ডিজিটাল বাংলাদেশ - 4G/5G মোবাইল প্রযুক্তি



প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের কাছে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই অর্জন আমাদের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে সুন্দর অর্জন। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার ফলেই আজ জাতি নতুন এক গৌরবোজ্জ্বল পথে দাঁড়িয়ে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য পূরণে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে দেশের সকল স্তরে। তবে এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরকে বেশ কিছু বাঁধা অতিক্রম করতে হবে।

দুর্বল ও ব্যয়বহুল নেটওয়ার্ক

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মাঝে অন্যতম হলো দেশের দুর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এই দিকটায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নেটওয়ার্ক ডরেডিনেস ইনডেক্স (NRI) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেটওয়ার্কের উন্নতির উপর ভিত্তি করে প্রতিবছর একটি র্যা ঙ্কিং তৈরি করে। ২০১৭সালে বাংলাদেশ NRI র্যাঙ্কিংয়ে ১৪৮টি দেশের মাঝে ১১২তম স্থানে রয়েছে।এই স্কেলে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ৩.৩। যেখানে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬৩ (স্কোর ৪.২), ভুটানের অবস্থান ৮৭ (স্কোর ৩.৮), ভারতের অবস্থান ৯১ (স্কোর ৩.৮) এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১১০ (স্কোর ৩.৪)।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/11/1541947056011.jpg

শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অভাবে দেশের সকল প্রান্তে থ্রিজি প্রযুক্তি ঠিকমত পৌঁছায়নি। যার ফলে থ্রিজি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা আমরা এখনো পাচ্ছি না। ফোরজি প্রযুক্তিকেও একই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে।

দক্ষিন ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক তুলনামুলকভাবে দুর্বল হলেও ইন্টারনেট সংযোগ আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ের তুলনায় বেশ ব্যয়বহুল। United Nations ESCAP এর জন্য প্রস্তুত করা এক রিপোর্টে বাংলাদেশের IP Transit Price উল্লেখ করা হয়েছে ব্যয়বহুল বা Expensive হিসাবে। বিভিন্ন কোম্পানির মাঝে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলেও ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন খরচ মানুষের আয়ের তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল (Very Expensive) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ভুটান ও ভারতের ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন ও সেটআপ খরচ যুক্তিসঙ্গত (Reasonable) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। শ্রীলংকার ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি Sufficient হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, যদিও সেখানে টেলিকম মার্কেটে প্রতিযোগিতা তুলনামুলকভাবে কম। শ্রীলংকার ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন ও সেটআপ খরচ মূল্যায়ন করা হয়েছে Affordable হিসাবে।

4G এবং LTE: নতুন যুগে পদার্পণ

3G সেবায় গ্রাহকরা কতটুকু সন্তুষ্ট তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মূলত দুর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা আর দেশের সকল প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার অভাবের ফলে 3G সেবায় আমাদের দেশের জনগণ যথেষ্ট লাভবান হতে পারেননি। বাংলাদেশ নতুন 4G প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করলেও দেশের সকল প্রান্তে শক্তিশালী ও দ্রুতগতির সেবা নিশ্চিত করার জন্য নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।

ইন্টারনেট প্রযুক্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকার ফলে 3G বা 4G এর মাঝে মূল পার্থক্য কি তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। 4G প্রযুক্তিতে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি হয় না, সেই সাথে কাঠামোগত অনেক পরিবর্তনও আসে। G দ্বারা Generation বা প্রজন্ম বোঝানো হয়। নতুন প্রজন্ম মানে উন্নত ইন্টারনেট গতি এবং নতুন সেবা। 1G এবং 2G দ্বারা যথাক্রমে অ্যানালগ ও ডিজিটাল মোবাইল প্রযুক্তি বোঝানো হয়। তবে 3G থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে আলাদা করা হয় ডাটা ট্রান্সফার করার রেট ও পদ্ধতি দ্বারা। সাধারণত পরবর্তী প্রজন্মে ডাটা ট্রান্সফার গতি বেশি থাকে। এই গতি বৃদ্ধির জন্য ডাটা ট্রান্সফার করার প্রোটোকল বা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা হয়।

International Telecommunication Union - Radiocommunication Sector (ITU-R) এর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, মোবাইল ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট সংযোগ 4Gহিসাবে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পিক স্পিড ন্যুনতম ১০০ মেগাবিট পার সেকেন্ড হওয়া উচিত, আর স্থির (stationary) ডিভাইসের জন্য তা ন্যুনতম ১ গিগাবিট পার সেকেন্ড হওয়া উচিত।২০০৮ সালে এই স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছিল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, কারন তখন সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছিল যে অদূর ভবিষ্যতেই এমন উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া সম্ভব হবে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/11/1541947031224.jpg

সেই সময়ে এত উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না, যার ফলে রেগুলেটিং বডি সিদ্ধান্ত নেয় যে LTE প্রযুক্তিকে যথেষ্ট উন্নত করা সম্ভব হলে তাকে 4G প্রযুক্তি বলে গ্রহন করা হবে। যার ফলে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান LTE (Long Term Evolution) প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে শুরু করে, কারন LTE প্রযুক্তিকে দ্রুত উন্নত করে তাকে 4G এর পর্যায়ে নিয়ে আসাটাই তখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায় ছিল। বিভিন্ন নেটওয়ার্ক কোম্পানি তাদের কানেকশনকে 4G LTE উপাধি দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে তাঁরা ইন্টারনেট সেবার চতুর্থ প্রজন্মে পৌঁছে গেছেন, যদিও তাদের ইন্টারনেট গতি ITU-R এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যথেষ্ট ছিল না। বর্তমানে LTE প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত হয়েছে, LTE-A (Long Term Evolution Advanced) প্রযুক্তির আপলোড ও ডাউনলোড স্পিড 4G এর স্ট্যান্ডার্ড এর প্রায় কাছাকাছি। 4G প্রযুক্তির অন্যতম পরিবর্তন হলো সার্কিট সুইচিং পদ্ধতি বিলুপ্ত করে ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP) ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। 3G প্রযুক্তিতে Spread Spectrum এর মত রেডিও টেকনোলজি ব্যবহৃত হত, যা 4G তে ব্যবহার হয় না। চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবায় তার বদলেOFDMA multi-carrier পদ্ধতিতে ট্রান্সমিশন সম্পন্ন হয়।

5G: ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা

২০২০ সালের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলো 5G প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে চলেছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদেরকেও 5G প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

5G দ্বারা আগামী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি বোঝানো হয় যা বর্তমান 4G প্রযুক্তির চেয়েও উন্নত।আগের সকল জেনারেশন বা প্রজন্মের মতই 5G এর মূল লক্ষ্য হলো মোবাইল কমিউনিকেশন আরো দ্রুতগতির করা এবং অনলাইনে থাকা ডিভাইসের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নেটওয়ার্ক আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করা।

এক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে মোবাইল ফোনের চাহিদা ছিল শুধুমাত্র কল দেওয়া, মেসেজ পাঠানো আর ওয়েব ব্রাউজিংয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাছে রয়েছে একাধিক স্মার্ট ডিভাইস যাদের প্রত্যেকটির ব্যান্ডউইথ ডিমান্ড অনেক বেশি। এইচডি কোয়ালিটিতে স্ট্রিমিং করার ক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ, চব্বিশ ঘন্টা সচল সিকিউরিটি ক্যামেরা, ইন্টারনেট সংযুক্ত গাড়ি, স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার মত স্মার্ট মেশিন এমনকি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির হার্ডওয়্যার থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে হলে দরকার অত্যন্ত দ্রুতগতির এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ যা বর্তমান প্রযুক্তি আমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে দিতে সক্ষম হচ্ছে না।

অনলাইনে ইন্টারঅ্যাকটিভ গেম বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এই ধরণের গেমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার গেমার একইসাথে খেলার জন্য সংযুক্ত হতে চায়। বিপুল পরিমাণ ডিভাইস থেকে প্রতি সেকেন্ডে অসংখ্য রিকোয়েস্ট পায় গেমিং সার্ভার, এবং প্রতিটি গেইমার চায় তার রিকোয়েস্ট যেন দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়। গোটা ইন্টারনেটের বর্তমান অবস্থাও অনেকটা এরকম। ইন্টারনেটে এখন বিলিয়নের অধিক ডিভাইস সংযুক্ত হচ্ছে। যার ফলে গোটা ইন্টারনেটের কাঠামো পুনরায় এমনভাবে সজ্জিত করতে হবে যেন ইন্টারনেটে সংযুক্ত এই বিপুল সংখ্যক ডিভাইসগুলো শুধু দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবাই না পায়, বরং একই সময়ে অসংখ্য ডিভাইসের কানেকশন বজায় রাখে অনেক বেশি কভারেজ প্রদান করতেপারে ।সেই লক্ষ্যেই 5G বা পরবর্তী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব।

বিভিন্ন G এর মাঝে মূল পার্থক্য কি তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।5G আসলে 4G এর পরবর্তী প্রজন্ম যা তার আগের প্রজন্মগুলোর মতই পূর্ববর্তী প্রজন্মকে প্রতিস্থাপিত করবে। 1G থেকে 4G পর্যন্ত আমরা কোন ধরণের সেবা পেয়েছি তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:

১. 1G মূলত অ্যানালগ সেলুলার ফোন সিস্টেমকে বোঝায়। একেবারে প্রথমদিকের এই ফোনগুলোতে একে অপরের সাথে কথা বলা ছাড়া তেমন কোন সুবিধা ছিল না।

২. 2G বা দ্বিতীয় প্রজন্মে উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন আসে তা হলো ডিজিটালাইজেশন। 2G দ্বারা ডিজিটাল সেলুলার ফোন সিস্টেম বোঝায়। 2G ব্যবহারকারীরা একে অপরকে এসএমএস ও এমএমএস পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন, সেই সাথে ইন্টারনেট ব্রাউজিং শুরু হয়েছে এই প্রজন্ম থেকে। 2G প্রযুক্তি থেকে কল ও টেক্স এনক্রিপশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। 2G এর জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস (GPRS) এর সর্বোচ্চ স্পিড ৫০ কিলোবিট পার সেকেন্ড (50 Kbps) এবং এনহ্যানচড ডাটা রেটস ফর জিএসএম ইভল্যুশন (EDGE) এর সর্বোচ্চ স্পিড ১ মেগাবিট পার সেকেন্ড (1 Mbps) ।

৩.2G ও 3G এর মাঝে আসে 2.5G এবং 2.75G যা মূলত 2G ও 3G এর মাঝে ব্রিজ হিসাবে কাজ করেছে। 2.5G তে নতুন প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যা পূর্বে ব্যবহৃত প্রযুক্তির চেয়ে অধিক সক্ষম হিসাবে প্রমানিত হয়েছে। 2.75G তে নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপর খুব দ্রুতই চলে আসে 3G প্রযুক্তি।

৪. ১৯৯৮ সালে 3G প্রযুক্তির উন্মোচন হয়। মোবাইল প্রযুক্তির মাঝে এটি তৃতীয় প্রজন্ম হিসাবে পরিচিত। 3G প্রযুক্তির ফলে ব্যবহারকারীরা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ উপভোগ করতে পারেন, যার মাধ্যমে ভিডিও কলিং এবং দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট ব্রাউজিং সম্ভব। 2G এর মতই 3G প্রযুক্তিও 3.5G এবং 3.75G তে উন্নীত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা পরবর্তী প্রজন্ম 4G আসার পথ সুগম করেছে। স্থির অবস্থানে থাকা ডিভাইসে3G প্রযুক্তির সর্বোচ্চ স্পিড প্রায় 2 Mbps আর চলন্ত গাড়িতে থাকা ডিভাইসে সর্বোচ্চ স্পিড প্রায় 384 Kbps।

৫.4G বা মোবাইল প্রযুক্তির চতুর্থ প্রজন্ম ২০০৮ সালে বাজারে আসে। 4G তে এইচডি মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্সিং, 3D টিভিসহ এমন বেশ কিছু সেবা পাওয়া সম্ভব যেগুলোতে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রয়োজন। যেসকল 4Gপ্রযুক্তিমার্কেটেরয়েছেতাদেরমাঝেWiMAX এবং LTEঅন্যতম। 4G LTE প্রযুক্তির সর্বোচ্চ স্পিড 5 Mbps হতে 12 Mbps পর্যন্ত হতে পারে।

এই সকল প্রযুক্তির সাথে 5G এর পার্থক্য কোথায়? 5Gপ্রযুক্তিতেমূলতঅত্যন্ত দ্রুতগতির ইন্টারনেট গতির পাশাপাশি ডাটা লোড নেওয়ার সময় (Delay) কমানোর উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক ইন্টারকানেক্টেড ডিভাইসের জন্য Delayকমানোঅত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ।

5G আমাদের যোগাযোগক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারবে। 5G এর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

১. শিক্ষা ক্ষেত্র:5G এর উচ্চগতি এবং Reliability এর ফলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। ২০১৩ সালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতি ৫৩ জন শিক্ষার্থীদের জন্য ১ জন শিক্ষক বরাদ্দ রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের দিকে শিক্ষকের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী যথাযথ শিক্ষা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আর ইচ্ছা বেশি তারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকায় চলে আসছে। কিন্তু এর ফলে প্রতিনিয়ত ঢাকায় চাপ বৃদ্ধি হচ্ছে। দেশের সর্বত্র শিক্ষার মতো সেবা পৌঁছে দিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ। দেশের সকল প্রান্তে শক্তিশালী ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অভাবে থেমে থাকবে না। শহরাঞ্চল থেকেই শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্লাস নিতে সক্ষম হবেন। 5G প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির ব্যাপক প্রয়োগ। অগমেন্টেড রিয়্যালিটি ডিভাইস ও ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হেডসেটের জন্য প্রয়োজন পড়ে অনেক বেশি ব্যান্ডউইডথ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির ব্যবহার করে শিক্ষা অর্জন অনেক বেশি আনন্দময় এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ করে তোলা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা তাদের চোখের সামনেই দেখতে পারবে বিজ্ঞান, ইতিহাস বা ব্যবসার নানা বিষয় যার ফলে তারা দ্রুত শিখতে সক্ষম হবে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Nov/11/1541946964218.jpg

২. চিকিৎসা ক্ষেত্র: ঘনবসতির ফলে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার নেই। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি ১২,৬৯০ জন মানুষের জন্য একটি ডাক্তার রয়েছে, যেখানে WHO এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রতি ১৪০০ মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার থাকা উচিত। উচ্চগতির ইন্টারনেট দেশের দূরদূরান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে শহরের ডাক্তাররা ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রামের রোগী দেখেত এবং পরামর্শ দিতে পারবেন। এছাড়া ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা আধুনিক উপায়ে মেডিক্যাল শিক্ষা অর্জন করতে পারবেন।

৩. ড্রাইভারবিহীন গাড়ি: উন্নত দেশগুলোতে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। চালকবিহীন গাড়ির অন্যতম বড় ঝুঁকি হলো হঠাৎ করে কোন বিপত্তি আসলে সেটা সামলানোর ভাল উপায় বের করা। চালকবিহীন গাড়িতে যেহেতু গাড়িকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাই গাড়ির দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজন উচ্চগতির ও রিলায়েবল ইন্টারনেট সেবা।

৪. ইন্টারনেট অব থিংস ও কানেক্টেড ডিভাইস: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য বস্তু বা ডিভাইস ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। কৃষকেরা যেমন ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করে ক্ষেত ও খামারের আদ্রতা, ফসলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে পারেন, তেমনই গাড়ি চালকরা জানতে পারেন যে রাস্তায় জ্যাম আছে কিনা। এই ডিভাইসগুলোর প্রয়োজন হয় রিয়াল-টাইম ডাটা অ্যানালিটিক্স, যা কিনা উচ্চগতির ইন্টারনেট ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়।

৫. ব্যক্তিগত চাহিদা ও বিনোদন: সময়ের সাথে সাথে ডাটার প্রতি মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ভিডিও কনফারেন্সিং, ফাইল ডাউনলোড, অনলাইনে মুভি স্ট্রিমিং, এইচডি ও 4K কোয়ালিটির মিডিয়া শেয়ার করাসহ বিভিন্ন কারনে মানুষ এখন আগের চেয়েও উচ্চগতির ইন্টারনেট চায়।

5G প্রযুক্তির স্পিড কত হবে? 5Gপ্রযুক্তির জন্য প্রতিটি মোবাইল স্টেশনে ন্যুনতম যে পিক ডাটা রেট থাকা প্রয়োজন তা দেওয়া হলো:ডাউনলোড স্পিড: 20 Gbps এবংআপলোড স্পিড: 10 Gbps. তবে এই স্পিড বেজ স্টেশনের সাথে সংযুক্ত সকল ব্যবহারকারীর কাছে ভাগ করে দেওয়া হবে, যার ফলে প্রতিটি ব্যবহারকারী যে স্পিড উপভোগ করতে পারবেন তা হলো: ডাউনলোড স্পিড:100Mbps এবং আপলোডস্পিড: 50Mbps. যার ফলে একজন ব্যবহারকারী 3GB এর কোন ফাইল মাত্র ৪ মিনিটেই ডাউনলোড করতে সক্ষম হবেন।5G প্রযুক্তি প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ মিলিয়ন কানেক্টেড ডিভাইসকে সাপোর্ট দিতে পারবে। যার ফলে ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাতেও উচ্চগতির নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া সম্ভব। 5G প্রযুক্তির ল্যাটেন্সি (Latency) মাত্র ৪ মিলিসেকেন্ড। ল্যাটেন্সি দ্বারা বোঝানো হয় সেল টাওয়ার থেকে ডাটা ব্যবহারকারীর মোবাইলে পৌছানোর জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন হয়।

 প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

   

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৬ মে, ১৯৭৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। সারাদেশে এবছর বৈরী তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় প্রতিটি জীব-প্রাণের মধ্যে ত্রাহি অনুভব শুরু হয়েছে।

শহুরে বিত্তশালী মানুষ শীতাতপ যন্ত্রের ঘেরে বসে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু শহুরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের রৌদ্রজলা মানুষেরা এবছর বেশি নাকাল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের পানির আকাল। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি।

মাওলানা ভাসানি কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে উজান-ভাঁটি দুই দেশের মানুষের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে এজন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশ বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানি এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।

মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দু:খ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।” (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।”... “বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি... সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বন্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।”

এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন।

এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।

মাওলানা ভাসানির বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”

বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তরে গঙ্গা চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাঁটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।

অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। গবেষণার সেসব ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো বিকার কোনো কালেই লক্ষ্য করা যায় না।

এমনিকি তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং-সেনিার, চুক্তি হওয়ার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানির সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি।

আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানির মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দূরদৃষ্টি, দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

রাজনীতির বিভক্তি: মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়নে যে তাগিদ বিশ্লেষকদের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। গেল ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আইলিন লাউবাখেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সফরের পর ডোনাল্ড লু’র এই সফর দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। মি. লু’র এই সফরকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাক্যবাণ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করেছেন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশকে বিদ্যমান এই সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকেই জোর দেওয়া উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও কুটনীতিক অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ডোনাল্ড লু’র এই সফর নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘নতুন সরকার আসার পর ডোনাল্ড লু’র এটি অফিসিয়াল লেভেল রুটিন ভিজিট। আমার মনে হয় নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অংশই এই সফর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোন মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার এই সফরটা হচ্ছে।’

‘তিনি কি বলবেন এই সফরের পর হয়ত জানা যাবে, তাই পূর্বমূল্যায়ন না করেও দৃশ্যত যেটি বোঝা যাচ্ছে, মি. লু’র এই সফর বাংলাদেশকে নতুন করে স্টাডির অংশ। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করবে। আশা করব, দুই দেশই সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে একে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না’-যোগ করেন সাবেক এই পেশাদার কুটনতিক।

বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আরও পরিণত চর্চার তাগিদ দিয়ে একুশে পদকজয়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘নানা বিষয়ে মতামত-মন্তব্য করাটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। এখানে কেউ পরিপক্কভাবে দিতে পারে, কেউ পারেন না। আমেরিকা যেহেতু বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও সেইসব সংস্থার থেকে সাহায্য নিচ্ছে; তাই সচরাচর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক বর্ধিত, এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের রাজনৈতিক চর্চা করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একধরণের দৃশ্যমান এজন্ডা তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) আছেই, যেমন-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করাটাও তাদের রীতি। আবার সম্পর্কটাকে চালিয়ে নেওয়াও তাদের বৈশিষ্ট্য। ডোনাল্ড লু এসেছেন হয়ত সেই চাপকে অব্যাহত রাখতেই। তার মানে এই নয় যে-বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে চলমান সম্পর্ক সেখানে তাত কোন প্রভাব পড়বে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে যেটি দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে রয়েছে। আমেরিকাও তৃতীয় আরেকটি শক্তি-সেই দিক থেকে এটা ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুবিধাও বটে।’

‘বাংলাদেশের তো এখন উপায় নেই-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে। বাংলাদেশ যদি মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দেশ হতো তাহলে হয়ত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ঢুকে গিয়ে চলার কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বড় দেশ। রাজনৈতিক আকাঙ্খাও বহুমুখি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মালদ্বীপের মত স্ট্যান্ড নেওয়া সম্ভব নয়’-বলেন প্রভাবশালী এই কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও। সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

;