সাংবাদিক রোজিনা ইস্যুতে মাহফুজ আনামের প্রশ্ন, মতি চৌধুরীর অভিজ্ঞতা
সিনিয়র সাংবাদিক 'রোজিনা ইসলাম ইস্যুতে' জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সাংবাদিক ও সর্বস্তরের নাগরিকগণ দলমত নির্বিশেষে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন সিনিয়র-মোস্ট সাংবাদিক-সম্পাদকের দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ লেখা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
'ডেইলি স্টার' সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কেন তিনি ৩ দিন কারাগারে থাকবেন?’ জামিন পাওয়ার আইনগত অধিকারের বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আলোকপাত করে লিখেছেন, ‘প্রথমত একজন নাগরিক হিসেবে, তারপর একজন নারী হিসেবে এবং শেষতক একজন অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে রোজিনা জামিন পাওয়ার অধিকারী।’ তাছাড়া, কারো জামিন নাকচ করার তিনটি শর্তের উল্লেখ করে তিনি স্পষ্টতই মত দিয়েছেন যে, ‘তিনটি শর্তের কোনোটিই রোজিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’
একজন নেতৃস্থানীয় সম্পাদক হিসেবে তিনি আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, সাংবাদিকের অধিকারের প্রশ্নগুলোকে সামনে এনেছেন এবং রোজিনার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ফলে ‘করদাতারা লাভবান হয়েছেন’ উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘কারণ তাদের কষ্টে অর্জিত অর্থ থেকেই এই দুর্নীতি হচ্ছিল। তাত্ত্বিকভাবে, একটি সরকার, যারা কিনা সুশাসন এবং জনগণের অর্থের ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে, সেটিও এতে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে।’
মাহফুজ আনামের বিশ্লেষণ এটা প্রমাণ করেছে যে, সাংবাদিক রোজিনার কাজ রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ‘এ ধরনের অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা না থাকলে আমাদের দেশ আরও বেশি দুর্নীতিতে ডুবে যাবে এবং আমাদের সীমিত সম্পদের অপব্যবহার হবে। যে কোনও সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ ধরনের সাংবাদিকতা সব সময়ই প্রয়োজন।’
'মানবজমিন' প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী রোজিনা ইসলামের বিষয়টিকে ‘পঞ্চাশ বছরেও এমন দেখিনি’ শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন তার সুদীর্ঘ, বর্ণাঢ্য, পেশাগত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তার নিজের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের গোপন খবর বের করে প্রকাশ করার জন্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। শীর্ষ পর্যায় থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি সংবাদ সূত্র উল্লেখ করেন নি। এজন্য কেউ তার গলা টিপে ধরেনি এবং তথ্য পাচারের মামলাও করেনি। তিনি তৎকালীন সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন এবং তার এক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়।
মতিউর রহমান চৌধুরী উল্লেখ না করলে জানা যেতো না যে, আলোচিত খবরটির সত্যতা নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকে তার তৎকালীন সহকর্মী, বর্তমানে বার্তা২৪.কম-এর প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন। আলমগীর হোসেন নিশ্চিত করে দেওয়ার পরেই মতিউর রহমান চৌধুরী রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। সব জানার পরেও আলমগীর হোসেন কিন্তু তখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত খবরটি ছাপিয়ে কৃতিত্ব নিতে যান নি। পেশাদারিত্বের বিশুদ্ধ মূল্যবোধে তিনি থেকে যান পর্দার আড়ালেই।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের প্রচেষ্টার পরেও মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে যেমন, আলমগীর হোসেনের মাধ্যমেও প্রকাশিত স্পর্শকাতর খবরটির সূত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কিছু কখনোই প্রকাশ পায়নি সাংবাদিকতার পেশাগত মর্যাদা, পবিত্রতা ও নৈতিকতার কারণে। মতিউর রহমান চৌধুরী যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, ‘সে আমলে এতটুকু বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। এখন কারো সঙ্গে কথাই বলা যায় না।’
মতিউর রহমান চৌধুরী তার লেখা শুরু করেছেন এই বলে যে, ‘এ কোন বাংলাদেশ? পঞ্চাশ বছরে তো এমন দেখিনি। তথাকথিত গোপন নথি চুরি করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গলা টিপে ধরার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও তিনি যদি একজন নারী সাংবাদিক হন। রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তা দেখে দেশের মানুষ হতবাক, বিস্মিত।’ দুই প্রেসিডেন্টের আমলের দুটি ঘটনার চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়ে তিনি তার লেখার শেষে উল্লেখ করেন, ‘যথারীতি আমার এক্রিডিটেশন বাতিল হয়ে গেল। সচিবালয় যাওয়া বন্ধ। এখানেই কিন্তু শেষ। কোনও মামলা হয়নি, এ কারণে জেলেও যেতে হয়নি।’
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা সবাই দেখেছে। তাকে গলা টিপে ধরা হলো। হেনস্তা করে অসুস্থ শরীরে গভীর রাতে থানায় আটকে রেখে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হলো।
সাংবাদিক রোজিনার ইস্যুতে ধৈর্য ধরতে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোজিনার প্রতি যাতে অন্যায় না হয়, তা দেখছি।’ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ন্যায়বিচার পাবেন বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. আনিসুল হক।
সাংবাদিক রোজিনার মাসুম সন্তানটিও সবার মতোই ন্যায়বিচারের অপেক্ষা করছে।