অভ্যাসে ফিরে আসার।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা যায়, আগে ছাত্রলীগের কথাই ছিল আইন। রাত দশটার পর শুরু হতো ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে সেই আইন শিক্ষার অত্যাচার। কথা না শুনলেই পড়তে হতো নেতাদের রোষানলে। নিজ হলের ক্যান্টিনেও খাওয়া ছিল মানা। তাই বাধ্য হয়ে অন্য হলের ক্যান্টিনে বা বাহিরে খেতে হতো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গিয়েও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। ছবি: বার্তা২৪.কম

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে প্রভোস্টের নিয়ন্ত্রণে হল থাকার কথা থাকলেও দেখা পাওয়া যেতো না তাদের। বরং হলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতো ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। সেখানেও আছে বিভাজন, অন্তর্কোন্দল। একেক নেতার একেক এরিয়ার। সেই প্রভাব বাড়ানো-কমানো নিয়েও সংঘর্ষ হতো নিজেদের মধ্যে।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এমনই একটি গণরুমে গিয়ে দেখা যায়, এখন সে নেতারা না থাকলেও একটি ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে প্রায় ৮ জন শিক্ষার্থীকে। দেয়ালে দেয়ালে লেখা এই রুমে থাকা সাবেক শিক্ষার্থীদের নাম। গণরুমে থাকার স্মৃতি রক্ষার্থে দেয়াল জুড়ে কিছু না কিছু লিখে যায় শিক্ষার্থীরা। সেই স্মৃতি ভারে ন্যুব্জ দেয়াল।

সেখানে বার্তা২৪.কম প্রতিনিধির কথা হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জাবেদের সঙ্গে। রুমে ঢুকার পথে হাতের বাম পাশের দেয়াল লাগোয়া চৌকি দেখিয়ে বলেন, প্রতিদিন রাতের রুটিন ছিল ১০টার রাজনীতির বড় ভাইয়েরা আসবেন, এসে এই চৌকিতে বসে আমাদের নানা কথা বলতেন। আমরা জড়সড় হয়ে বসে থাকতাম উলটো পাশের দেয়াল লাগোয়া। গালাগালি-অপমান করাই ছিল সে ‘ম্যানার’ মিটিংয়ের উদ্দেশ্য।

জাবেদ আরও বলেন, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এটাই বড় বিষয়।  আগে এই বিছানায় দুইজন করে থাকতে হতো। এখন একজন করে থাকছি। খাবারের মানও ছিল খুবই খারাপ। সেখানেও এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আমাদের হলে এখনো প্রভোস্ট নিয়োগ হয়নি। আশা করি এবার রাজনীতির বাহিরের কেউ নিয়োগ পেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে।