গণধোলাইয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু: যা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

  • মাহমুদুল হাসান, জাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জাবিতে গণধোলাইয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু

জাবিতে গণধোলাইয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের বাসভবনে গত ১৫ জুলাই রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের জুয়েল-চঞ্চল কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে গণধোলাই দিয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে হস্তান্তর করেন শিক্ষার্থীরা।

পরে প্রক্টরিয়াল টিম তাকে পুলিশে সোপর্দ করে৷ এরপরই পুলিশি হেফাজতে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়৷ আশুলিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিক মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন এলাকায় গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটে। প্রক্টর অফিসে নিয়ে আসার পরে রাত ৯ টায় তাকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷ পরে পুলিশি হেফাজতে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে রাত আনুমানিক সাড়ে ১০ টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখা সূত্রে জানা যায়, বিকেল ৫টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। তার অবস্থানের খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে গণধোলাই দেয়। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম উপস্থিত হয়। এক পর্যায়ে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় তাকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। সেখানেও উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা কয়েক দফায় তাকে গণধোলাই দেয়।

বিজ্ঞাপন

এদিকে এক জবানবন্দিতে শামীম মোল্লা জানায়, ১৫ জুলাই রাতে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে হামলা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারেক ও মিজান (ব্যাচ ও বিভাগ জানায়নি) নামে সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতা তাকে বঙ্গবন্ধু হলে নিয়ে যায়। সেখানে ছাত্রলীগ সভাপতি সোহেলের নেতৃত্বে পেট্রোল বোমা তৈরি করা হচ্ছিল এবং হামলার জন্য দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল। প্রস্তুতি শেষে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা করতে যাওয়া হয়। হামলার সময় তারেক এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে।

এদিকে, সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনে অবস্থিত প্রক্টর অফিসে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান ও নবনিযুক্ত ট্রেজারার ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার৷ এসময় উপাচার্য উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।

ঘটনার পর প্রক্টরিয়াল টিমের খবরে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল নিরাপত্তা শাখায় আসে। এসময় পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিম শামীমকে ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এসময় শামীম মোল্লা হামলার ঘটনায় নিজের অংশগ্রহণ ও ঘটনাস্থলে হামলাকারীদের সাথে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক মেহেদী ইকবাল উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করে। জিজ্ঞাসাবাধ শেষে প্রক্টরিয়াল টিম আশুলিয়া থানা পুলিশকে অবহিত করলে পুলিশ শামীম মোল্লাকে আটক করে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করে।

শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমিদখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। এছাড়া তার বিরদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। গত ১৫ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।


এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, প্রক্টর অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক মনে হয়নি। এমনকি তিনি নিজে হেঁটে পুলিশের গাড়িতে উঠেছেন। এরকম আসামিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করার বিষয়টি রহস্যজনক। নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত বলে মনে করছি না৷

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীম মোল্লার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের ৩৯-তম ব্যাচের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীম মোল্লা ক্যাম্পাসের প্রান্তিক গেইটে গণপিটুনির শিকার হন। পরবর্তীতে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শোক এবং দুঃখ প্রকাশ করে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে৷

আজ এক বিবৃতিতে কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে যে, গতকাল আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেইটে শামীম মোল্লাকে কতিপয় ব্যক্তি মারধর করতে থাকে। এ খবর প্রক্টরিয়াল টিম জানতে পেরে প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. রাশিদুল আলমসহ প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রক্টর অফিসের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় আশুলিয়া থানা পুলিশকে ঘটনাটি অবহিত করা হয়। কিছুক্ষণ পর কতিপয় ব্যক্তি প্রক্টরিয়াল টিমকে না জানিয়ে জোরপূর্বক শামীম মোল্লাকে প্রক্টর অফিসের পাশে অবস্থিত নিরাপত্তা অফিসে নিয়ে যায়।

তৎক্ষণাৎ প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. রাশিদুল আলম ঘটনাটি জানতে পেরে নিরাপত্তা অফিসে গিয়ে বিক্ষুব্ধদের সরিয়ে দেয় এবং নিরাপত্তা অফিসের কলাপসিবল গেইট তালাবদ্ধ করে দেয় ৷ নিরাপত্তা অফিসের কলাপসিবল গেইট ভেঙ্গে কতিপয় ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করে শামীম মোল্লাকে আবারও মারধর করে। এ সময় প্রক্টরের নেতৃত্বাধীন প্রক্টরিয়াল টিম ও নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তাগণ নিজেরা ঢালস্বরূপ শামীম মোল্লার সামনে দাড়িয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিবৃত্ত করে। রাত আনুমানিক সাড়ে ৭টায় পুলিশ প্রক্টর অফিসে আসেন। পুলিশ খোঁজ-খবর নিয়ে জানান, শামীম মোল্লার নামে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। রাত আনুমানিক ৮টায় প্রক্টরিয়াল টিম ও নিরাপত্তা শাখা আবারও ঢালস্বরূপ শামীম মোল্লাকে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রাত আনুমানিক ১০টার দিকে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ফোন করে জানান যে, শামীম মোল্লা স্থানীয় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেকোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে। কর্তৃপক্ষ শামীম মোল্লার ওপর হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। একইসাথে, এ হামলার যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে৷

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মো. জুয়েলুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি অচেতন, কনফার্ম করার জন্য আমরা ইসিজি করি। ইসিজি করে দেখতে পায় তিনি মৃত। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে বারোটার সময় আমরা তার ডেড বডি হস্তান্তর করি৷ শরীরের বিভিন্ন অংশে মারধরের কালো দাগ ছিল, তবে অস্বাভাবিক কিছু পাইনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বিস্তারিত জানা যাবে।

হাসপাতালে নিয়ে আসার পরের অবস্থা জানতে চাইলে হাসপাতালেরই স্বাস্থ্যকর্মী আমিনুল বলেন, পুলিশ আনুমানিক রাত ৯ টায় গাড়িতে করে হ্যানকাপ পড়িয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমি পুলিশের গাড়ি থেকে রিসিভ করে ডেসিং রুমে নিয়ে গেছি। ওনার পালস যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন বুঝেছি মারা গেছেন। পরে ইসিজি করে মৃত্যু পেয়েছি। পায়ে একটু রক্ত ছিল তাছাড়া শরীরে অন্য কোথায়ও রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। যেহেতু ইসিজি-তে মৃত্যু পাওয়া গেছে তাই চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ হয়নি৷