যে নামেই আসুক জামায়াত জামায়াতই
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দলীয় সিদ্ধান্তে জড়িত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নাই নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। হাই কোর্টের আদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দলটির নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা হয়, এরপর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপনে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাই কোর্টে দেওয়া ওই রায়ের পর দলটি এরপর আর দলের নাম আর প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। ইসিতে নিবন্ধন না থাকলেও দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে নেই। গোপনে সংগঠিত তারা, কিছু কর্মসূচিও পালন করে প্রকাশ্যে দলের ব্যানারে।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল করা আছে। তার শুনানি হয়নি এখনও। স্বাভাবিকভাবেই তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে না। সম্প্রতি বিএনপির এক নেতা তাদের জোটে জামায়াতের না থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন, যদিও দল দুটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেনি। এখন পর্যন্ত যা কিছু শোনা যাচ্ছে তার সবটাই অনানুষ্ঠানিক।
জামায়াতের নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ভোট বিএনপির প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হয়, এমন ধারণা অনেকের। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির জোটসঙ্গী ছিল জামায়াত। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল তারা। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছিল। জোটসঙ্গী হয়ে জামায়াত পেয়েছিল অনেকগুলো আসন। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়। ওই নির্বাচনকে বানচাল করতে সারাদেশে যে আন্দোলন হয় সেখানে পেট্রোল বোমা, আগুন সন্ত্রাসে অগ্রণী ভূমিকা রাখে এই জামায়াত। তবে এর সবটাই দায় গিয়ে পড়ে বিএনপির ওপর।
নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যেই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বেশ কজন যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন, দণ্ড মাথায় নিয়ে জেলখানায় মারা গেছেন যুদ্ধাপরাধের সাইনবোর্ড গোলাম আযম, আবদুল আলীমসহ কয়েকজন। আরও অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারিক কার্যক্রম চলমান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলীমসহ কিছু যুদ্ধাপরাধী ছাড়া শীর্ষ সকল যুদ্ধাপরাধীই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক রায়ে আদালত যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করা নিয়ে আলোচনাও আছে সকল মহলে।
ইসিতে নিবন্ধন হারালেও থেমে থাকেনি জামায়াত। তারা গত নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। জামায়াত নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সকল পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়নি। তবে এবার আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত বাংলাদেশ ডেভোলাপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন দল গঠন করেছে। বুধবার (২৬ অক্টোবর) নতুন দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদনও করেছে। নতুন দলটি অন্য নামে মূলত জামায়াত তা বিভিন্ন গণমাধ্যম পরিচয়প্রকাশ সূত্রে জানা যাচ্ছে। বিডিপি যাদেরকে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলে উল্লেখ করেছে তারা হচ্ছেন জামায়াতঘনিষ্ঠ অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চাঁন ও ছাত্রশিবিরের সাবেক বিদেশবিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমানে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদের সদস্য কাজি নিজামুল হক নাঈম।
জামায়াত বিডিপি নামে নতুন দল গঠন করে আবেদনের পর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নতুন আবেদনের বিষয়ে শুরুতেই ইতিবাচক কথা বলে দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কোর্টের আদেশে বাতিল করা হয়েছে। কেউ নিবন্ধিত হতে চাইলে নতুন করে নিবন্ধন নিতে হবে। জামায়াতের নতুন দলে যদি কোনো যুদ্ধাপরাধী না থাকে এবং তাদের গঠনতন্ত্র যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে বাধা নেই’। মো. আলমগীর আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গঠনতন্ত্র নিয়ে কেউ আবেদন করলে তাদের নিবন্ধন দেয়া হবে না’।
জামায়াতের নতুন নামে নিবন্ধনের বিষয়ে ইসির ইতিবাচক অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলটি জামায়াত বলে আলোচনার পরেও কেন বিতর্কিত এই আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করা হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী, দলীয় সিদ্ধান্তে তারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, একইভাবে এখনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অবস্থান বিতর্কিত। এরআগে আমরা একাধিকবার দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে শুনেছি নাম পাল্টালেও জামায়াতের নিবন্ধনের ব্যাপারে যৌক্তিক এবং কঠোর বার্তা, কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হলো যে নিবন্ধনের আবেদনের দিনেই ইতিবাচক বার্তা দিতে হলো
জামায়াতে ইসলামী বিএনপির জোটের শরিক। যদিও কিছুদিন আগে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্নের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ওই মন্তব্যের পর দল আনুষ্ঠানিকভাবে এনিয়ে মন্তব্য করেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এনিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আপনাদের যা ইচ্ছা ্লেখেন’। কেবল বিএনপিই নয়, জামায়াতও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আছে কি নেই এনিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই নতুন নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছে জামায়াত। আবার ইসির প্রাথমিক মন্তব্য মিলেছে ইতিবাচক বার্তা। নির্বাচন কমিশন যদিও স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তবু প্রশ্ন তবে কি আগামী নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগের আছে কোন পরিকল্পনা? বিগত দুই নির্বাচনে আমরা দেখেছি জাতীয় পার্টিকে নামসর্বস্ব বিরোধীদল বানিয়ে নির্বাচনের পরিকল্পনা। এবার কি তবে ভিন্ন নামের জামায়াত জাতীয় পার্টির জায়গায় প্রতিস্থাপিত হতে যাচ্ছে?
বাংলাদেশ ডেভোলাপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে যে দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে এই দলটি সম্পর্কে আগে কেউ জানত না। দলটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কোথায় তাদের অফিস, জেলা-জেলায়, উপজেলা-উপজেলায় কারা আছে তাদের; এগুলো আমরা কেউ জানতাম না। কোন গণমাধ্যমে আগে থেকে তাদের কোন খবর প্রকাশিত হয়নি। তারা কোন বিষয়ে কোথাও কোন বিবৃতি পর্যন্ত আগে কখনও দিয়েছে কি-না এসবও জানা নাই। তবু নিবন্ধনের আবেদনের দিন দেখা গেল তারা ইসিকে লিখিতভাবে জানাচ্ছে সারাদেশের জেলায়-জেলায়, উপজেলায়-উপজেলায় কমিটি আছে। দলটি নির্বাচন কমিশনে ৫০ হাজার সমর্থকের তালিকাও দিয়েছে। যাদের সম্পর্কে কেউ কখনই কিছু জানত না তারা কীভাবে এতকিছু করে? তারা কীভাবে পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠার নথি জমা দেয় নির্বাচন কমিশনে। যে সংগঠনের নাম পর্যন্ত শুনেনি কেউ তাদের পঞ্চাশ হাজারের বেশি সমর্থক, জায়গায়-জায়গায় কমিটি; এমন 'গোপন সংগঠনের' নিবন্ধনের যুক্তি থাকে না।
বিডিপি জামায়াতে ইসলামীর নতুন নাম। জামায়াত নামে তারা নিবন্ধন পাবে না নিশ্চিত হয়েই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। হাই কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা ঘোষণা করেছিল মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নীতি-আদর্শের কারণে। সেই জামায়াত নতুন নামে দল ইসিতে নিবন্ধন পেলে হাই কোর্টের সেই রায়ের অবমূল্যায়ন হয়। ইসি হাই কোর্টের যে রায়ের আলোকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জামায়াত অন্য যেকোনো নামেও যদি নিবন্ধন পায় তবে ইসির নিজেদের প্রজ্ঞাপনকেই অবজ্ঞা করা হবে।
`নিয়ম মেনে আবেদন’ করলেই নিবন্ধন, এমন সরলীকরণে যাওয়া উচিত নয়। যে পঞ্চাশ হাজার সমর্থকের তালিকা, পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠার নথি বিডিপি নামের জামায়াতের সেগুলো ভালো করে দেখলেই প্রমাণ হবে এরা কারা। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আছে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহিদ, দুই লক্ষ নারীর অপমানকে মাথায় রেখে নারীর ক্ষমতায়ন ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে দেশবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসনে ইসি কঠোর হবে এই প্রত্যাশা আমাদের।
যে নামেই আসুক জামায়াত জামায়াতই। তাদেরকে ‘না’ বলতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও বাংলাদেশকেই অপমান করা হবে। আমরা এমন অপমান দেখতে রাজি নই!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক, ইমেইল: [email protected]