বাস মালিকরা গরিব হলে ধনী কারা?
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। হাল ফ্যাশনের গাড়ি-বাড়ি বেড়েছে। বিদেশিদের অনুকরণে নানা মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে। শুধু গাড়িই নয়-বিদেশি ট্রেনের বগী, বিলাসদ্রব্য, খাদ্রসামগ্রী, পোশাক, মাদক, কুকুর, পাখি সবকিছুই এখন হাতের কাছে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশি কর্মীদের আনাগোনা বেড়েছে। তাই বিদেশি দামী হোটেল-রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও অগণিত। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়-সারা দেশে এসব কিছুর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আমরা বড়লোক হয়ে গেছি। একজন কলামিষ্ট এতকিছু লক্ষ্য করে ইতোমধ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, “মাননীয় মন্ত্রী, বড়লোক বাংলাদেশে আমার অবস্থান কোথায়?”।
তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমাদের ষোল কোটি মানুষের সবার দৈনিক আয়কে গড় করলে সাড়ে তিন কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ, ৪০ লক্ষ শিক্ষিত বেকার, ৬০ লক্ষ অর্ধশিক্ষিত বেকার, পরিসংখ্যানবিহীন অগণিত নদীভাঙ্গা মানুষ, টোকাই, ভাসমান মানুষ, ভিক্ষুক, পতিতা, ভবঘুরে, রাতের খাবার না খেয়ে রেল বা বাস স্টপে ঘুমানো ভূখা মানুষরা তার মনের মধ্যে অবস্থান করছেন। তিনি তাদেরকে তার নিজের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়ে নিজের অবস্থানের কথা জানতে চেয়েছেন নির্দ্বিধায়।কারণ, দেশটা তো সবার। কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় গানের কথায়- “আমারই দেশ সব মানুষের...ধনীদের, গরীবের, কামারের, মজুরের।”
সম্প্রতি ময়লার ট্রাকের চাপায় কলেজ ছাত্রের পিষ্ট হয়ে অকালে মৃত্যুবরণের ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। যখন জানা গেল ময়লা পরিষ্কারের জন্য নিয়োজিতরা মূল ঠিকাদারদের সাব-অতিসাব ঠিকাদারী ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে বাগিয়ে নেয়। মূল ড্রাইভার রাজা সেজে ঘরে শুয়ে আয়েশ করেন। তার পরিবর্তে ময়লা সরানোর ট্রাক চালানো হয় হেল্পার দিয়ে। যাদের প্রায় সবাই লাইসেন্সবিহীন। এসব অভিজ্ঞতাহীন, সনদবিহীন চালকরা আজ মৃত্যুদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পথচারীদের প্রাণ হরণে নেমে পড়েছে। আনাড়ি ও অবৈধ চালকের হাতে চাবি দিয়ে ভারী ময়লার ট্রাক চালানোর কাজ করানোর জন্য প্রায়শই করুণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে।
নভেম্বরের শেস সপ্তাহে নটরমেরে নাঈমের রক্ত রাজপথে না শুকাতেই একরামুন্নেছা স্কুল ও কলেজের দুর্জয়কে পিষে দিয়েছে ঘাতক ময়লাবাহী ট্রাক। ২৯ নভেম্বরে চট্টগ্রামে ভাড়া নিয়ে বস্চার জেরে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে পিছনের চাকায় পিষ্ট করে মারাত্মক জখম করে দিয়েছে এক স্কুল শিক্ষককে তিন পাষন্ড। তিনি এখন মৃত্যু শয্যায়। যারা এই অপরাধ করেছে তারা তিনজন বাসের কন্ডাকটর, হেল্পার ও ড্রাইভার। তারা তিনজনই মাদকাসক্ত বলে টিভিতে জানা গেছে এক পুলিশের মুখে। অথচ, মাদকসেবী এরাই নাকি পরিবহণ সেবক!
নভেম্বরের ৩০ তারিখে রামপুরায় এক স্কুলছাত্রকে পিষ্ট করে মেরে ফেলেছে আরেক বাস। ছাত্র-জনতা বাসটি আগুনে পুড়ে দিয়েছে। রাস্তা অবরোধ করে রেখে যানজট তৈরী করেছে। অপরদিকে কর্ধিত বাসভাড়া বাতলের দাবীতে ছাত্র -ছাত্রীদের প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে শুধু ঢাকা শহরে হাফ ভাড়ায় শিক্ষার্থীদের চলাচলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার ঘোষণা দিয়েছে বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি। তাহলে সারা দেশের কোটি শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে কেন বঞ্চিত হবে? তিনি দু’দিন আগে বলেছিলেন, ৮০ ভাগ বাস মালিক গরীব। বাস ভাড়া কমালে তারা পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবে। এখন হাফ ভাড়ার সিদ্ধান্ত নেবার ফলে কতজন না খেয়ে মারা যায় অথবা ভবিষ্যতে এরুপ কিছু ঘটে কি -না তা দেখার বিষয়।
কয়েক বছর আগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এলাকার রমিজ উদ্দিন স্কুল-কলেজের সামনে একই ঘটনা ঘটিয়েছিল দ্রুতগামী বেপরোয়া লাইসেন্সবিহীন বাসচালক। এ বছর নভেম্বরে ঘটলো পর পর দুটো মৃত্যুর ঘটনা- যা ময়লাবাহী ট্রাকের কারণে ঘটেছে।
গত বছর নভেম্বরের ২৯ তারিখে আরো একটি মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীতে বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে আনাড়ি চালকের ভুলের কারণে। গাড়ি চালকদের ১,২,৩, নম্বর ধারী লাইসেন্স ছাড়াও প্রিকোয়ালিফাইড লাইসেন্স দেবার বিধান রয়েছে। অনেকে নতুন গাড়ি কিনে লাইসেন্স পবার আগেই অন টেস্ট লিখে জনবহুল রাস্তায় নেমে পড়েন। আমাদের দেশে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ নিজেরা গাড়ি চালায় না। তারা ঠিকাদারদের মাধ্যমে দৈনিক বা রুট ভিত্তিতে দায়িত্ব দিয়ে কাজ করান। বিআরটিসি গাড়ি রাস্তায় বেশী বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। যারা এই গাড়ির যাত্রী তারা বিষয়টি ভালভাব অনুধাবণ করে থাকেন। এছাড়া রাস্তায় চলাচলের সময় সবচেয়ে বেশী নষ্ট হয় এই গাড়ি। তাই সরকার এই গণপরিবহণ থেকে বিপুল পরিমাণ মেইন্টেন্যান্স খরচ দিয়ে লাভের মুখ দেখতে পান না। তবুও এই গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে এবং কিছুদিন পরই নতুন গাড়ি অকেজো হয়ে ডিপোতে ডাম্পিং-এ চলে যায়। সাজঘর থেকে ফেরে না সিংহভাগ গাড়ি। তখন পুনরায় নতুন দামী গাড়ি বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণ মূল্য দিয়ে ক্রয় করা হয়। সরকারের লোকসানের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। যেমনটি ঘটে চলেছে ডেমু ট্রেনের ক্ষেত্রে। এজন্য বিশেষ নজর দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। আরো যে বিষয়টি বেশী উদ্বেগজনক তা হলো- একজনের ট্রেড লাইসেন্স বেনামীতে ভাড়ায় খাটানো।
স্থায়ীভাবে চাকুরীপ্রাপ্ত বা তালিকভূক্ত ঠিকাদারদের অনৈতিকভাবে ঠিকাদারী লাইসেন্স ভাড়া দেয়া বা লিজ দেয়া বন্ধ হলে রাস্তায় আনাড়ি চালকদের মাধ্যমে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ ও ভুয়া সনদ প্রাপ্তির কারবার বন্ধ করা গেলে এবং সকল চালকদের জন্য ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। জাপানের মত হাইওয়ে পুলিশের হাতে স্বয়ংক্রিয় মাদক ডিটেক্টর মেশিন সরবরাহ করতে হবে এবং সৎ অফিসারদের মাধ্যমে হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট বা বিশেষ বিশেষ স্থানে হঠাৎ ডোপ টেষ্টের মোবাইল আয়োজন করে সড়ক দুর্ঘটনা শূণ্যের কোঠায় নামানো যেতে পারে।
কারণ, বাংলাদেশ এখন মাদকের বড় ভোক্তার দেশ। এর সিংহভাগ ভোক্তারা দূরপাল্লার গাড়ির চালক। তাদেরকে চিহ্নিত করে সংশোধন করতে না পারলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করে অবসরে পাঠাতে হবে। ঠিকাদারী সনদ যদি ভাড়ায় খাটে তাহলে বেকার যুবকদের বিভিন্ন ডিগ্রির সনদ ভাড়া দিতে দোষ কোথায়? ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি, ভোট চুরি ডাকাতি, পেশী শক্তিকে লাই দেয়া ইত্যাদি সকল অনৈতিক কর্মকান্ডকে বৈধতা দিয়ে দিলে তো আর কোন কিছুকেই অবৈধ বলে দোষারোপ করার সুযোগ থাকবে না! এসবের জন্য কোন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজন থাকবে না।
গত বছর কুমিল্লার এক আদালতের কর্মচারী অবৈধ কাজ করে ধরা পড়ে আক্ষেপ করে বলেছিল ‘বস অনেক ঘুষ খেলে ক্ষতি নেই আমি একটু খেয়েছি তাতে দোষের কি দেখলেন?’ এটা কোন কথার কথা নয়। এই আক্ষেপের কথাটিতে আমাদের দেশের বড় বস বা লোকদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদের উপর একটি বিরাট দাগকাটা উদাহরণ বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। তবুও সেসব ঘৃণ্য অপরাধীদের হৃদয় সীলমারা। তারা নিজের লাভটাই আগে দেখেন।
যেমন ছাত্রদের ভাড়া কমানোর আন্দোলনে বক্তব্য উঠে এসেছে- ঢাকা বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারির ভাষায়। তিনি বলেছেন, দেশের ৮০ ভাগ বাস মালিক গরীব! তাই যদি হয়, তবে মেয়াদউত্তীর্ণ বাস চালিয়ে কেন পরিবেশ দূষণ করেন? মাদকসেবী চালক দিয়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ হত্যা করেন? বাস-ট্রাক বাদ দিয়ে রিক্সা চালালেই তো দুর্ঘটনা হবে না। কোটি কোটি টাকায় কেনা নতুন নতুন মডেলের বাস মালিকরা গরীব হলে দেশের বিত্তশালী কারা? বাস মালিকরা কি বস্তিতে থাকেন? তাদের বসতবাড়ি ও ব্যক্তিগত গাড়ির মডেল কেমন তা সবাই জনেন। যদি বাস মালিকরা গরীব হয় তাহলে দেশের ভিক্ষুকদের তো নিজস্ব মার্সিডিজ বা হেলিকপ্টার থাকার কথা। বাস মালিকরা গরীব হলে ভিক্ষুকরা কি মার্সিডিজে চড়ে?
আর ছাত্রদের হাফ ভাড়ায় স্কুল-কলেজে যাবার সুযোগ না দিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোকদেরকে বিনা ভাড়ায় গরীব বাস মালিকরা কোন স্বার্থে চলাচলের সুযোগ দান করেন-তা মোটেও বোধগম্য নয়! প্রবাদে সাধে কি একেই বলে ড্যাশ ড্যাশ মাসতুতো ভাই? আমরা ৮০ ভাগ জনতা গরীব বাস মালিক হতে চাই। তাহলে গরীবের আত্মমর্যাদা স্বীকৃতি পেয়ে একটি কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
*লেখক সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়