দর কষাকষির মাঠ তৈরিতে জামায়াত
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমানের এক বক্তব্যে বিএনপি-জামায়াতের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোটের সমাপ্তি দেখেছিলেন অনেকেই। কিন্তু বাস্তবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। এনিয়ে বিএনপি যেমন আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিক্রিয়া দেয়নি, তেমনি দেয়নি জামায়াতে ইসলামিও। দলটির শীর্ষ নেতার এমন বক্তব্যের পরেও দলের আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য না আসায় এটা প্রমাণ হয় ওই বক্তব্যটি ছিল স্রেফ ‘কথার কথা’।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিয়োর সূত্রে জামায়াত-বিএনপির বন্ধন-ছিন্নের এই আলোচনা সামনে আসে। গত ১৪ আগস্ট জামায়াতে মজলিশে শূরার এক বৈঠকে দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ দলীয় জোট আর কার্যকর নেই। বিএনপি এই জোট কার্যকর করতে চায় না। বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। এর সঙ্গে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব’। এটা সকলের জানা যে, বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ও ইসলামি ঐক্যজোটের সমন্বয়ে ১৯৯৯ সালে গড়া জোটের মাধ্যমে একবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর এক পর্যায়ে ভাঙন ধরেছে। জাতীয় পার্টি ও ইসলামি ঐক্যজোটের একাংশ জোট ছেড়েছে, এরপর নামসর্বস্ব বেশ কিছু দল নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে জোট হয়েছে। দল বাড়তে বাড়তে ওই জোটে বিশটি দলও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরপর সেই জোটের একাধিক দল জোট ছেড়েছে, জোট নিষ্ক্রিয় হয়েছে। এরইমাঝে একাদশ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত থাকায় জামায়াতকে কামাল হোসেন জোটে নেননি, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতও এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। বিবিধ সমালোচনা থাকলেও দলটির একাধিক নেতা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
জামায়াতের আমিরের সাম্প্রতিক বক্তব্য দলটির বিবেচনায় বঞ্চনা থেকে উঠে আসা ‘অভিমান’। জোটের বড় শরিক হিসেবে জামায়াত বিএনপির কাছ থেকে যতখানি চেয়েছিল ঠিক ততখানি পায়নি বলে ধারণা তাদের। এই অবস্থায় তারা অভিমানে কিছুটা দূরে আছে সত্য, তবে এই অভিমান বিচ্ছেদের পর্যায়ে আসেনি এখনও। রাজনৈতিক অঙ্গনে বড়ধরনের কোন মেরুকরণ না হলে নিকট ভবিষ্যতে এই সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলে ধারণা করা যায়। কারণ তাদের এই জোট কেবল রাজনৈতিক জোটই নয়, এটা মূলত আদর্শিক জোট। ডানপন্থী রাজনীতির জোট। দুই দশকের বেশি সময় ধরে একই জোটে থেকে তাদের আদর্শিক মিথস্ক্রিয়া এতখানি হয়েছে যে এক দল ব্যতিরেকে অন্য দলের কল্পনাই কঠিন।
জামায়াত মনে করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বড় শরিক হিসেবে তারা বিএনপির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন-সহায়তা পায়নি। একইভাবে বিএনপিও মনে করে রাজপথের আন্দোলনে তারা জামায়াত-শিবিরের পেশিশক্তির প্রয়োগ দেখতে পায়নি। এখানে পরস্পরের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি সেটা মূলত বিষয়ভিত্তিক। যেখানে আদর্শের সংশ্লেষ নেই। জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় মূল্যবোধের পাঁচমিশেলি যে লক্ষ্য তাদের সেখানে তাদের এক দলকে অন্য দল থেকে পৃথক করা মুশকিল। চলমান দূরত্ব তাদের আদর্শের নয়; পাওয়া না পাওয়ার। একে অন্যের কাছ থেকে যা আশা করেছিল তার কিছু মেলেনি বলে সময়ের প্রয়োজনে তারা দূরে গেছে, আবার সময় হলেই ঠিক একই জায়গায় এসে দাঁড়াবে।
রাজনীতির মাঠ এমনই যে এখানে নামলেই নেতা তার সমর্থকেরা মনে করে এই বুঝি মন্ত্রী-এমপি হয়ে যাচ্ছে। নবগঠিত গণ-অধিকার পরিষদকেই দেখুন তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হবে তারাও বুঝি ক্ষমতায় চলে যাচ্ছে! ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর, রেজা কিবরিয়া, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ আব্দুর রহিম সাকি কিংবা নামসর্বস্ব কোন সংগঠনের বড় কোন নেতার বক্তব্যেও এমন প্রমাণ মেলে প্রায়ই। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? ইতিহাস তো এমন বলে না!
স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশের রাজনীতির বর্তমান যে ধারা তাতে হয় আওয়ামী লীগ, নয়তো বিএনপি। এরবাইরে আর কারো সুযোগ নেই বললেই চলে। সাধারণ ভোটাররাও এই দুই দলের বাইরে আর কাউকে তেমনভাবে চেনে না, চিনতেও চায় না। এই দুই দলের বাইরে কোন প্রার্থীকে ভোট দেওয়া মানে ‘ভোট নষ্ট হয়ে যাওয়া’ এমন জোর ভাবনা দেশজুড়ে। সাধারণ ভোটারেরা যেখানে দুই দলে বিভক্ত সেখানে অন্যদের সুযোগ আদতে থাকে না। তা সে জাতীয় পার্টি হোক কিংবা অন্য যে কোনো দলই হোক।
জামায়াতে ইসলামি এককভাবে ক্ষমতায় কোনোদিন যায়নি, যাওয়ার সম্ভাবনাও (আশঙ্কা) নেই। এমনিতেই দলটির নিবন্ধন নাই নির্বাচন কমিশনে, তারপর নাই ক্ষমতায় যাওয়ার মতো জনসমর্থন, তার ওপর আছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণিত দায়। তারা নিজেরাও জানে স্বনামে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের নাই। এমনকি ভিন্ন নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব না। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে তাদের নেতাদের হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হবে, নয়তো বিএনপির প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। বিএনপির প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের আনুগত্য তাদের অবশ্যম্ভাবী, এর অন্যথা আইনত অসম্ভব। দৃশ্যত কঠিন রাজনৈতিক পরিবেশেও তারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু জনসমর্থন ও ভোটের রাজনীতির দিক থেকে তারা এখনও বেশ পিছিয়ে।
নিজেদের রাজনৈতিক দুর্বলতা, ভাবমূর্তি সংকটসহ সার্বিক অবস্থা জানে জামায়াত। তবু হঠাৎ কেন জোট ছাড়ার ইঙ্গিত তাদের; এই প্রশ্ন অনেকের। উত্তর খুব সহজ। সামনে নির্বাচন। আগামী বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে জোটের মধ্যে বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে তারা দর কষাকষির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। একইসঙ্গে জোট ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে তারা সরকারের আনুকূল্য পেতেও চাইছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার সম্ভাবনাও হয়তো দেখছে তারা কারণ বিগত দুই সাধারণ নির্বাচন, যেখানে সরকারপক্ষ নামেমাত্র একটা বিরোধীদল দাঁড় করিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছে। এই পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ কিছু আসন তাদের মিত্রপক্ষ অথবা বিরোধীপক্ষ ‘দিয়েছে’ বলে এমন ধারণা সকল মহলে। এখানে জামায়াত বিএনপি ও সরকারপক্ষের মধ্যে দর কষাকষির একটা ক্ষেত্রে প্রস্তুত করছে বলেই ধারণা। যেখানে তাদের লাভের সম্ভাবনা বেশি সেদিকেই তারা পা বাড়াবে। আওয়ামী লীগ সমঝোতা করবে কি-না এনিয়ে যদিও প্রশ্ন আছে তবু জামায়াতে ইসলামি তাদের রাজনৈতিক চাল দিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে এটা বিটিভির একক আমলের সেই লটারির টিকেটের প্রচারণার মতো- ‘যদি লাইগ্যা যায়’! তবে আওয়ামী লীগের কাছে ‘লাইগ্যা’ না গেলেও এটা বিএনপির কাছে ‘লাইগ্যা’ যেতেও পারে; এ সম্ভাবনা অনেকটাই! সম্ভাবনা জোরালো হয় যখন বিএনপি মহাসচিব জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ সত্যি হয়েছে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাফ বলে ওঠেন, ‘আমি কিছু বলব না, আপনারা যা ইচ্ছা লিখেন’!
জামায়াতের আমির নিজেদের সাংগঠনিক কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের কথা যতই বলুন না কেন এটা এখন পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত মন্তব্য হিসেবেই থাকছে, কারণ দলটি আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। বিএনপিও এনিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি, এমনকি দলটির মহাসচিব এনিয়ে কোন মন্তব্য করতেই নারাজ। সুতরাং সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, এটা বলার সময় এখনও আসেনি। আমাদের ধারণা এই সম্পর্ক ছিন্নও হবে না। কারণ বিএনপির জোট ছাড়লে জামায়াতে ইসলামি সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ‘নাই’ হয়ে যাবে।
এখানে যে আশঙ্কা সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনের প্রয়োজনে জামায়াতে ইসলামিকে বিএনপি থেকে আলাদা করে অন্য কোনো জোটের অংশীদার হওয়ার পথ দেখাবে? এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এখনও যদিও তবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামির রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন না থাকায় দলটি অন্য কোথাও গেলেও ভোটের মাঠে প্রভাবের দিক থেকে শূন্যের কাতারে নেমে যাবে। এখানে অবশ্য ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলকে এক করে অথবা জাতীয় পার্টি কিংবা চরমোনাই পিরের ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্বে কোন জোটে জামায়াতে ইসলামির অন্তর্ভুক্তি হতেও পারে। তবে চরমোনাই পিরের অথবা কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জোটে জামায়াতের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও ক্ষীণ, কারণ ধর্মভিত্তিক এই দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের আদর্শিক দূরত্ব অনেকখানি। যদিও অনেক ইস্যুতে তারা বেশ ক’বছর ধরে এক সুরে কথা বলছে তবু তাদের বৈরিতা ঐতিহাসিক! এছাড়াও আওয়ামী লীগ হয়তো চাইবে না জামায়াত-বিএনপি আলাদা হোক, কারণ দল দু’টি আলাদা হলে তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক দোষারোপের একটা বিষয়ও হারিয়ে যেতে বসবে।
জামায়াতের একাংশের কিছু নেতা ক’বছর আগে এবি পার্টি নামের এক রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। ওই দলেরও নিবন্ধন নেই ইসিতে। জামায়াতে ইসলামি চাইলেও এবি পার্টির নামে নির্বাচন করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তাদের একটাই পথ, এবং সেটা বিএনপি। এখন এই যে ভাঙনের গল্প, এই যে সম্পর্কচ্ছেদের ইঙ্গিত এটা আদতে কৌশল; দর কষাকষির কৌশল। জামায়াতের আমিরে যে বক্তব্য সেটা ক্ষোভ থেকে নয়, বরং ‘অভিমান’ থেকে। আর কে না জানে ক্ষোভ আর অভিমানের পার্থক্য; সম্পর্কের গভীরতায় ‘অভিমান’ আসে, ক্ষোভ নয়। জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক আদর্শিক গভীরতার!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।