রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ দিতে সু-পরিকল্পনা নিতে হবে
সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশের তিন বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বেশ প্রশংসা কুড়িয়ে। কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনার মুখেও পড়েছে। ২০১৯ সালে প্রথম গণহত্যা দিবস স্মরণ নিয়ে লাখো রোহিঙ্গার জমায়েতের পর মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল করে দেয়া ও থ্রি-জি, ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়ায় রোহিঙ্গা ও মানবাধিকারকর্মীরা বাংলাদেশের সমালোচনা করে। প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিলো থ্রি-জি, ফোর-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা। ২০২০ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থ্রি-জি ও ফোর-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এ ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করছে রোহিঙ্গারা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন তারা।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এক যুগান্তকারী সুপারিশ করেছে। কমিটির সুপারিশ, রোহিঙ্গাদের অলস বসিয়ে না রেখে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োজিত করতে হবে (সমকাল, ২৬ আগস্ট, ২০২০)। অলস বসে থাকায় রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধমূলখ কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখাসহ তাদেরকে কর্মদক্ষ কর্মদক্ষ করে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে প্রশিক্ষিণ দেয়ার প্রয়োজনতীয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে সংসদীয় কমিটি।
সংসদীয় কমিটির পর্যবেক্ষণ অবান্তর নয়। কেননা, প্রবাদ রয়েছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তিন বছর পর হলেও সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবমুখী। এখন দেখার বিষয়, এ সুপারিশ কতটুকু আমলে নেয়া হয়। তবে, রোহিঙ্গাদের কাজে লাগানোর উদ্যোগ ক্যাম্পে সীমিত রাখার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে রয়েছে সুপারিশে। এ নিবন্ধে সংসদীয় কমিটির সুপারিশকে সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের কর্মদক্ষ করে তোলা ও তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার পক্ষে বলা হয়েছে, এমনকি ক্যাম্পের বাইরেও। শরণার্থীদের কাজের সুযোগসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা দেয়ার পক্ষে মানবিক ও আইনগত যুক্তি রয়েছে। তবে, এখানে অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের করণীয় নিয়ে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
মিয়ানমারের আচরণে এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যেতে পারে, কয়েক বছরের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার প্রত্যাবশন কল্পনাতীত। ১৯৭৮ সালে বছর খানের মধ্যে প্রায় সব রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবসন করা গেলেও ১৯৯১-১৯৯২ সালে যারা এসেছিলে তাদের সবাইকে দ্রুত সময়ে প্রত্যাবসন করা সম্ভব হয়নি। দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ১৯৯৪ সালে শুরু হলেও এখনো তা শেষ হয় নি। ২০০৫ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নেয়া বন্ধ করে দিলে প্রায় ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে যায়, যাদের সংখ্যা এখন ৩৪ হাজারের মতো। এই বিবেচনায় এবং মিয়ানমারের যাচাই-বাছাইয়ের নিয়ম মেনে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আগামী এক দশকে পাঠানোর আশা করাটা অবান্তর না হলেও, এটি অসম্ভব বলে অত্যুক্তি হবে না। এ সংখ্যাটা ১৯৯১-১৯৯২ সালে আসা রোহিঙ্গা ও তাদের সন্তান, যারা ১৯৯১-১৯৯২ সালের পর থেকে ২০১৭ সালের আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এসেছে।
রোহিঙ্গাদের শিবিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং কাজ করতে না দেয়ার পক্ষে জনমতের পাল্টা ভারী হতে পারে। কেননা, সীমিত অর্থনীতির বাংলাদেশে নিজস্ব জনসংখ্যা একই আকারের অনেক দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। বেকারত্ব ও দারিদ্রের হার সরকারি হিসাব মতে কমলেও, এখন তা সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে যায় নি। এই অবস্থায় ‘ভিনদেশি’ রোহিঙ্গাদের কাজ করার সুযোগ দিলে ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ মানুষ কাজ পাবে না- এ ধরনের জনমত বা বিশেষজ্ঞ মত আসবে, তা স্বাভাবিক। তবে, শরণার্থীদের দীর্ঘদিন কর্মহীন রাখলে বা তাদেরকে শুধু ত্রাণ নির্ভর করে রাখলে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আশ্রয়দাতা সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। অনেক সময় শরণার্থীদেরকে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাখলে তারা বাঁচার তাগিতে বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করে। এমনকি তারা উপায় না পেয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। এতে শুধু শরণার্থীদের দোষ দেয়া হয়। তবে, এতে যে আশ্রয়দাতা দেশের কঠোর নিয়ম-নীতিও পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করে সেটি অনেক সময় দেখা হয় না। দীর্ঘসময় অলস হয়ে বসে থাকলে রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কাজসহ বিভিন্ন নিয়মবহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে- সংসদীয় কমিটির এই উপলব্ধি এ জন্য অবান্তর নয়।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক অনুদান সামনের দিনগুলোয় কমে যেতে পারে। এখনই চাহিদা মতো তহবিল পাচ্ছে না সংস্থাগুলো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালে যৌথ কর্ম পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের জন্য আবেদন করা হয়েছিলো ৯২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া যায়, ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রয়োজনের ৭০ শতাংশ। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে যুদ্ধ বা দ্বন্দ্বের কারণে শরণার্থী অবস্থা সৃষ্টি হলে সেখানে দৃষ্টি যাবে, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের যে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা, বিশেষ করে খাবার ও চিকিৎসাসেবা, মেটাচ্ছে তাতে ঘাটতি পড়তে শুরু করবে। এভাবে ধীরে ধীরে তহবিলের অভাবে কার্যক্রম গুটাবে অনেক সংস্থা। এটিই বাস্তবতা। তখন রোহিঙ্গাদের রুজি-রোজগার করাটা হবে বাঁচা-মরার লড়াই। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এর আগেও এ ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে বাংলাদেশের সুপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। যেখানে দেশের স্বার্থের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রবেশের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করা নিয়ে ২০১৭ সালে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন হলে আমরা আমাদের খাবার তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবো।’ এটি মানবিক দিক থেকে তিনি বলেছিলেন। এই ভাগাভাগি কাজের সুযোগ দেয়ার মধ্যেও পড়ে। তবে, রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ দিলে শুধু তারাই যে উপকৃত হবে তা নয়। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শরণার্থী নিয়ে যারা গবেষণা করেন - বিশেষ করে কারেন জ্যাকবশন, জেফ ক্রিপস, আলেক্সজান্দার বেটস ও পল কলিয়ার - তাদের পর্যবেক্ষণ বলে, শরণার্থীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে দিলে তা বিভিন্ন দিক থেকে আশ্রয়দাতা সমাজ বা দেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব বয়ে নিয়ে আসে।
কীভাবে রোহিঙ্গাদের দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে দেয়া যায় সেটি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। এ জন্য বহির্বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেখানে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, কাজের ও চলাচলের সুযোগ দেয়া হয়েছে সেসব দেশ বা স্থান থেকে করণীয় খতিয়ে দেখতে পারে। আন্তর্জাতিক ঋণ ও অনুদান পেতে এ বিষয়ক সম্মেলন করতে পারে দেশে ও বিদেশে।
রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ দেয়া ও বিভিন্ন প্রভাব খতিয়ে দেখতে সরকার দেশে ও বিদেশে শরণার্থী বিষয় নিয়ে গবেষণার সঙ্গে জড়িত গবেষক ও শিক্ষাবিদদের মতামত দেয়ার আহ্বান করতে পারে। তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনও করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরণার্থী অবস্থা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা, ঘটনাভিত্তিক ও তুলণামূলক বিশ্লেষণ থেকে বাংলাদেশ অনেক কিছু শিক্ষণীয় গ্রহণ করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্সড মাইগ্রেশন ও ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক আলেক্সজ্যান্ডার বেটস ও অর্থনীতিবিদ পল কলিয়ারের তাত্ত্বিক আলোচনা জর্ডান সরকারকে সিরীয় শরণার্থীদের দেশের শ্রমবাজারে যোগ দেয়া ও শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি দিতে প্রভাবিত করেছে। বেটস ও কলিয়ার ২০১৫ সালে তাদের এক নিবন্ধে যুক্তি দেখান, শরণার্থীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দিলে তা বরং আশ্রয়দাতা দেশের জন্য ক্ষতির চেয়ে লাভজনক। তাদের মতে, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের মাধ্যমে শরণার্থীরা নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার নিজে বহন করতে পারে। একই সঙ্গে তারা আশ্রয়দাতা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের কাজ করার বিষয়টি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সঙ্গে এক ধরনের চুক্তি বা সমঝোতার ভিত্তিতে হতে পারে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিদেশি দাতাদের অর্থ সহায়তার বিপরীতিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রোহিঙ্গাকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ও মজুরি দেয়া যেতে পারে। ২০১৬ সালে জর্ডান কমপ্যাক্টের মাধ্যমে কম সুদে বিদেশি ঋণ ও অনুদানের শর্তে জর্ডান সরকার সিরীয়দের কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। জর্ডানের সিদ্ধান্ত অনেককে চমকে দিয়েছে। জর্ডানে ওই সময় সিরীয়দের কাজ অধিকার দেয়ার বিষয়টি ততোটা জনপ্রিয় ছিলনা, কেননা দেশটিতে বেকারত্বের হার ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ শতাংশ ছিলো।
দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগের অংশ হিসেবে ক্যাম্পের নিকটবর্তী এলাকায় ছোটপরিসরে হলেও রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা যেতে পারে। এখানে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকেরাও যেন কাজের সুযোগ পায় সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে বঞ্চিত হওয়ার ধারণা কমে যাবে। রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত বা প্রস্তুতকৃত পণ্য বিশেষ মূল্য বিক্রি ও আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশে বাংলাদেশে দাতাগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারে। যেহেতু আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে চাপ দেয়, রোহিঙ্গাদের শরণার্থী অধিকার দেয়ার জন্য, বাংলাদেশ সে চাপকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ ও অঞ্চলে তৈরি পণ্য-সামগ্রী ক্রয়ে তাদের চুক্তিবদ্ধ করা যেতে পারে। এসব পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করতে বাংলাদেশ সরকার দেশে-বিদেশি রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করে সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানোর কথা ভাবতে পারে।
রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট আয়ের ওপর সরকার আয়করও ধার্য করতে পারে। আয়করের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকার তাদের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদান করতে পারে। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান শ্রমিক-অধিকার আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এতে করে রোহিঙ্গাদের শ্রম শোষণ বন্ধ হবে।
যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন এক-দু বছরের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, সেহেতু তাদের অলস বসিয়ে না রাখার কথা ভাবতে হবে, এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশকে শুধু ক্যাম্পের মধ্যে সীমিত না রেখে বাইরেও প্রসারিত করার কথা ভাবতে হবে। এ জন্য করণীয় ঠিক করতে সরকারকেই আগ্রহী হয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
শরিফুল ইসলাম, পিএইচডি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নিউদিল্লি। ই-মেইল: [email protected]