মুশতাক তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
লেখক মুশতাক আহমেদের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। কখনো দেখা হয়নি। তিনি কী নিয়ে লেখালেখি করতেন তাও জানি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমরা সংযুক্ত ছিলাম না। তাই তার লেখালেখি বা তৎপরতা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তবে ভালুকায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমিরের খামার গড়ে তোলা এবং বিদেশে রপ্তানির খবর পত্রিকায় পড়েছি। তাতে তাকে ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ মনে হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন কারাগারে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর খবর পাই; তখন অচেনা এই মানুষটির জন্য আমার হৃদয় বেদনার্ত হয়েছে। পরিবার বিচ্ছিন্ন একটি মানুষের কারাগারে মরে যাওয়াটা গভীর বেদনাদায়ক। তবে বেদনার চেয়ে আমি বেশি পেয়েছি ভয়। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক গ্রাস করেছে আমাকে।
মুশতাক আহমেদ কোনো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন লেখক, তার অস্ত্র ছিল কলম। একজন লেখক বিবেকবান মানুষ। কোনো অন্যায় হলে প্রতিবাদ করেন। মুশতাক আহমেদও নিশ্চয়ই তাই করেছেন। রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গত বছরের মে মাসে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় কার্টুনিস্ট কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল ইসলাম এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য মিনহাজ মান্নানকে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। গত মাসে আদালতে দেয়া চার্জশিটে অব্যাহতি পেয়েছেন মিনহাজ মান্নান। দিদারুল ইসলামও জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে একই মামলা ৯ মাস ধরে কারাগারে ছিলেন মুশতাক এবং আছেন কিশোর। এই ৯ মাসে ৬ বার তাদের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন আদালত। তারা কী এমন অপরাধ করেছে, তারা কী এমন ভয়ঙ্কর ব্যক্তি যে তাদের জামিন দেয়া যাবে না? তবে মুশতাক আর জামিন চাইবেন না; চলে গেছেন চিরজামিনে, সব মামলা-মোকদ্দমার ঊর্ধ্বে।
গত মঙ্গলবারও আদালতে নেয়া হয়েছিল মুশতাক ও কিশোরকে। আদালতে বরং কিশোরকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। স্বজনরা জানিয়েছেন, কিশোরকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখা গেছে। গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কারণে তার পায়ে সংক্রমণ হয়েছে। কানে পুঁজ হচ্ছে। তার ডায়াবেটিস অনেক বেড়ে গেছে। চোখেও কম দেখছেন। তবে মুশতাকের স্বজনরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার আদালতে তাকে সুস্থই দেখাচ্ছিল। তাহলে একদিনের মধ্যে কী এমন হলো, যে মাত্র ৫৩ বছর বয়সী মুশতাক মাথা ঘুরিয়ে পরে মরে গেলেন। কোনো মানুষ যখন পুলিশ হেফাজতে বা কারা হেফাজতে থাকেন; তখন তার নিরাপত্তা বা চিকিৎসার সব দায়-দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশ হেফাজতে থাকা মানুষ ক্রসফায়ারে মরে যায়। কারাগারে থাকা সুস্থ সবল মানুষ হুট করে মরে যায়। ৫৩ বছর বয়সেও মানুষ হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোক করে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যেতে পারেন। তবে হাজতে বা কারাগারে কেউ মারা গেলে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে, জবাব সরকারকে দিতেই হবে। একটি প্রভাবমুক্ত তদন্ত, প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে মুশতাকের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। তবে স্রেফ লেখালেখির অপরাধে একটা মানুষকে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রাখা, বারবার জামিন প্রত্যাখ্যান করা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ারই সামিল।
তবে লেখক, সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না; এমনটা আমি মনে করি না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু দেখতে হবে তাদের অপরাধটা কী। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগটা সুনির্দিষ্ট নয়। এমনকি চার্জশিটেও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয়। এই মামলার চার্জশিট নিয়ে প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ফেসবুকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাক্ষী নিরাপত্তারক্ষী আর পিয়নরা। তবে ছয় সাক্ষীর পাঁচজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, তারা পুলিশের কাছে কোনো সাক্ষ্য দেননি। মুশতাক, কিশোর, দিদাররা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কী ষড়যন্ত্র করেছেন, সেটা পিয়ন, দারোয়ান আর নিরাপত্তা রক্ষীরা জানবেন কীভাবে? পুরো বিষয়টাই যে সাজানো তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। মুশতাক ফেসবুকে কী লিখতেন, কাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক কথা বলেছেন—সেটা জানতেন কি না? প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে তার বাসার নিরাপত্তারক্ষী এবং মামলার সাক্ষি জব্বার খান বলেছেন, ‘হেরা হইল গিয়া মালিক। আমি দারোয়ান। তারা কী করে, আমি ক্যামনে জানমু?’ ফেসবুক কী, সেটাই তিনি জানেন না। অথচ তাকেই করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ষড়যন্ত্র মামলার আসামী। মামলাটি যে কাচা হাতে সাজানো হয়েছে, তার আরেক প্রমাণ হলো, মামলার ছয় সাধারণ সাক্ষীর মধ্যে মধ্যে পাঁচজনের এবং র্যাবের একজন কনস্টেবলের নামে যে সাক্ষ্য রয়েছে, সেটার বক্তব্য দাঁড়ি-কমাসহ হুবহু এক।
সমস্যা হলো বাংলাদেশে বহুদিন ধরে সরকার বিরোধিতা আর রাষ্ট্র বিরোধিতাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার, সরকারের ভুল ধরিয়ে আমাদের দায়িত্বও। কিন্তু সরকার বিরোধিতাকে রাষ্ট্র বিরোধিতা বলে চালিয়ে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে ভিন্নমতকে দমন করা হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে। এরশাদ পতনের আগে-পরে রাজনৈতিক কার্টুন এঁকে তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন শিশির ভট্টাচার্য। তিনি অনেক আগেই কার্টুন আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন এই বাংলাদেশে কার্টুন এঁকে ব্যঙ্গ করা অপরাধ, সরকারের সমালোচনা করা অপরাধ। আমাদের সবার সহিষ্ণুতার লেভেল এখন শূন্য। রাজপথে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এখন স্মৃতি। সামাজিক যোগাযোগ। মাধ্যমকেও 'সহমত ভাই' বানানোর চেষ্টা হচ্ছে।
কারাগারে মুশতাকের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আমার খালি সুনীলের একটি কবিতার লাইন মাথায় ঘুরছে। মুশতাকের মৃত্যুর জন্য কেন জানি নিজেদেরই অপরাধী মনে হচ্ছে। আমরা যদি শুরুতেই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত কালো আইন প্রণয়ন করতে না দিতাম, যদি আইনটির ঢালাও অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে পারতাম, যদি মুশতাক-কিশোর-দিদার-মিনহাজদের গ্রেপ্তারের পর তীব্র প্রতিবাদে তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারতাম; তাহলে আজ মুশতাককে মরতে হতো না, তার স্ত্রী লিপাকে মানসিক ভারসাম্য হারাতে হতো না। এই দেশটা শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বিএনপির নয়, সাংবাদিকের নয়, শিক্ষকের নয়, ব্লগারের নয়, মুসলমানের নয়, হিন্দুর নয়; দেশটা আমাদের সবার। আমরা ভয়ে পালিয়ে বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে চাই না। আমরা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি সবার জন্য বাসযোগ্য হোক, নিরাপদ হোক। এখানে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকুক। উন্নয়নের পাশে থাকুক গণতন্ত্র, মানবাধিকারও। অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ করার সৎসাহস সবার থাকুক। আমার অধিকার ক্ষুন্ন হলে, কোনো অন্যায় হলে, কেউ বঞ্চিত হলে, লাঞ্ছিত হলে আমরা যেন চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে পারি; বলতে পারি মানি না।
লেখক: প্রভাষ আমিন,হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ